খলিলুর রহমান কাশেমী: এক অবিনাশী আলোর আধার
আবদুল কাদের তাপাদার: সেদিন কবিতার জোয়ার বান ডেকেছিলো। সুরমা যেনো উর্মিমুখর হয়ে উঠেছিলো। সাহিত্যের আলোকধারায় চারিদিকে হৈচৈ রব। ১৯৯০ সালের ৫ জানুয়ারী। সিলেটে কবিতা উৎসব ও মহাকবি ইসহাক রেজা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। মহা আয়োজন। বৃহত্তর সিলেটের দুই শতাধিক নবীন প্রবীন কবি সাহিত্যিক উৎসবে শরীক হয়েছেন।
সিলেট পৌরসভা মিলনায়তনে স্বাধীনতাত্তোরকালের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক সাহিত্য সম্মেলন। প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারার প্রধান কবি, সোনালী কাবিনের কবি, মুক্তিযোদ্ধা কবি আল মাহমুদ। এসেছেন কবি বেলাল মোহাম্মদ, কবি সাইফুল বারী, কবি এ এইচ মোফাজ্জল করিম, কবি মুজিব হাসানসহ ঢাকার নামকরা কবি সাহিত্যিকগন। সিলেটে এতোবড় আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা কে জানেন? তৎকালিন সাড়াজাগানো সাহিত্য মাসিক সমীকরণ সম্পাদক খলিলুর রহমান কাসেমী।
আমি তখন এমসি কলেজ থেকে ডিগ্রী পরীক্ষার্থী। কলেজে পড়ালেখার পাশাপাশি সাহিত্য পাড়ায় আমার বিচরণ চোখে পড়ার মতো। সমীকরণের আমি নিয়মিত প্রতিবেদক। আরেকজন সিরিয়াস প্রতিবেদক মুজিবুর রহমান। সমীকরণের প্রধান প্রতিবেদক তখন সিলেটের ডাক এর মাহবুবুর রহমান ভাই। আমি সাঈদ চৌধুরী, রায়হান চৌধুরী কামাল তৈয়ব সম্মেলনের প্রচার বিভাগের দায়িত্বে। জমজমাট সম্মেলন হলো।
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ ও আকাংখিত এক ভাষণ দিলেন। সিলেটে সাহিত্যের খরা জমিন যেনো সুজলা সুফলা হয়ে উঠলো। মাসিক সমীকরণের চলতি সংখ্যাটা এই কবিতা উৎসব আর সম্মেলনের সামগ্রিক দিক নিয়ে লেখায় ভরে উঠলো। সমীকরণ যেনো সকল কবি সাহিত্যিক লেখক সাংবাদিকের আরাধ্য হয়ে উঠলো।
খলিলুর রহমান কাসেমীর শুধু মেধা মনন বা চিন্তা চেতনা নয়, অনেক টাকা পয়সার বিনিময়ে সফল হলো সিলেটের ঐতিহাসিক সেই কবিতা উৎসব। সমীকরণ তখন সিলেটের লেখকদের মুখপত্র হয়ে উঠেছিলো। সমীকরণ না হলে আমাদের মতো অনেক তরুণ লেখকের সম্ভাবনা অকালেই হারিয়ে যেতো। সাহিত্যের ‘সমীকরণ’ কষে কষে আর ‘জাগরণ’ এর গান গেয়ে গেয়ে সিলেট তখন সাহিত্য সাংবাদিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে। জাগরণ সম্পাদনা করতেন কবি রাগিব হেসেন চৌধুরী। আজকে যারা সাহিত্য সাংবাদিকতায় সামনের কাতারে আছেন, অনেকেই নেতৃত্বের আসনে সমাসীন তারা অনেকেই সমীকরণ, জাগরণের পথ বেয়ে উঠে এসেছেন। আর তাদের সৃষ্টির পেছনের কারিগর কাসেমী ভাই।
খলিলুর রহমান কাসেমীর সাংবাদিকতাবোধ,সাহিত্যবোধে ছিলো এক আলাদা ও অনন্য দৃষ্টিভংগী। তিনি সকল কবিতা বা কবিকেই কবিতা বা কবি হিসেবে মানতে পারতেন না। তেমনি সাংবাদিকতাকে তিনি তার মতো করে দেখতেন। তিনি সিলেটের সাংবাদিকতাকে অনেকটা কেরানীগীরী বা প্রেসরিলিজ সর্বস্ব সাংবাদিকতা ভাবতেন। এ নিয়ে আমাদের অনেক সিনিয়র জুনিয়রের সাথে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন। তিনি সাহিত্য সাংবাদিকতার মৌলিকত্বে বা কোয়ালিটি তে বিশ্বাস করতেন। বাজারি বা বাণিজ্যিক সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন।
