“গো” মাতা: হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কুশলী আইকন
পিনাকি ভট্টাচার্য: নিউইয়র্কে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভায় জনৈক শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “আমরা হিন্দুরা গো কে মাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করি“ আমার কাছে এই বাক্যটির তাৎপর্য ভিন্ন। “আমরা হিন্দুরা” বলতে শ্যামল চক্রবর্তী কাদের বুঝাচ্ছেন? আর গরুকে মাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করার বিষয়টা কোথায় পেয়েছেন?
“গোমাতা” শব্দটা হিন্দু ধর্মের কোন স্ক্রিপচারে নেই। এই গোমাতা শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন প্রাচীন রাজনীতিবিদ চাণক্য। তিনি কোন কোন বিষয়কে “মাতা” বলে ডাকা যাবে সেটার তালিকায় “গোমাতা” শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন। আধুনিককালে ভারতবর্ষের রাজনীতিতে “গোমাতা” শব্দটা পুনরাবিষ্কার করেন আর এস এসের প্রধান “গোলওয়ালকার” ১৯৫২ সালে তাঁর একটি প্রবন্ধে। খুব কৌতূহল জনক বিষয় হল গোলওয়ালকার নিজে খুব বেশী কিছু লিখেননি; কিন্তু ‘গোমাতা” সম্পর্কে কিছু বলার জন্য তিনি কলম ধরেছিলেন। তাহলে ধরেই নিতে হবে এই লেখাটা আর এস এসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল। তিনি কী লিখেছিলেন?
“(It was, therefore,) necessary to revive the fundamental values and ideas, and to wipe out all signs that reminded us of our past slavery and humiliation. It is our first necessity to see ourselves in pristine purity. Our present and future has to be well united with our glorious past. The broken chain has got to be re-linked. That alone will fire the youth of free India with a new spirit of service and devotion to our people. There cannot be a higher call of national unity than to be readily prepared to sacrifice our all for the honour and glory of the motherland. That is the highest form of patriotism.”
“প্রয়োজন হল মৌলিক মূল্যবোধ আর ভাবধারাগুলিকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা, যা কিছু আমাদের অতীতের দাসত্ব আর অবমাননার চিহ্ন বহন করে সে সমস্ত মুছে ফেলা। সবার আগে আমাদের যা আবশ্যক তা হল নিজেদের পবিত্র অপাপবিদ্ধ রূপে অনুধাবন করা। আমাদের বর্তমান আর ভবিষ্যতকে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের সঙ্গে সুগ্রথিত রূপে বাঁধতে হবে। ভাঙা শৃঙ্খল আবার জোড়া লাগাতে হবে। একমাত্র এই জিনিসটাই আমাদের স্বাধীন ভারতের যুবাদের সেবা আর ভক্তির এক নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত করে তুলবে। দেশ মাতৃকার সন্মান আড় গৌরব রক্ষার্থে সব কিছু ত্যাগ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকার চেয়ে বড় জাতীয় ঐক্যের আহবান আর কিছুই হতে পারেনা। ওটাই হল দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ রূপ।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে; সেই অত্যন্ত নির্বিশেষ ভাবটিকে কীভাবে মূর্ত করা যাবে? কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়টিকে যুবশক্তিকে সর্বস্ব ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করবে? সেই প্রবন্ধেই গোলওয়ালকার লিখেন,
‘Such a point of honour in our national life, is none else but MOTHER COW’
“গোমাতাই আমাদের জাতীয় জীবনের সন্মানসূচক ওইরকম একটি বিষয়।“
এইবার পাঠক নিশ্চয় শ্যামল চক্রবর্তীর উচ্চারণ , “আমরা হিন্দুরা গো কে মাতা হিসেবে শ্রদ্ধা করি” বাক্যটিকে রিলেইট করতে পারছেন। শ্যামল চক্রবর্তী আর এস এস প্রধানের সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তার আদর্শিক অবস্থান আর এস এসের ই অবস্থান; সেকারণেই শ্যামল চক্রবর্তী তার সাবেক দল আওয়ামী লীগের উপরও এক হাত নিতে ছাড়েনা। শ্যামল চক্রবর্তীর “আমরা” মানে যে “আর এস এস” এতে কোন সন্দেহ আছে?
গোলওয়ালকার ওই প্রবন্ধেই আরো লিখেন,
“MOTHER COW, the living symbol of the Mother Earth – that deserves to be the sole object of devotion and worship. To stop forthwith any onslaught on this particular point of our national honour, and to foster the spirit of devotion to the motherland, [a] ban on cowslaughter should find topmost priority in our programme of national renaissance in Swaraj”
“গোমাতা ধরিত্রী মাতারই জীবন্ত প্রতীক-তিনি আমাদের একনিষ্ঠ ভক্তি ও পুজার আরাধ্য। আমাদের জাতীয় সন্মানের এই বিশেষ কেন্দ্র বিন্দুটির ওপর যেকোন আক্রমণ এই মুহূর্তে বন্ধ করা, মাতৃভূমির প্রতি ভক্তিভাব লালন করা, গোহত্যা নিষিদ্ধ করা- এইগুলিকে আমাদের স্বরাজের জাতীয় নবজাগরণ কর্মসূচীতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ।“
এই প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ার ১৪ বছর পরে ১৯৬৬ সালে আর এস এস সংসদ অভিমুখে বিশাল এক পদযাত্রা করে গোহত্যা নিষিদ্ধের দাবী জানায়।
লক্ষ্য করুন, গরুকে পবিত্র বলে ঘোষণা করার রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণার উৎসকে জাগরূক রাখা এবং এর জন্য কোন খরচও নেই। মন্দির বানাতে বা বিগ্রহ বানাতে খরচ আছে। কিন্তু হিন্দুত্বের আইকন গরু সব জায়গায় লভ্য এবং এই গরু কেটে খায় মুসলিমেরা, কোরবানিও দেয় সেই গরুকে সংঘাতের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারলে এক অনন্ত হিংসা আর রক্তপাতের পটভুমি তৈরি হবে এবং হয়েছেও সেটা। গোহত্যার বিষয়টিকে একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিবর্তিত করে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্তহীন ঘৃণা জাগরূক রাখা ছিল আর এস এসের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য সাধনে তারা অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে।
আর এস এসের রাজনৈতিক শ্লোগান যখন বাংলাদেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন পরিচালক সেই সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দর্পভরে ঘোষণা করে, তখন সেই ঘোষণাকে তো প্রথমে স্যেকুলারদের প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম স্যেকুলারেরা ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিধ্বনি করা ঘটনাটিতে নিন্দাযোগ্য কিছু খুজে পেলেন না। বরং যারা প্রতিবাদ করলো তাদেরকেই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া হল, এমনকি তাঁদের অভিযুক্ত করা হল যে তাঁরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর পাঁয়তারা করছে। কী কাণ্ড দেখুন।
আর এস এসের মাউথপিস হিন্দুত্ববাদী পাণ্ডার রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের এই অদ্ভুত স্যেকুলাররা। গরুবাদী এই স্যেকুলারেরা গরুকে মাতা ডাকে কিনা জানিনা, তবে তারা যে ঘাস খাওয়া মগজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেটা নিশ্চিত।
তথ্যসূত্র: Guru Golwalkar, “Total prohibition of Cow-Slaughter”, Hitavada, 26th October 1952