মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপরাধের ভয়ঙ্কর বিবরণ ফাঁস
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ৪৪০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যতদিন আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে, ততদিন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে শান্তি ফিরবে না বলে মন্তব্য এসেছে রোহিঙ্গা নিপীড়নের তদন্তে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৫ মাসের তদন্ত শেষে তিন সদস্যের এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন ৪৪০ পৃষ্ঠার যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে রাখাইনসহ মিয়ানমারের তিনটি রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ভয়ঙ্কর সব বিবরণ উঠে এসেছে।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা এই প্রতিবেদনে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং জ্যেষ্ঠ পাঁচ জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করার কথাও আছে।
গত অগাস্টের শেষে ২০ পৃষ্ঠার এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের মূল পর্যবেক্ষণগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরার পাশাপাশি বেশ কিছু বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল। তদন্তকারীরা মঙ্গলবার জেনিভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন উপস্থাপন করছেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্যপ্তির দিক দিয়ে ‘অনন্য’ এই প্রতিবেদন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর (তাতমাদো) মানবাধিকার ও আইন লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর স্পষ্ট একটি ‘প্যাটার্ন’ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অপরাধের মাত্রা নিয়ে বিশদ আইনি পর্যালোচনা ও সুপারিশ রয়েছে সেখানে।
এই মিশনের নেতৃত্ব দেন ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মারজুকি দারুসমান। সদস্য হিসেবে ছিলেন শ্রীলঙ্কার আইনজীবী নারী অধিকার বিশেষজ্ঞ রাধিকা কুমারস্বামী এবং অস্ট্রেলিয়ার সাবেক মানবাধিকার কমিশনার ও দেশটির আইন সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য ক্রিস্টোফার ডমিনিক সিডোটি।
জেনারেল মারজুকি দারুসমান প্রতিবেদনে বলেছেন, “তাতমাদো যতদিন আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে, ততদিন শান্তি ফেরানো সম্ভব হবে না। মিয়ানমারের উন্নয়ন এবং একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে দেশটির সেনাবাহিনীই সবচেয়ে বড় বাধা।”
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান বলছেন, মিয়ানমারে শান্তি চাইলে সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ তাতমাদোর শীর্ষ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিয়ে এই বাহিনীকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে এর পুরো নিয়ন্ত্রণ বেসামরিক প্রশাসনের হাতে থাকে।
মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই বলেই জাতিসংঘের তদন্তকারীরা মনে করছেন।
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। তাদের কথায় পাওয়া যায় নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের ওই দাবি নাকচ করে দিয়ে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাখাইনে যে পরিমাণ নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে, তার তুলনায় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পার্থক্যটা খুবই স্পষ্ট।
ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন এবং বিস্তৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টার সমতুল্য।
গতবছর গঠিত জাতিসংঘের এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সদস্যরা বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশে আশ্রয় নিয়ে থাকা ৮৭৫ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়ে, নথিপত্র, ভিডিও, ছবি এবং স্যাটেলাইট ইমেজ পর্যালোচনা করে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছেন, রাখাইনে সেনাবাহিনীর নিপীড়নের যে ধরন, তা শান ও কাচিন অঞ্চলে জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর দমনপীড়নের ধরনের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়।
নির্যাতিত রোহিঙ্গা আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে তুলা তলি গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানের লোমহর্ষক বিবরণ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
সেখানে দেখানো হয়েছে, পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের কীভাবে ধাওয়া করে ধরা হচ্ছে, সৈন্যরা প্রথমে তাদের গুলি করছে, তাতেও মৃত্যু না হলে প্রত্যেকের গলা কেটে ফেলা হচ্ছে। তারপর তারা নজর দিচ্ছে নারী ও শিশুদের দিকে।
ওই গ্রামে শিশুদেরও কীভাবে গুলি করে মারা হয়েছে, মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে নদীতে বা আগুনে ছুড়ে ফেলা হয়েছে- সেসব ভয়ঙ্কর বিবরণও এসেছে প্রতিবেদনে। এই হত্যাযজ্ঞ শেষে মেয়েদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে গ্রামে। পালা করে ধর্ষণ করার পর কাওকে কাওকে হত্যা করা হয়েছে। বুড়ো, শিশু আর নির্যাতিত নারীদের ঘরের ভেতরে আটকে আগুন দেওয়া হয়েছে বাড়িতে।
রাখাইনের তুলা তলি গ্রামের এই বর্বরতাকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জঘন্যতম অপরাধের নজির হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের এই তদন্তকারী দলের সদস্য রাধিকা কুমারস্বামী বলেন, রাখাইন, শান আর কাচিন রাজ্যে বর্বরতার যে মাত্রা সেনাবাহিনী দেখিয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করার মত আর কোনো ঘটনা তিনি দেখেননি।