কর্ডোভা নগরী ও ইউরোপে নব জাগরণ

সৈয়দ মুহম্মদ জুলকরনাইন: ফ্রান্স সীমান্ত অতিক্রম করতেই Basque Country এলাকা শুরু। এ অঞ্চলের মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রত্যেককে চমৎকৃত করে। আমরা অতিক্রম করে চলেছি পিরেনিজ (Pyrenee) পর্বতমালা। ১১ হাজার ১৬৮ ফুট উচ্চতা ও ৪৯১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ পর্বতমালা ফ্রান্স ও স্পেনের বিভাজক যা বিস্কে উপসাগর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। সকালে আমাদের গাড়ি চালাতে কষ্ট হচ্ছিল ঘন কুয়াশার জন্য। কিছুক্ষণ পরে বুঝলাম, ওগুলো মেঘ। পাহাড়ি পথ এত মসৃণ এবং সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত যে, প্রায় বারো শ’ ফুট উচ্চতায় গাড়ি চালালেও অনুভূত হয়নি, আমরা এত উপরে উঠলাম কী করে। পিরেনিজ পাড়ি দিতে ভাবছিলাম ইসলামের সেই মহান বীর সেনানীদের কথা, যারা অষ্টম শতাব্দীতে ফ্রান্স অভিযানকালে এ দুর্জেয় পর্বতমালা অতিক্রম করেছিলেন। পাহাড় আর পাহাড়। এক পাহাড় শেষ হলে মনে হয় এবার বুঝি সমতল। কিন্তু ওই যে আবার সামনের উঁচু পাহাড়। চাচাকে (জনাব মুহাম্মদ আব্দুল করিম, সাবেক মুখ্য সচিব) বললাম, ওই পাহাড় হয়তো আমাদের পাড়ি দিতে হবে না। চাচা হেসে বলেন, আমরা ওই পাহাড়েই উঠে যাচ্ছি। আমাদের গাড়ির গতিসীমা ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ওঠানামা করছে। পাহাড়ি অঞ্চলশেষে সমতলের দিকে এগিয়ে যেতে রাস্তার অদূরে বহুতল আবাসিক ভবন। জার্মানি, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সে বারান্দায় কাপড় শুকানো দেখিনি। কিন্তু এখানে তা চোখে পড়াতে তানিয়াকে (চাচার জ্যেষ্ঠ কন্যা) বললাম, দেখ! বাংলাদেশের নমুনা।’ তানিয়ার উল্টো প্রশ্ন, আরব দেশে কি দেখেননি? বললাম, দেশের কথা বেশি মনে পড়ে। তাই একটু সাদৃশ্য খুঁজে পেলেই- পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকি না কেন- মন চলে যায় সেখানে।

মসজিদ ও গির্জাখ্যাত এ ঐতিহাসিক কীর্তি দেখার জন্য হাজারো পর্যটক কর্ডোভাতে ভিড় জমিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানিদের সংখ্যা বলে বেশি প্রতীয়মান হয়েছে। UNESCO বিশ্বের প্রাচীন দর্শনীয় স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে এ স্থাপনাটিকে।

১৯৯৮ সালের ২৬ অক্টোবর ৫ ঘণ্টা পিরেনিজ পর্বতমালায় ওঠানামা করে বেলা ২টায় মাদ্রিদে পৌঁছি। মাদ্রিদে রাজপরিবারের সরকারি বাসভবন ‘প্যালাসিও রিয়াল’এর পূর্বদিকে বয়ে চলা Rio Manganese নদীর তীরে অবস্থিত মাদ্রিদ নগরী প্রতিষ্ঠিত হয় খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে। ৬০৪.৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে স্পেনের রাজধানী খুবই সুন্দর, পরিপাটি ও সাজানো। সবগুলো বিল্ডিং প্রায় একই মডেলের। টাইল দিয়ে তৈরি ছাদের বিল্ডিংগুলো দেখতে মনে হয়, সদ্যনির্মিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৪৬ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এ নগরীর লোক সংখ্যা তিন মিলিয়নের বেশি। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার সদর দফতর ছাড়াও দেখার মতো কয়েকটি জাদুঘর রয়েছে এখানে।

