শাহ আজিজুর রহমান ও আজকের রাজনীতিকদের দৈন্যতা
আবদুল কাদের তাপাদার: শাহ আজিজুর রহমান। এক সময়ের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে জুতা ছুঁড়ে দিয়ে আলোচিত হয়ে উঠেন ছাত্র জমানায়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের রণাংগনের অকুতোভয় সাহসী বীর সেনানী। সিলেট ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক সময়ের প্রভাবশালী কর্ণধার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহভাজন নেতা। সিলেট আওয়ামী লীগে মাটি ও মানুষের নেতা বলে বহুল আলোচিত রাজনীতিক। বালাগন্জ- বিশ্বনাথ- ওসমানীনগর এলাকা থেকে জাতীয় সংসদের এক সময়কার সদস্য। নিজ উপজেলা বালাগন্জের ছিলেন নির্বাচিত চেয়ারম্যান কাউকে যদি সত্যিকারার্থে তৃণমূলের মানুষের ভালোবাসার রাজনীতিক হিসেবে অভিহিত করতে হয় তাহলে অবশ্যই শাহ আজিজের নামটা আসবে সর্বাগ্রে। নির্লোভ, নিরংহকার আর সাদামাটা রাজনীতিকের প্রতিচ্ছবি হিসেবে কাউকে অভিহিত করতে হলে সেটা শাহ আজিজকেই করতে হবে। রাজনীতিকরা নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের কাজ করে দেন, নিঃস্বার্থ সমাজসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন, থানায় গ্রেফতারকৃত নিরপরাধ নেতাকর্মী অথবা এলাকার কাউকে ছাড়িয়ে আনতে এসপি, ওসিকে ধমক দিতে পারেন, এসব আজ অনেকটা সোনালী অতীতের কাহিনী ।কিন্তু শাহ আজিজ ভাই হরহামেশাই এসব করে দেখাতেন।
তিনি তখন সংসদ সদস্য। তাঁর এলাকা বালাগন্জে একটা বড় মার্ডার হয়েছে। হত্যা মামলায় অনেক আসামী। নিরপরাধ লোকজনকে আসামী করা হয়েছে। আসামীদের পক্ষ থেকে পুলিশ সুপারের কাছে একটা আবেদন করা হয়েছে। তিনি এই আবেদন নিয়ে এসেছেন দৈনিক জালালাবাদ অফিসে। আমি বললাম,আপনি স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে বললেই তো হয়। তিনি আমাকে জানালেন, তার চেয়ে আপনাদের লেখনি অনেক শক্তশালী। স্বরাস্ট্রমন্ত্রীকে বললে আমাকে ভুল বুঝবে। এসপিকে তদন্ত করতে দেবে। কোনোদিনও আর তদন্ত শেষ হবে না। একটা পজিটিভ রিপোর্ট হলে এই গরিব নিরপরাধ আসামীদের জামিন হতে পারে। জালালাবাদে রিপোর্ট হওয়ার তিন চারদিন পর আসামীদের অনেকেরই জামিন হয়। তিনি এভাবে অনেক রিকোয়েস্ট পাঠাতেন। কিন্তু কোনোদিন তাঁর ব্যক্তিগত কোনো সভা সমাবেশ বা আত্মপ্রচারের কোনো অনুরোধ করেননি। আজকের অনেক রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মিছেমিছি আসামী বানিয়ে পুলিশের সাথে মিলে বাণিজ্যের ধান্ধাবাজির পথ খুঁজেন। কিন্তু অনেক প্রভাবশালী এমপি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কোনোদিন শুনিনি। এমপিদের জন্য সাধারণতঃ ট্রেনে বিশেষ আসন বরাদ্দ থাকে। কিন্তু শাহ আজিজের এসবে মোটেও লোভ ছিলো না।
একদিন ঢাকা যাচ্ছি বিকেল ৩ টার পারাবত ট্রেনে। আমার সাথে সেসময়কার দৈনিক দিনকাল এর ব্যুরোচীফ শাহান চৌধুরী। ট্রেনে সিট খুঁজতে গিয়েই দেখি আমাদের পাশের সিটে বসে আছেন শাহ আজিজ ভাই। তাঁর সাথে সহানীয় আওয়ামী লাীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের এক নেতা। আমাকে দেখেই তিনি তাঁর পাশে বসতে অনুরোধ করলেন। তাঁর সংগীয় ভাইকে আমার সিটে বসতে বললেন।দীর্ঘ ৭ ঘন্টার যাত্রাপথ। ট্রেন শ্রীমংগলে পৌঁছানোর সময় হলো। আছরের নামাজের সময় অত্যাসন্ন।
