উপমহাদেশের বাংলা চলচ্চিত্রে নির্বাক ও সবাক যুগ

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল: অবিভক্ত ভারতের প্রথম সবাক ছবি আলম আরা’ ১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ বম্বের ম্যাজিস্ট্রিক সিনেমা হলে মুক্তি পায়। ভারতীয় প্রথম সবাক ছবির পথিকৃৎ ‘আলম আরার’ নির্মাতা ছিলেন এম ইরানী।
১৮৯৫ সালে পাশ্চাত্যে চলচ্চিত্রের জন্ম হয়েছিল আমেরিকায়। ১৮৯৬ সালে প্যারিস, নিউইয়র্ক, লন্ডন প্রভৃতি ইউরোপীয় শহরে সর্বপ্রথম জনসাধারণের সম্মুখে ছায়াছবি প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। আমাদের এই উপমহাদেশে ১৮৯৭ সালে হীরালাল সেন সর্ব প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনী শুরু করেন কোলকাতা ও অন্যান্য স্থানে। আমাদের বাংলাদেশের ঢাকা জেলার অদূরে মানিকগঞ্জের (বর্তমান জেলা) বগজুরী গ্রামে ১৮৬৬ সালে হিরালাল সেন জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের এই বাঙালি চলচ্চিত্রকারকে সারা ভারতবর্ষের উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক বলে গণ্য করা হয়। এটি বাংলাদেশের জন্য কম গৌরবের ব্যাপার নয়।
১৮৯৮ সালে জনৈক আমেরিকান ব্যবসায়ী চিত্র প্রদর্শনের জন্য কোলকাতায় আসেন। তাঁর কাছ থেকেই এই বাঙালি আলোকচিত্র শিল্পী হীরালাল সেন একটি ফিল্ম প্রজেক্ট ক্রয় করেন। এই প্রজেক্ট দিয়ে তিনি কোলকাতার আশপাশে ও ভোলার এসডিও ডাক বাংলার সন্নিকটে কয়েকটি চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানী নামে তিনি একটি চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানও সে সময়ে গড়ে তোলেন। উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়ন কালেই তিনি ছবি তৈরির কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। হীরালাল সেন এই বিদেশী কলাকুশলীর সহকারী হিসেবে প্রথম কাজ শুরু করেন এবং তার কাছ থেকে কিছুকাল কাজ শেখার পর তিনি নিজেই পরবর্তীতে একটি ক্যামেরা তৈরি করেন (মুভি ক্যামেরা ক্রয় করার তার অর্থ ছিল না) এবং ওই ক্যামেরা দিয়েই তিনি প্রথম ছবি তৈরির কাজ শুরু করেন। সে সময় ‘আলিবাবা’ নাটকের কয়েকটি দৃশ্য তিনি গ্রহণ করেন। নাটকের মাঝখানে এই দৃশ্যগুলো দেখানো হতো। এই শর্টগুলো ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র তৈরির প্রয়াস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। হীরালাল সেন ১৯০০ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ৪০টির মতো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৯১৭ সালে কলকাতায় মারা যাবার আগ পর্যন্ত তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হীরালাল সেনের পর জ্যোতিষ চন্দ্র সরকার নামক একজন বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি সে সময় ভারতীয় স্বনামধন্য রাজনীতিবিদ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোাপাধ্যায় পরিচালিত “অ্যান্টি পার্টিশন ডে” এর শোভাযাত্রাটির ছবি তুলেছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের এভাবেই প্রথম সূত্রপাত হয়। পরবর্তীতে ভারতের প্রথম নির্বাক কাহিনী চিত্র তৈরি করেন বোম্বাইয়ের ডিজি ফালকে। ছবিটির নাম ছিল ‘হরিশচন্দ্র’। ছবিটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩৭,০০০ ফুট। এটি ভারতীয় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক ছবি। ১৯১৩ সালে মোম্বাইয়ের করোনেশন সিনেমা হলে ‘হরিশচন্দ্র’ ছবিটি মুক্তিলাভ করে। এই ছবিতে স্ত্রীর ভূমিকায় পুরুষ শিল্পীদের অভিনয় করতে হয়েছিল। কারণ তখনকার আমলে মহিলা শিল্পীদের ছবিতে অভিনয় করাটা রীতিমতো অসম্মানজনক বলে মনে করা হতো।১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ফালকে ২৩টি নির্বাক ছবি তৈরি করেন। ডিজি ফালকের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতার জে. এফ ম্যাডান ভারতের চিত্রগৃহ স্থাপনাকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯১৭ সালে তার প্রথম নির্বাক ছবি “নলদময়ন্তী” মুক্তিলাভ করে। ঠিক এ সময়ই দুজন বাঙালি ব্যবসায়ী চিত্র প্রযোজনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এরা হলেন অনাদি নাথ বসু ও এন সি লাহিড়ি। কলকাতার প্রথম চিত্রগৃহ নির্মাণ করেন জে.এফ ম্যাডান। চিত্রগৃহটির নাম ছিল ‘এনফিনা স্টোন পিকচার প্যালেস’ বর্তমান মিনার্ভা সিনেমা হল।

