বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার চুরির নেপথ্যে যে হ্যাকার
আড়াই বছর আগে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরিতে উত্তর কোরিয়ার এক হ্যাকার জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তার নাম পার্ক জিন হিয়ক। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাক করে আট কোটি ডলারের বেশি অর্থ লুটের আগে উত্তর কোরিয়ার এই সাইবার ক্রিমিনাল ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সনি করপোরেশনেও সাইবার হামলা চালিয়েছিল।এছাড়া ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে ‘ওয়ানাক্রাই র্যানসমওয়ার’ সাইবার হামলার সাথে সে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।এসব অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে তার বিচার করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছেন। খবর এনবিসি নিউজ ও রয়টার্সের।
বিবিসি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে এই উত্তর কোরিয় হ্যাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে।
মার্কিন বিচার বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জন ডেমারস জানিয়েছেন, বিচার বিভাগের জন্য এই তদন্ত ছিল অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। ২০১৪ সালে সনি পিকচার্সে সাইবার হামলার মূল কারিগর ছিলেন পার্ক জিউন হিউক। একইসঙ্গে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতেও মূল প্রোগ্রামারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররাই সাইবার হামলার জন্য দায়ী। সনি পিকচার্সে সাইবার হামলা চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দেয়া হয়।
গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জানিয়েছে, তারা কম্পিউটার ইন্টারনেট অ্যাড্রেস এবং হ্যাকিং টুলস নিয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে যে, এরা উত্তর কোরিয়ার হ্যাকার। আর এদের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া সরকারের যোগাযোগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগ নিলেও নিজেদের এই নাগরিককে উত্তর কোরিয়া বিচারের জন্য ওয়াশিংটনের হাতে তুলে দেবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দুই দেশের মধ্যে অপরাধী হস্তান্তরের কোনো চুক্তিও নেই।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কা এবং ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে। এ ঘটনার প্রায় একমাস পর ফিলিপাইনের একটি সংবাদ মাধ্যমের খবরে বিষয়টি বাংলাদেশ জানতে পারে।
কে এই হ্যাকার?
মার্কিন কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পার্ক জিন হিয়ক ছিল একটি হ্যাকার টিমের অংশ। এরা পরিচিত ‘ল্যাজারাস গ্রপ’ নামে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিরক্ষা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান লকহীড মার্টিন কর্পোরেশনকে তারা টার্গেট করেছিল। কিন্তু সফল হতে পারে নি।
তবে এর আগে ২০১৪ সালে এরা সনি কর্পোরেশনে একটি বড় সাইবার হামল চালায়। সেখান থেকে তারা অনেক তথ্য চুরি করে। অনেক তথ্য নষ্ট করে ফেলে। এই হামলাটি চালানো হয়েছিল ‘দ্য ইন্টারভিউ’ নামে একটি ছবি নিয়ে উত্তর কোরিয়ার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার পর।
ছবিটির একটি চরিত্র ছিল উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের আদলে, এতে দেখানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া চাইছিল, সনি কর্পোরেশন যেন এই ছবি না বানায়।
পার্ক জিন হিয়ক ফেসবুকে এবং টুইটার বিভিন্ন বিভিন্ন নামে একাউন্ট খুলে লোকজনের কাছে এমনসব লিংক পাঠাতো যাতে উত্তর কোরিয়ার নানা ম্যালওয়ের থাকতো।
তবে তাদের সবচেয়ে মারাত্মক সাইবার হামলা ছিল ‘ওয়ানাক্রাই র্যানসমওয়ের’ দিয়ে। ২০১৬ সালে এই সাইবার হামলার শিকার হয় বিশ্বজুড়ে অনেক দেশ এবং কোম্পানি। ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) এই হামলায় অংশত অচল হয়ে পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এসিস্ট্যান্ট এটর্নি ট্রেসি উইলকিনসন বলেছেন, এরা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ কিছু সাইবার হামলার জন্য দায়ী। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার ডাকাতির ঘটনাও আছে।
যে চীনা কোম্পানি ‘চুসান এক্সপো’র আড়ালে এই হ্যাকার চক্র কাজ করতো তাদের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
কী বলছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের নেয়া পদক্ষেপকে একটা বড় অগ্রগতি বলে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, যেহেতু নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে এই অর্থ চুরি হয়েছিল, তাই যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এই ঘটনার তদন্ত চালাচ্ছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশেও সিআইডি এই সাইবার হামলার ঘটনা তদন্ত করছে। তারা সব কিছুই দেখছে।
“আমরা চাই যারা দোষী, তারা ধরা পড়ুক।”
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার ডাকাতির পর পদত্যাগ করতে হয়েছিল তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে
তবে সিআইডির যে কর্মকর্তা এই ঘটনার তদন্ত করছেন, তিনি বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার সংশ্লিষ্টতার কথা তারা আগেও শুনেছেন, কিন্তু এ ব্যাপারে নিজেদের তদন্তে নিশ্চিত হওয়ার মতো কিছু পাননি।
সিআইডির স্পেশাল সুপারিনটেন্ডেন্ট মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, “উত্তর কোরিয়ার সংশ্লিষ্টতা যদি কোন বিদেশি সংস্থা পেয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করবো, তাদের প্রমানগুলো আমরা দেখবো। আমরা এফবিআই এর সঙ্গেও বসবো। বসে তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।”
তিনি জানান, সামনের সপ্তাহেই ঢাকায় সিআইডি কার্যালয়ে এফবিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হওয়ার কথা আছে।
নিজেদের তদন্ত সম্পর্ক তিনি বলেন, এই ঘটনায় যেহেতু অনেক বিদেশি নাগরিক জড়িত, তাই তদন্তে অগ্রগতির জন্য সেসব বিদেশি নাগরিককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। এসব দেশের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।
তিনি জানান, এই ঘটনায় তারা এ পর্যন্ত ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, ভারত, চীন এবং জাপানি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন। -বিবিসি