হঠাৎই শাহ আজিজ ভাই নামাজের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। শাহ আজিজ নামাজের এমন পাবন্দ তা আগে আমার ধারণায় ছিলো না। আমরা ট্রেনের নামাজের কক্ষে গিয়ে নামাজ আদায় করলাম। এভাবে মাগরিবের নামাজও পড়লাম কসাথে। নামাজের পর ট্রেনের কর্মচারীরা নাস্তার হাকডাক শুরু করলে আমরা সবাই মিলে নাস্তা খেলাম। বিলটা আমি বা শাহান চৌধুরী দিতে চাইলেও পারলাম না। তিনিই বিল পেইড করলেন। পথে সিলেটের উন্নয়ন ও রাজনীতি ইত্যাকার নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনায় তিনি মাতিয়ে রাখলেন আমাদের। আবদুস সামাদ আজাদ, সুরন্জিত সেনগুপ্ত, দেওয়ান ফরিদ গাজী, স্পীকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর প্রসংগ এলো। এম,সাইফুর রহমান আর জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী নিয়ে তিনি আমাকে অনেক প্রশ্নবানে জর্জরিত করলেন। আমি তাঁর কাছে হার মানলাম। আসলে তিনি এঁদের সম্পর্কে এতো বেশি জানেন তা আমার ধারণায় আগে ছিলো না। এদিন তাঁর কাছ থেকেই চমকপ্রদ একটা তথ্য জানতে পারলাম সিলেট আওয়ামীলীগের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ নিয়ে। তিনি আমাকে বললেন, এই বিরোধটা জাত বংশের। একদিকে আবদুস সামাদ আজাদ। অন্যদিকে দেওয়ান ফরিদ গাজী,সুরন্জিত সেনগুপ্ত। স্পীকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী পরবর্তীতে এদের সাথে ছিলেন।
যাক, ট্রেন থেকে নামার আগে আমাকে জানতে চাইলেন,কোথায় উঠবো। আমি বললাম,আমরা ক্যাপিটালে উঠবো। তিনি আমাকে না না বলে তাঁর সাথে হোটেল উপবন এ উঠতে বললেন। শাহ আজিজ এটা তাঁর হোটেল এবং ঢাকা এলে যেনো এখানে উঠি বলে আমাদেরকে খুব দাবি নিয়ে কথাগুলো বলে দিলেন।
আমরা তাঁর কথাই মেনে নিলাম। সকালে তিনি বের হওয়ার সময় আমাদের রুমে এসে হাজির। বললেন, তোমার টাইটা
খুব সুন্দর। আমাকে দাও। টাই পরে হাইকোর্টে কি একটা কাজে চলে গেলেন। দুদিন থাকার পর তিনি সিলেট ফিরে যাবেন। আমরা থাকবো আরো দু’একদিন। তিনি আমাদের রুমের ভাড়া পরিশোধ করে গেলেন।
আমি তাঁর তেমন স্বজন পরিজন কেউ নই।সামান্য একজন সাংবাদিক আমি। ট্রেন ভ্রমনে কয়েক ঘন্টায় এতো অন্তরংগতা কিভাবে হয়ে গেলো তা আমি আজো ভাবি। আসলে আমাদের মানবিক গুনটাই মানুষকে অন্যের আপন করে নেয়।মানবিকতাই মানুষকে মহান করে তোলে।
আমি তাঁর বাসায় অনেকবার গিয়েছি। আমার সাথে তাঁর অনেক স্মৃতিময়তা জড়িয়ে আছে। সিলেটে আমার তিন দশকের সাংবাদিকতা জীবনে আমাদের হাত ধরেঅনেক ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি জন্ম নিয়েছেন। তারা হয়তো আজ আর আমাদের মনে করেন না। কিন্তু শাহ আজিজের মতো মানবিক মানুষেরা বরাবরই আমাদেরকে মনে করেছেন। কাছে টেনে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মত বিনিময় করেছেন।
গত দুই দশক ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। শাহ আজিজ একসময়ের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা, সাবেক এমপি। তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর হাত ধরে উঠা আসা আজকের দলের অনেক অনেক বড় বড় নেতা। কিন্তু তাঁর সাদামাটা জীবন যাপন। এ সময়ে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অনেকেই আংগুল ফুলে কলা গাছ হলেও শাহ আজিজুর রহমান নির্বিকার জীবন পার করেছেন।
ছাত্রলীগে তাঁর অসামান্য ভূমিকা, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনি এক বড় মাপের সেনানী, রাজনীতিতে তাঁর মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শিক দিকদর্শন তাঁকে অমর করে রাখবে l