আমরা ম্যাকডোনাল্ডে লাঞ্চ সেরে বিকেলের দিকে কিছুটা ঘোরাঘুরি করার সুযোগ পেয়েছি। ২৬ তারিখ মাদ্রিদেই রাত যাপন। পরের দিন আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল সেভিলার (Sevila) দিকে রওনা দিই। কুয়াশাচ্ছন্ন সড়কে হেড লাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। A4 হাইওয়ে ধরে স্পেনের উত্তর থেকে দক্ষিণে পাড়ি দিচ্ছি। মাদ্রিদ থেকে সেভিলা যাওয়ার পথে আমরা Aranjuez, Bailen, Manzanares, Cordova হয়ে যাবো। কর্ডোভা নগরী বর্তমান আন্দালুসিয়া প্রদেশের পর্তুগাল এবং সুইজারল্যান্ডের চেয়ে বড় আন্দালুসিয়া প্রাকৃতিক রূপে সজ্জিত। বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী আন্দালুসিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করেছে Guadial Quiver নদী। জানা গেছে, এর মূল নাম ওয়াদিয়াল কবীর নামে অতীতে পরিচিত ছিল। সমগ্র প্রদেশজুড়ে সুশোভিত বৃক্ষরাজি। বিশেষ করে বিস্তীর্ণ এলাকার জলপাই উদ্যান দেখে বুঝতে অসুবিধে হয়নি স্পেনের অলিভ অয়েল কেন বিশ্ববিখ্যাত। স্পেন প্রতি বছর আট লাখ টন অলিভ বা জলপাইয়ের তেল বিশ্বের বাজারে রফতানি করে থাকে। পূর্ব-পশ্চিমে বয়ে চলা Guadial Quiver আন্দালুসিয়াকে যেন তার সবটুকু উজাড় করে দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে।

কর্ডোভা মসজিদের অভ্যন্তরে কিছু স্থানে মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ আরবি আয়াতে কারিমা উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে এখনো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সে সময়ের আরব নির্মাণশৈলী ও আভিজাত্যের কথা। এক সময়ে যে মসজিদের মিনারে ধ্বনিত হতো আজানের বাণী, সেখানে আজ বাজানো হচ্ছে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় গির্জার ঘণ্টা।

আগেই প্রোগ্রাম করা ছিল, মাদ্রিদ-সেভিলা ৫৩৮ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে কর্ডোভা গিয়ে দুপুরের খাওয়া ও বিরতি হবে। তাই মাদ্রিদ থেকে পথ চলতে চলতে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে আন্দালুসিয়াতে প্রবেশ করি এবং এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর আমরা গিয়ে পৌঁছি কর্ডোভা নগরীতে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রোমান রাজকর্মচারী Claudius Marcellus-এর হাতে খ্রিষ্টপূর্ব একশত ঊনসত্তরে। তখন এ নগরীর লোকসংখ্যা ছিল তিন লাখ। পরিপূর্ণ নগরীর মর্যাদা ও খ্যাতি লাভ করে বিশ্ব দরবারে কর্ডোভা পরিচিতি পায় মুসলিম খেলাফতের সময়ে। মুসলিম শাসনের আগে স্পেন বিভিন্ন জাতি দ্বারা শাসিত হয়েছে। যেমন- রোমান, ভ্যানডালস, বারবার ও গথ। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে স্পেনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। জনগণ চরম সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছিল। কৃষক ও শ্রমিকসহ মেহনতি মানুষের কোনো ধরনের স্বাধীনতা ছিল না। রাজা কর্তৃক জনগণ নির্যাতিত হয়ে এর থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল। এ সময় সিউটার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান এবং উত্তর আফ্রিকার গভর্নর মুসা বিন নুসাইর স্পেনে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেন। অতঃপর ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিল মূসা মুর সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন অভিযানে সেনাদল প্রেরণ করেন। কাউন্ট জুলিয়ান চারটি জাহাজ দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। ওই জাহাজে করেই তারিক ১৪ মাইল সুদীর্ঘ জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করেছিলেন এবং ১৯ জুলাই ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে স্পেন জয়ে সক্ষম হন।

১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ফার্ডিন্যান্ডের সময়ে স্পেনে পুনরায় উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান রাজত্ব কায়েম করার অংশ হিসেবে কট্টর ক্যাথলিক রাণী ইসাবেলার নির্দেশে মসজিদকে গির্জায় পরিণত করা হয়। তবে গ্রাছিয়াছ (ধন্যবাদ) স্পেন সরকারকে অন্যান্য মসজিদের মতো গুঁড়িয়ে না দিয়ে কর্ডোভা মসজিদের অবকাঠামো ও পুরনো কীর্তি সংরক্ষণ করার জন্য।