ভারতের প্রথম সবাক চিত্র “আলম আরা” ১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ বোম্বের ম্যাজিস্ট্রিক সিনেমা হলে মুক্তি লাভ করে সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ছবিটি প্রযোজনা করেন আরদেশীয় এম ইরানী। কলকাতার ম্যাডান থিয়েটার্স, বোম্বের কৃষ্ণ ফিল্ম কোম্পানি ও ইমপেরিয়াল মুভি টোন সর্বপ্রথম উপমহাদেশে সবাক কাহিনী চিত্র নির্মাণের উদ্দ্যেগ নেন। শেষ পর্যন্ত প্রথম সবাক কাহিনী চিত্র নির্মাণে সক্ষম হন ইমপেরিয়াল মুভি টোন।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ‘আলম আরা’ মুক্তির ঠিক এক মাস আগে ১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সবাক চিত্রের ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ রেখেছিলেন কলকাতার জে এফ ম্যাডান কোম্পানি। প্রখ্যাত মুন্নি বাঈয়ের একটি গান সবাক চিত্রের মাধ্যমে উপহার দিয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটি। এই সঙ্গীত চিত্রটি দেখানো হয় তৎকালীন কলকাতার ক্রাউন হলে। শুধু তাই নয় আলম আরার মুক্তির তারিখেই (১৪ মার্চ ১৯৩১ সাল) ম্যাডান কোম্পানি আরো একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য পাঁচ মিশালী সবাক ছবি উপহার দেন ওই ক্রাউন হলেই।
১৯৩১ সালের ১১ এপ্রিল জেএফ ম্যাডান কোম্পানির প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা সবাক চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’ ক্রাউন সিনেমা হলে মুক্তিলাভ করে। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বাংলা সবাক কাহিনী চিত্র। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন অমর চৌধরী। এই বছরই নিউ থিয়েটার্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠা হয় এবং এই নব প্রতিষ্ঠানের প্রথম সবাক ছবি “দেনা পাওনা” ১৯৩১ সালের ২৪ ডিসেম্বর চিত্রায় মুক্তি পায় (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের)। এ বছরেই আরো কয়েক মাসের মধ্যে ম্যাডান কোম্পানি আরো ৩টি পূর্ণাঙ্গ সবাক চিত্র ‘জোর বরাত’, ‘ঋষির প্রেম’, ‘প্রহ্লাদ’ ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের কৌতুক চিত্র ‘তৃতীয় পক্ষ’ উপহার দিয়ে সবাক ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেন। এমনিভাবেই বাংলা সবাক ছবির সূচনা হয়েছিল ম্যাডান কোম্পানি সৌজন্যে। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ম্যাডানের তোলা ছবির সংখ্যা ছিল ৬১ (বাংলা ১০ ও হিন্দি ৫১)।
বাংলা ছবি ও প্রবন্ধের প্রধান বিষয়বস্তু হলেও কলকাতায় নিউ থিয়েটার্স প্রযোজিত নির্মাণাধীন প্রথম দশকের কয়েকটি হিন্দি ছবির কথা না বললে আলোচনা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিরিশ দশকে অভিনীত ধীরেন গাঙ্গুলীর ‘নাইট গার্ড’ এআর কারদার পরিচালিত ‘সুলতান’ ও ‘বাঘী সিপাহী’ এবং মধু বসু পরিচালিত ‘সেলিমা’ হিন্দি ছবি বিশেষ ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নির্বাক ছবির যুগে বাঙালি অনাদি বসু মফস্বল শহরে মোবাইল সিনেমার মারফত ছবি দেখানো প্রথম প্রবর্তন করেন। বাঙালি শিল্পীদের নিয়ে তিনি ১৯১৮ সালে পূর্ণাঙ্গ বাংলা নির্বাক ছায়াছবি ‘রত্নাকর’ তৈরিতে মনোনিবেশ করেন।
