ইতিহাস ঐতিহ্য বয়ে বেড়ানো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল
এ আর সুমন: হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত প্রথম পাঁচ তারকা হোটেলের নাম। গত ১৩ সেপ্টেম্বর নতুন করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল নামে উদ্বোধন করা হয়েছে হোটেলটি। গত চার বছর ধরে পাঁচ তারকা এ হোটেলের সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে হোটেলটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। বর্তমানে এ হোটেলে কক্ষের সংখ্যা ২২৬টি। ইতিহাস ঐতিহ্য ঘেরা হোটেলটি শুরুতে ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল নামে, পরে হলো শেরাটন, তারও পরে নাম নিল রূপসী বাংলা, তবে এবার নতুন আবারও ফিরেছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল নাম নিয়ে। যে নামেই আসুক না কেন, মূলত সময়কে ধরে রেখেই হোটেলটি এগিয়েছে সময়ের সাথে ভিন্ন ভিন্ন নামে। কখনো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, কখনো স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ কিংবা ৯০ পরবর্র্তী বিভিন্ন সময়ে সাক্ষী হয়ে আছে এ হোটেল। এ সম্পর্কে জানতে সময়ের কাঁটায় এবার একটু পেছনে ফেরা যাক।
১৯৬৬ সালের গল্প, ঢাকার মিন্টো রোডে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস। প্রথম পর্যায়ে ৩০০টি কামরা নিয়ে হোটেলটি শুরু হয়েছিল। এরপর থেকে বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ছিলেন এ হোটেলে। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এ হোটেলের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইতিহাস বলে, মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এ হোটেল থেকে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এ হোটেল ‘নো ওয়ার জোন’ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তখন এ হোটেলে অবস্থান করেই বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিকরা দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ও বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কেন্দ্রস্থল ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। বাংলাদেশের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ বিশ্বব্যাপী প্রচার করে তাঁদের অনেকেই তখন স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব-জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক মার্ক টালি ও সাইমন ড্রিং, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) পাকিস্তান ব্যুরোর প্রধান আর্নল্ড জেইটলিন ও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদক ডেভিড গ্রিনওয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালের ৯ জুন ও ১১ আগস্ট এখানে দুটি সফল গেরিলা অপারেশন চালানো হয়।
১৯৮৪ সালে হোটেলটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় এবং স্টারউড এশিয়া প্যাসিফিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হতে থাকে। স্টারউড এশিয়া প্যাসিফিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস ২০ বছরের জন্য হোটেলটি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তখন হোটেলটির নাম পরিবর্তন করে ঢাকা শেরাটন হোটেল রাখা হয়। স্টারউডের ব্র্যান্ড নেম শেরাটনের সঙ্গে মিলিয়ে। চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে স্টারউড ২০১১ সাল পর্যন্ত হোটেলটি পরিচালনা করে। চুক্তির মেয়াদকাল শেষ হওয়ার পর ১৯ আগস্ট ২০১১ হোটেলটির মালিকানার সঙ্গে পরিচালনারও দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড (বিএসএল)। এটি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। আর হোটেলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো হোটেল রূপসী বাংলা। বিএসএল সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপের (আইএইচজি) সঙ্গে বিএসএলের আবারও চুক্তি সম্পাদিত হয়। ওই চুক্তির আওতায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সংস্কারের জন্য হোটেলটি বন্ধ রাখা হয়।
বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষে ৬০ বছরের পুরনো ভবন সংস্কারের মাধ্যমে নতুন আঙ্গিকে এসেছে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেল ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা’। অবকাঠামোগত পরিবর্তন এনে যুক্ত করা হয়েছে দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মোগল স্থাপত্যশৈলীর আবহ। নতুন কন্টিনেন্টালে কী থাকছে বিশেষ? প্রশ্নটা সাধারণত সবারই! হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাঁচ তারকা হোটেলে যেসব সুবিধা রয়েছে, সবই থাকবে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকায়।
ইন্টারকন্টিনেন্টাল গ্রুপের বিপণন ও যোগাযোগ পরিচালক সাহিদুস সাদিক জানান, ‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার অতিথিদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থাকছে। এর মধ্যে রয়েছে মিনি বার, ইন-রুম চা-কফির সেবা, জামাকাপড় ইস্ত্রির সুবিধা, জাতীয় দৈনিক, ইলেকট্রনিক নিরাপত্তা, উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ, এক্সপ্রেস চেক ইন, বিজনেস সেন্টার, ওয়াইফাই ইন্টারনেট, এক্সিকিউটিভ ক্লাব লাউঞ্জ, ব্যবসা কেন্দ্র, মিটিং কক্ষ, উপহারের দোকান, গাড়ি ভাড়া, লিমুজিন ও এয়ারপোর্ট শাটল সার্ভিস, ফিটনেস সেন্টার, সুইমিংপুল এবং বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের দিকনির্দেশনা সংবলিত গাইড বই।’
পর্যটন ও আতিথেয়তা সেবা খাতে নতুন আঙ্গিকে সাজানো হয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টালকে। রাজধানীর বাকি পাঁচ তারকা মানের হোটেলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হোটেলটি সংস্কার করা হয়েছে। সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রতিটি রুমের আকারের পাশাপাশি বিন্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। আগে রাজকীয় প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট ৬টি থাকলেও এখন করা হয়েছে ৫টি। পরিবর্তনের ক্ষেত্রে স্যুট রুম ছাড়াও ডিলাক্স রুমগুলোর আয়তন আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে হোটেলে অতিথিদের জন্য ২৭০টি রুম ছিল। সেগুলোকে ভেঙে এখন করা হয়েছে ২২৬টি। প্রতিটি রুমের আয়তন ছিল ২৬ বর্গমিটার। বড় করার ফলে একেকটি রুমের আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪০ বর্গমিটার। নতুন টাইলস, আধুনিক স্যানিটারি উপকরণসহ প্রতিটি রুমের বাথরুমে থাকছে নতুন বাথটাব। রুমভেদে ৩২ ইঞ্চি থেকে শুরু করে ৪৮ ইঞ্চি টিভি রাখা হয়েছে। বাইরের ফুলগাছ থেকে শুরু করে ভেতরের আসবাবে রয়েছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। নতুন অবকাঠামোতে সুইমিংপুল নিয়ে যাওয়া হয়েছে হোটেলের ছাদে। এটি এখন হয়ে উঠেছে বিশালাকারের ‘ইনফিনিটি সুইমিং পুল’। থাকছে অত্যাধুনিক স্পা, জাকুজ্জি ও পুলসাইড বার। আগে বলরুম ও উইন্টার গার্ডেনসহ মিটিং রুমগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। সংস্কারের মাধ্যমে ২১ হাজার বর্গফুটের মধ্যে থাকবে মোট ৯টি হল। এগুলোর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে আগের গ্র্যান্ড বলরুমকে দু’ভাগ করে ‘রূপসী বাংলা উইন্টার গার্ডেন-১’ ও ‘রূপসী বাংলা উইন্টার গার্ডেন-২’ রাখা হয়েছে। আগের বলরুমের জায়গায় স্থান পেয়েছে রান্নাঘর। আছে পাঁচটি সুসজ্জিত রেস্তোরাঁ।
উল্লেখ্য, পৃথিবীর প্রায় একশটি দেশে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপ (আইএইচজি) হোটেল ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ গ্রুপের টপ ব্র্যান্ড হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। বর্তমানে ৬০টি দেশে এ ব্র্যান্ডের ১৮০টি হোটেল পরিচালিত হচ্ছে। আইএইচজির অন্য ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক্রাউন প্লাজা, হলিডে ইন, হলিডে ইন এক্সপ্রেস, ক্যান্ডেলউড সুইট, হোটেল ইনডিগো, কিম্পটন হোটেল প্রভৃতি। এ গ্রুপের ছয় হাজারেও অধিক হোটেল রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।