আরোহণের ওই স্থানটি বর্তমানে ‘জাবালুত তারিক’ বা তারিকের পাহাড়, তথা আধুনিক ‘জিব্রাল্টার’ নামে খ্যাত। ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের শেষ গথিক শাসক রডারিককে Guadalete যুদ্ধে পরাজিত করে স্পেনে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ফলে শুধু আইবেরীয় উপদ্বীপে নয়, বরং সমগ্র ইউরোপে নবজাগরণের সৃষ্টি হলো। সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে এবং ঘৃণ্য ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়। স্পেনের জনগণ পেয়েছিল সামাজিক সুবিচার। প্রচারিত হয় সাম্যের বাণী। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম খেলাফতের সময় কর্ডোভা এমন উন্নত হয়ে ওঠে যে, দশম শতাব্দীতে ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র এবং Jewel of the world নামে পরিচিতি লাভ করে। সে সময় প্যারিস নগরীতে বসবাসকারী লোকসংখ্যা মাত্র ৩৮ হাজার হলেও চিত্তগ্রাহী কর্ডোভার জনসংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ। সুন্দর, পরিপাটি ও নান্দনিক এ নগরীর রাজপথে বাতি জ্বলেছে প্যারিস ও লন্ডনের ও ৭০০ বছর আগে। প্রায় এক হাজার মসজিদ, ছয় শ’ গণশৌচাগার এবং চার লাখ বইসহ ৭০টি সুবৃহৎ লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করে তোলে কর্ডোভাকে। গোয়াদিয়াল কুইভার নদীবিধৌত এ শহরেই জন্ম নিয়েছেন বিশ্ববরেণ্য চিকিৎসক, কবি ও গবেষক। তন্মধ্যে দার্শনিক Seneca, কবি Lucan, Maimonides উল্লেখযোগ্য। La Mezquita Catedral বা Mosque Cathedral ঐতিহাসিক কর্ডোভার একটি প্রধান বিষয়।

৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম আমির প্রথম আবদুর রহমান আদ-দাখিল বিশ্ববিখ্যাত কর্ডোভা জামে মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু করেন। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শৈল্পিক নিদর্শন, মসজিদটি দেখলে মুসলিম শাসকদের রুচি, মনন ও সৃষ্টিশীলতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। মসজিদ ও গির্জাখ্যাত এ ঐতিহাসিক কীর্তি দেখার জন্য হাজারো পর্যটক কর্ডোভাতে ভিড় জমিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানিদের সংখ্যা বলে বেশি প্রতীয়মান হয়েছে। UNESCO বিশ্বের প্রাচীন দর্শনীয় স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে এ স্থাপনাটিকে। ৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় আবদুর রহমান কর্তৃক মসজিদের সম্প্রসারণসহ মিনার নির্মাণ করার পর ৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় হাকাম মূল পরিকল্পনার সংস্কার করে দীপ্তিমান মেহরাবের অলঙ্করণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার ফলে এর আকর্ষণ বহুলাংশে বেড়ে যায়। কর্ডোভা মসজিদের অভ্যন্তরে কিছু স্থানে মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ আরবি আয়াতে কারিমা উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়িয়ে এখনো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সে সময়ের আরব নির্মাণশৈলী ও আভিজাত্যের কথা। এক সময়ে যে মসজিদের মিনারে ধ্বনিত হতো আজানের বাণী, সেখানে আজ বাজানো হচ্ছে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় গির্জার ঘণ্টা। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ফার্ডিন্যান্ডের সময়ে স্পেনে পুনরায় উগ্রপন্থী খ্রিষ্টান রাজত্ব কায়েম করার অংশ হিসেবে কট্টর ক্যাথলিক রাণী ইসাবেলার নির্দেশে মসজিদকে গির্জায় পরিণত করা হয়। তবে গ্রাছিয়াছ (ধন্যবাদ) স্পেন সরকারকে অন্যান্য মসজিদের মতো গুঁড়িয়ে না দিয়ে কর্ডোভা মসজিদের অবকাঠামো ও পুরনো কীর্তি সংরক্ষণ করার জন্য।
লেখক: রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button