হজ : অব্যক্ত প্রেমের প্রতীক
মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ:
প্রাচীনকালের মানুষ ছিল প্রযৌক্তিক উন্নতিবঞ্চিত। আজকের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির কথা তাদের কল্পনাশক্তির ধারেকাছেও এসেছিল কিনা সন্দেহ হয়। সে যুগের মানুষ বিবেক-ঊর্ধ্ব বিস্ময়কর কোনো কিছু দেখলে সেটাকে মুজিজা মনে করে বসত। মনে করত, এ কাজ একমাত্র ঐশী শক্তির মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। এ কাজ মানুষের সাধারণ শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি পানির ওপর চলত অথবা বাতাসে চড়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেত, তখন মানুষ মনে করত, এটি বিরাট মুজিজা। সুতরাং মানুষের হৃদয়ে সে ব্যক্তি ও তার কাজের মান এবং মূল্য বেড়ে যেত বহুগুণে। তারা তাকে সাধারণ মানুষের পোশাকে অসাধারণ মানুষ মনে করত। কিন্তু আজ, প্রযুক্তির ভরাযৌবনে, বিস্ময়কর ও বিবেকচমকানিয়া কাজের প্রকার ও প্রকৃতি পাল্টে গেছে। মুজিজা ও কারামাতের নতুন মাপকাঠি আবিষ্কার করেছে আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এমন বহু কাজ যেগুলোকে পুরনো যুগে অলৌকিক ও অসাধারণ মনে করা হতো, সেগুলো এখন জ্বলন্ত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। সেগুলো এখন মানুষী শক্তির খুব নাগালে এসে পৌঁছেছে। মানুষ এখন সেসব কাজ খুব সহজ ও সাধারণভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম। হজ সত্যিই একটি বড় মুজিজা। মুজিজা আবার এক জিনিসের নয়, একই সঙ্গে বহু জিনিসের : প্রেম-ভালোবাসার, একতার, একতায় বৈচিত্র্যের, নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং আরও বহু কিছুর।
চিন্তা করে দেখুন, একজন হাজী হেরেমের সীমায় প্রবেশ করার আগে নিজের মূল্যবান সেলাই করা কাপড়গুলো খুলে ফেলে এবং তত্স্থলে সেলাইহীন কাপড়সম সাদা কিছু কাপড় পরে নেয়। টুপি-পাগড়ি বা মুকুট যেগুলোকে ইজ্জতের প্রমাণ মনে করত, সেগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে, বিনয়ের জীবন্ত ছবি হয়ে, উলঙ্গমস্তক ও উলঙ্গপদ হয়ে আল্লাহর ঘরের উঠোনে এসে পড়ে। অতঃপর দেওয়ানার মতো দৌড় শুরু করে এবং কাবা শরীফের চতুর্পার্শ্বে চক্কর চক্করে ঘুরতে থাকে। আবার হেরমের এক কোনায় একটি পাথর দেখতে পায়, তখন শুরু করে সেদিকে দৌড়ঝাঁপ। শত ভিড়ের বেড়া ঠেলে সে তাতে চুমু দেয়ার চেষ্টা করে। শত চেষ্টার পর চুমো দিতে না পারলে হাত উঠিয়ে প্রতীকী চুম্বনে নিজের হৃদয়-মন শান্ত করে। এসবের যৌক্তিক প্রমাণ সে পায় না। তবু সে করে যায় প্রেমিকের প্রমাণ দিয়ে যায়।
তাওয়াফ থেকে ফারেগ হয়ে সে একটি জায়গায় আসে, যেখানে সাইয়িদুনা ইবরাহিমের (আ.) পদরেখা এখনও বিদ্যমান। সেখানে এসে থেমে যায় এবং সেজদাবনত হয়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানো স্থানে নামাজ আদায় কর’ (সূরা বাকারা-১২৫)।
অতঃপর সে বায়তুল্লাহ থেকে কিছু দূরত্বে অবস্থিত দুটি পর্বত অবলোকন করে। ওগুলোর দিকে তার পা নির্বিঘ্নে ও নিশ্চিন্তে দৌড়ে যায়, গিয়ে সে একবার এ পাহাড়ে আবার ওই পাহাড়ে এভাবে সাতটি চক্কর সম্পন্ন করে। এটি অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, পৃথিবীতে শতসহস্র পাহাড় রয়েছে, তবে এই উভয় পাহাড়ের শান ও মান কিন্তু অন্যরকম। এই দুই পর্বতের সম্পর্ক আল্লাহর প্রিয় বাঁদী হজরত হাজেরা আর তার কালিজার টুকরা হজরত ইসমাঈলের (আ.) সঙ্গে।
