বিশ্বে আশি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের হার কমলেও দেশে ক্ষুধার্ত মানুষ বাড়ছে। যা টেকসই উন্নয়নের জন্য উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের মতো দেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির উন্নয়নে বেশি জোর দেওয়া উচিত। শুধু খাদ্যের উৎপাদন না বাড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ ও খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন মালয়েশিয়ার অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জোমো কোয়ামে সুন্দরম। সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে এসময় বক্তব্য রাখেন, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ ছাড়া প্রশ্নোত্তর পর্বে কথা বলেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিপিডির বিশেষ ফেলো ও বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদ, পরিবেশবিদ আতিক রহমান, ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ, অধ্যাপক আমিনুল করিম, আইনজীবী সারা হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
জোমো কোয়ামে সুন্দরম বর্তমানে মালয়েশিয়ার কাউন্সিল অব অ্যামিনেন্ট পারসনসের বিশেষ সদস্য। তিনি জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের (ডিইএসএ) অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছেন।
সুন্দরম বলেন, নব্বইয়ের দশকে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করলেও বর্তমানে এই হার ২৪ ভাগেরও নিচে। এ ছাড়া হত দরিদ্রের হার ১৩ ভাগের নিচে। বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকারের এই পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার মিল খুবই কম।
তবে দারিদ্র্যের হার কমেলও সেই অনুপাতে কমছে না ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা। বর্তমানে আশি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত। আর এজন্য প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে জিডিপির পাঁচ ভাগ। সমস্যা সমাধানে সরকারের পাশাপাশি সামজিক সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি আরো জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে নাবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের বিকল্প নেই। দেশের গ্রামীণ পর্যায়ে নাবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রসংশাও করেন তিনি।
বাংলাদেশের মতো দেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টির উন্নয়নে বেশি জোর দেওয়া উচিত। শুধু খাদ্যের উৎপাদন না বাড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ ও খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে।
জোমো কোয়ামে সুন্দরম তাঁর বক্তৃতায় আরও বলেন, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও ক্ষুধার্ত মানুষের অনুপাত বাড়ছে। তবে তিনি এই সংখ্যা কত, তা জানাননি। তিনি আরও জানান, ২০১২-১৪ সময়ে সারা বিশ্বে ৮০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকত। ওই সময়ে ২০০ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগত। এ ছাড়া ৫ বছরের কম বয়সী ৪ কোটি ২০ লাখ শিশু অতিরিক্ত ওজনধারী। আর ২১০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের অতিরিক্ত ওজন। তাঁর মতে, খাদ্যাভ্যাসের কারণে নানা ধরনের রোগবালাইয়ের শিকার হয় মানুষ।
জোমো কোয়ামে সুন্দরমের মতে, মানুষের জীবন রক্ষায় অর্থনীতিতে তৃতীয় বৃহত্তম বোঝা হলো অতিমাত্রায় স্থূলতা। এর আর্থিক মূল্য হলো ২ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্য দুটি হলো সশস্ত্র সংঘাত ও ধূমপান। এই দুটি বোঝার আর্থিক মূল্য হলো ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার করে। তিনি মত দেন, খাদ্যনিরাপত্তার জন্য উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি কেমিক্যাল ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে। কেমিক্যাল ব্যবহারে স্বাস্থ্যহানির সুযোগ থাকে।
জোমো কোয়ামে সুন্দরম তাঁর বক্তৃতায় আরও বলেন, সারা বিশ্বে বৈষম্য বাড়ছে। গরিবের তুলনায় ধনীরা বেশি সম্পদশালী হচ্ছে। তিনি বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে গরিব ২০টি দেশের সঙ্গে সবচেয়ে ধনী ২০টি দেশের তুলনা করেন। সেখানে তিনি বলেন, ১৯৬০-৬২ সালের দিকে সবচেয়ে গরিব ২০টি দেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ২১২ ডলার। তখন সবচেয়ে ধনী ২০টি দেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১১ হাজার ৪১৭ ডলার। ৪ দশক পরে ২০টি গরিব দেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ২৬৭ ডলার। ৪ দশকের ব্যবধানে মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে ওই সময়ে ধনী ২০টি দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৩৩৯ ডলার। ৪ দশকে ধনী দেশের মাথাপিছু জিডিপি তিন গুণ বেড়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত দারিদ্রের হার কমছে। সরকারের এমন পরিসংখ্যানের সাথে আমরা এক মত না হলেও দারিদ্র্য কমছে। কিন্তু সে হারে ক্ষুধার্থের সংখ্যার কমছে না। এতে করে মানুষ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চিত মানুষরা না সরকারের সহায়তা পাচ্ছে না আন্তর্জাতিক সহায়তা পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে এসব বৈষম্য দূর করতে হবে। কাগুজে অনেক রিপোর্ট থাকলেও বাস্তবতার সাথে মিল নেই। এ সব গোজা মিল থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এসময় দেশ বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে। কারণ পরিসংখ্যানে ভুল থাকলে দেশের পরিকল্পনাও ভুল হয়। এ নিয়ে সরকারকে এক্ষণি ভাবতে হবে।
রেহমান সোবহান বলেন, চীন এশিয়ার অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ভারতও এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নয়ন তথা বাণিজ্যের হাওয়া এখন এশিয়ায়। তাই এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আরও বেশি পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা উচিত।