তাঁর একটা বড় স্বপ্ন ছিলো সিলেট থেকে একটা মান সম্পন্ন দৈনিক বের করার। এজন্য তিনি আমার কাছ থেকে একটা বাজেট চেয়েছিলেন। আমি তাকে সেটা দিয়েছিলাম। তিনি দেখে তো রীতিমতো হতবাক। দৈনিকের লক্ষ্য নিয়েই তিনি বের করেন জনধারা। দৈনিক জালালাবাদের তৎকালিন নির্বাহী সম্পাদক আবদুল হামিদ মানিকের মাধ্যমে তিনি আমাকে জনধারায় কাজ করার প্রস্তাব দেন। আমি তাঁর সাথে দেখা করি পৌর বিপনীর কিংশুক মুদ্রায়নে। সেদিন ভাবী নাজনীন
খলিলও সেখানে ছিলেন। আলাপ আলোচনার পর কাসেমী ভাই আমাকে জনধারা সাপ্তাহিক হিসেবে চালাতে বলেন। আমার পদবী তিনিই ঠিক করে দিলেন। বার্তা সম্পাদক। আমি মাত্র কয়েক মাস হয় দৈনিক জালালাবাদের বার্তা সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি।
যাহোক, আমি ধারাবাহিক কয়েক মাস কাসেমী ভাইর ও নাজনীন খলিলের সম্পাদনায় জনধারা বের করি। মূলতঃ এসময় আমি সাংবাদিকতা নিয়ে তার চিন্তার গভীরতা ও প্রখরতা উপলব্ধি করি। প্রথম সংখ্যার লিড নিউজ আমি তৈরী করি। এটি একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। আমি শিরোনাম দিইঃ সিলেটের ব্যাংকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি অলস টাকা। তিনি শিরোনাম বদলে দেন। শিরোনাম হয়ঃ “সিলেটের ব্যাংকে টাকার পাহাড়”। পরে আমি দৈনিক জালালাবাদ নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে,আর সময় দিতে পারিনি। পরে তিনি দৈনিক জনধারার ডামি সংখ্যা হিসেবে কয়েক সংখ্যা বের করেন। জনধারা বাজারে দেয়া হয়নি। তাঁর দৈনিকের স্বপ্নও আর আলোর মুখ দেখেনি।
পরবর্তীকালে আমার সাথে কাসেমী ভাইর যোগাযোগেও ছেদ পড়ে। টেলিফোনে আলাপ হয়েছে হাতেগোনা তিন চারদিন। তিনি যে গুরুতর অসুস্থ সেটা আমি জানি মৃত্যুর ৫/৬ দিন আগে। ঢাকা থেকে কবি ও লেখক মীর লিয়াকত ভাই কাসেমী ভাইর শিয়রে বসে ফোনে আমাকে জানান, কাসেমী ভাই খুউব অসুস্থ। তিনি কথা বলতে পারেন না। আমি যেনো জালালাবাদে এই খবরটা ছাপি। তিনি আমার ইনবক্সে কাসেমী ভাইর একটা ছবিও পাঠান। আমি পত্রিকায় তাঁর অসুস্থতার খবরটা ছাপি। তিনি এরপর বাসায় যে কবে আসলেন তাও জানায়নি কেউ। জানলে হয়তো দেখতে যেতে পারতাম।
হঠাৎ তাঁর ইন্তেকালের খবর পেয়ে আমি বাকরুদ্ধ। শাহজালাল উপশহরের আই ব্লকের মাঠে আমি তাঁর জানাজায় শরীক হয়েছিলাম। আমার মতো শোকার্ত অনেক সাংবাদিক, লেখক কবি, সাহিত্যিক তাঁর জানাজায় শরীক হন। এঁদের মধ্যে সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুকতাবিস – উন- নূুর, বিশিষ্ট লেখক কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী, দৈনিক সংলাপ সম্পাদক মুহাম্মাদ ফয়জুর রহমান, গল্পকার সেলিম আউয়াল, দৈনিক সিলেটের ডাক এর চীফ রিপোর্টার সিরাজুল ইসলাম, সাংবাদিক শাব্বির আহমদ, সাংবাদিক সিরাজুল ইসলাম প্রফেসর আজিজুর রহমান লস্কর, লেখক মাহবুবুজ্জামান জামান, ফটো সাংবাদিক আবদুল বাতিন ফয়সল, তরুণ ফটো সাংবাদিক এটিএম তোরাবসহ অনেকেই ছিলেন। শহরের অনেক ব্যবসায়ী, আইনজীবীসহ অনেকেই জানাজায় তাঁকে শেষ বিদায় জানান।
আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করিতিনি যেনো কাসেমী ভাইকে ক্ষমা করে দেন। আর তাঁকে যেনো জান্নাতের বাসিন্দা হিসেবে কবুল করে নেন। আমীন।
আবদুল কাদের তাপাদার
নির্বাহী সম্পাদক
দৈনিক জালালাবাদ, সিলেট।
১১/০৯/১৮