নির্বাক ছবির ক্ষেত্রে প্রযোজকদের অভাব না থাকলেও সবাক ছবির প্রথম যুগে অর্থনৈতিক কারণে বিশেষ কেউ চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসেন নি। তাই প্রথম দু’বছর ম্যাডান ও নিউ থিয়েটার ছাড়া কলকাতার চিত্র জগতে আর কেউই এগিয়ে আসেন নি ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে। সবাক চিত্র ‘আলম আরা’ তৈরি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৮৭ বছর আগে বোম্বাইয়ে। ছবিটির পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন আর দেশীয় এম ইরানী। ছবিটির অভিনেত্রী ও অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন কাজী জুবাইদা (সবাক চিত্রের প্রথম নায়িকা), পৃথ্বিরাজ মাস্টার ভিত্থল (সবাক চিত্রের প্রথম নায়ক), সুশিলা, জগদীশ শেঠী, বলভিন প্রসাদ, জিল্লু বাঈ প্রমুখ। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন ওবি ইরানী ও ফিরোজ শাহ মিস্ত্রি, প্রযোজনায় ছিলেন ইমপেরিয়াল মুভিটোন (বোম্বে)। কাহিনীকার: যোশেভ ডেভিড। ছবিতে নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ৪০ হাজার রুপি। মুক্তি পেয়েছিল ১৪ মার্চ ১৯৩১ সালে বোম্বের ম্যাজিস্ট্রিক সিনেমা হলে। গানের সংখ্যা ছিল ১০, গায়ক ছিলেন ডবলিউ এম খান (পাঠান)। তিনি ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বপ্রথম সবাক ছবির কন্ঠ সঙ্গীত শিল্পী। আলম আরা উর্দূ ও হিন্দি মিশ্রিত ১০ টি সম্বলিত গানে অভিনীত হয়েছিল। চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে দশ হাজার ফুট। আলম আরা প্রথম রজনীতে অভিনয়ের সময় প্রেক্ষাগৃহে টিকিটের জন্য প্রবল দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়েছিল। ্আলম আরা জুবাইদা ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ৩৬টি নির্বাক এবং ২১ টি সবাক চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন। তার অভিনীত ছবিগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হয়েছিল প্রথম ভারতীয় সবাক চিত্র আলম আরা, শুভদ্রাহরণ, মেরবাঈ। আলম আর ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন মাস্টার ভিত্থল।
অভিনেত্রী রানী জুবাইদা ধনরাজ খাঁর বোম্বের ব্লিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ১৯৮৮ সালে ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। (জন্ম ১৯১১ মৃত্যু ১৯৮৮ খ্রি.)।

অবিভক্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৩১ সালে ২০১ টি সবাক চিত্র সারা ভারতবর্ষে এবং হিন্দি সবাক চিত্র নির্মিত হয় ২৩টি। তন্মধ্যে ৮টি তৈরি করেন কলকাতা ম্যাডান কোম্পানি। চলচ্চিত্র সবাক হওয়ার পর এর চাহিদা ও জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায় সাংঘাতিকভাবে এবং নির্বাক চিত্র দ্রুত বিলুপ্ত ঘটে। ১৯৩২ সালে এক বছরে কমে গিয়ে নির্বাক ছবির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ তে। ১৯৩৩ সালে কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৪১ টি। ১৯৩৪ সালে মাত্র ৭ টি নির্বাক চিত্র তৈরি হয় এবং ১৯৩৫ সাল থেকে নির্বাক চিত্র নির্মিত সর্ম্পূণভাবে লুপ্ত হয়ে যায়।
তিরিশ দশকে চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি ছিলেন মাস্টার নিশার ও জাহানারা আজ্জন। চল্লিশ দশকে সর্বাধিক জনপ্রিয় জুটি ছিলেন অশোক কুমার ও লীলা চিটনীশ। পঞ্চাশ দশকে জনপ্রিয় স্টার ছিলেন রাজকাপুর, নার্গিস ও দীলিপ কুমার। ‘পুরাণ ভগত’ ছবিতে পরিচালক দেবকী কুমার বসু চলচ্চিত্রে নেপথ্যে সঙ্গীত প্রবর্তন করেন। এতে সে আমলে চলচ্চিত্র আরো প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয় ও সজীব হয়ে ওঠে।
সবাক ছবির প্রথম দশকেই দেবকী কুমার বসু, সুশীল মজুমদার, প্রমথেশ বড়ুয়া, প্রফুল্লা রায়, চারু রায়, কেদার শর্মা, ডি শান্তারাম, মধু বসু, ফণী মজুমদার, নীতিন বসু প্রমুখ যশস্বী পরিচালক ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্র জগৎকে গৌরবের আসনে অলঙ্কৃত করেন। চিত্রতারকাদের মধ্যে সাধনা বসু, কানন দেবী, চন্দ্রাবতী, উমা শশী, দেবীকা রানী, গহরজান, মায়ারানী, যমুনা সিংহ, মলিনা দেবী, পৃথি¦রাজ, দুর্গাদাস, পাহাড়ি স্যান্নাল এবং কুন্দ লালসায়গল তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে ছিলেন। সঙ্গীত জগতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন রাইচাদ বড়াল ও তার সহকারীরা। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তাঁরা সে সময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। সে আমলে সবাক যুগের শ্রেষ্ঠ ১০ টি ছবির নাম করা যেতে পারে। ছবিগুলো হলো- চন্ডিদাস (১৯৩২), দেবদাস (১৯৩৫), গৃহদাস (১৯৩৬), আলীবাবা (১৯৩৭), মুক্তি (১৯৩৭), বিদ্যাপতি (১৯৩৮), গোরা (১৯৩৮), দেশের মাটি (১৯৩৮) ও অধিকার (১৯৩৯)।