আল্লাহর বান্দা ইহরাম পরে নগ্নমস্তকে যখন সাফা-মারওয়ার সাঈ করে, তখন তার অবাঞ্ছিত লোম বড় হয়ে যায়, চুলগুলো হয়ে যায় এলোমেলো, অগোছালো। যখন সে সাতটি প্রদক্ষিণ করে ফেলে তখন ওই চুলকেশ, যা সে রূপ-শোভাবর্ধনের উদ্দেশ্যে গুছিয়ে রেখেছিল তা ক্ষুর দিয়ে মুণ্ডন করে ফেলে। বড় হয়ে যাওয়া নখ যা এর আগে নিষিদ্ধ থাকায় কাটেনি, এখন সে কেটে ফেলে। আবার একসময় মিনার দিকে যায়, তাঁবু টাঙায় এবং আরাফাতে গিয়ে সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবস্থান করে। আরাফাতে জহরের নামাজের সময় হয়, তখন যে নামাজ সারাজীবন আল্লাহর আইনের তামিলে সবসময় ওয়াক্তমতে পড়ত, সেখানে জহর আর আসরকে এক সঙ্গে আদায় করে। এর কারণ কি? শুধু এই কারণে যে, তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আরাফাতের ময়দানে জহর আর আসরকে একত্রিত করে পড়েছিলেন। এতে যুক্তিবুদ্ধির কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এখানে না সফর, না যুদ্ধজিহাদ আর না অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজন। ব্যস, হুকুম হলো যে, আসরকে জহরের ওয়াক্তে পড়। মাগরিবের সময় হয়, সে পুরো জিন্দেগি সূর্য ডুবে যাওয়ার পরপরই মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিত, কিন্তু এখানে এসে শরিয়তের সেই আইন আর বহাল থাকল না। সে নামাজের ওয়াক্ত দেখে, তারপরও আদায় করা থেকে বিরত থাকে স্রেফ এই কারণে যে, আল্লাহর মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সময় নামাজ আদায় করেননি। তিনি এই নামাজ মুজদালিফায় গিয়ে ইশার সঙ্গে পড়েন। এমনকি যখন তাহাজ্জুদের ওয়াক্ত হয়, তখনও যদি মুজদালিফায় তখনও মাগরিব-এশা একসঙ্গে সে পড়ে। কোনো ব্যতিক্রম হয় না তাতে।
মুজদালিফায় পৌঁছার পর সফরে ক্লান্ত মানুষ ভাবে, রাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করব। কিন্তু ডাক আসে, মুজদালিফা ত্যাগ করে তাঁবু এখানে (মিনায়) টাঙাও এবং পাথরের খুঁটিকে শয়তান মনে করে পাথর কুচি নিক্ষেপ কর। যুক্তিবুদ্ধি লাখো বার বলে, এখানে শয়তান কই? দেখছি তো পাথরের বড় বড় খাম্বা, তাতে কেন কঙ্কর মারব? কিন্তু ইশক বলে, এখানে যুক্তির দাসত্ব চলবে না। এখানে চলবে ইশকের গোলামি। অতএব সে মহব্বত ও প্রেমের সামনে মাথানত করে তিনদিন ধরে তাতে পাথর নিক্ষেপ করে যায়। অতঃপর সে মিনায় গিয়ে কোরবানি করছে। কোরবানি করার পর মক্কা নগরীতে ফিরে আসছে। কখনও মরুপ্রান্তরে যাচ্ছে, কখনও বনভূমি গিয়ে অবস্থান করছে। আবার কখনও শহরে চলে আসছে। প্রেমের অবাক লীলা খেলা! শাআয়িরুল্লাহর মান-মর্যাদার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পাগলের মতো তাওয়াফ ও দৌড়াদৌড়ি সবকিছুই মহব্বতের দাবি ও এখানকার ভিন্ন রকমের আদব! তার যৌক্তিক কোনো দলিল প্রমাণ মেলা ভার। ব্যস, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের স্মৃতি, যা জাগ্রত রাখার উপলক্ষেই ইবাদতের স্থানে রাখা হয়েছে। এ ভালোবাসা, এ প্রেমে, এ পাগলপনা—এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা হয় না কলমে, শুধু অনুভব করা কলবে। কবি বলেন, [মুহাব্বত মা’না ওআলফায মেঁ লায়ী নাহী জাতি ইয়ে ওয়াহ্ নাজুক হাকিকত হ্যায়, জু সমঝায়ী নাহি জাতি] ভালোবাসাকে শব্দে-বাক্যে ধারণ করা যায় না। সেটি এমন তত্ত্ব যা অনুভব করা যায়, বোঝানো যায় না।
–লেখক : প্রাবন্ধিক, আলেম