বাংলা ছায়াছবির পুরাতন ঐতিহ্যের সঙ্গে যারা সম্যক পরিচিত নন, তাদের অনেকের ধারণা সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালীর’ আগে এদেশে কোন উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয় নি। তাদের ধারণা যে, অলীক ও ভ্রান্ত উপরের ১০টি ছবিতে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলবে।
দেবকী বসু পরিচালিত চন্ডিদাশ ও প্রমথেম বড়ুয়া পরিচালিত দেবদাস ও গৃহদাস সাহিত্যের সঙ্গে সে যুগে সিনেমার এক সেতুবন্ধন ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছিল। এই দুটি ছবিতেই বড়ুয়ার প্রতিভার স্বাক্ষর আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। সুদক্ষ ফটোগ্রাফার যখন পরিচালকের দায়িত্ব নেন তখন চলচ্চিত্র যে কতখানি বাস্তবধর্মী রূপ পরিগ্রহ করে নীতির বসু পরিচালিত প্রত্যেকটি ছবিতে তার প্রমাণ সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। তাঁর তৈরি ‘ভাগ্যচক্র’ ছবিতেই প্রথম প্লেব্যাক প্রথার প্রবর্তন হয়। তাঁর ‘দেশের মাটি’ ছবিটি সে যুগের সিনেমা দর্শকদের কাছে এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছিল। বিদেশী ছবির জগতে প্রথম সবাক যুগে যেমন নৃত্যগীতের বাহুল্য থাকতো বর্তমান সবাক চিত্রে এখনো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘আলম আর’ ছবিতে গান ছিল প্রায় এক ডজন। শিরি-ফরহাদে ৪০টি গান ও হিন্দি ছবি ইন্দ্রসভাতে ৪২ টি গানের ডালি উপহার দিয়ে সে যুগে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য এ কথা নিঃসংশয়ে বলা চলে যে ভারতীয় সবাক চিত্রের জনপ্রিয়তার মূলে সঙ্গীতের অবদান মোটেই উপেক্ষণীয় নয়।
তিরিশ দশকে দেবকী বসু পরিচালিত ‘চন্ডিদাশ’ ছবিটি সুষ্ঠু সমম্বয়ে পরিচ্ছন্ন এক কাব্যিক পরিবেশ গড়ে দর্শকের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছিল। এই ছবিতে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্রে আবহ সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়ে এক নব দিগন্তের দ্বার খুলে দেয়। তিরিশ দশকে আরো যেসব বাংলা ছবি তৈরি হয়েছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নরেশ মিত্র পরিচালিত রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ এবং মধু বসু পরিচালিত ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘আলীবাবা’। এই ছবি দুটি সে যুগের দর্শকদের বিশেষভাবে পরিতৃপ্ত করেছিল। ঠিক এট সময়ই ঠিকাদার ছবিটিও ভারত লক্ষ্মী পিকচার্স যথেষ্ট চমক সৃষ্টি করেছিল। ছবিটির পরিচালনায় ছিলেন প্রফুল্ল রায়।
১৯৩৪ সালে ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম ভারতীয় ছবি প্রদর্শিত হয়। দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ‘সীতা’ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে ছবিটি ‘ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের’ পুরস্কার লাভ করে।
এটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ভারতীয় ছবির উপমহাদেশের সর্বপ্রথম স্বীকৃতি ও সম্মান। ১৯৫৫ সালে প্রদর্শিত সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাচালী’ ভারতীয় চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে অলঙ্কৃত করে। নানা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি বহু সম্মানে ভূষিত হয়।
আজকের চলচ্চিত্র শিল্প আমাদের বহু সমস্যা ও সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত। বিগত ৮৭ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা (১৯৩১ সালে সবাক চিত্র আলম আরা মুক্তি পায়) করলে দেখা যাবে- অবিভক্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্প বছরের পর বছর শুধু গৌরবোজ্জ্বল সম্মানের দিকে ধাবিত হয়েছে। শত বাঁধা বিপত্তি তাকে ব্যাহত করতে পারেনি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button