যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা
বিশ্বে ইসলাম সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম হয়ে উঠছে
ইসলামকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিস্তার লাভকারী ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত
যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টার (পিআরসি) বলেছে, বিশ্বে ইসলাম সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম হয়ে উঠছে। ইসলাম হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ধর্ম। ১৯৯টি দেশের মধ্যে ২০১৫ সালের তথ্য বিশ্লেষণ করে গত মঙ্গলবার প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’- এর ধর্মীয় রূপরেখা বিষয়ক এক গবেষনায় এ কথা বলা হয়েছে। এর আগে পিআরসি-র গবেষণায় ইসলামকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিস্তার লাভকারী ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
পিআরসি-র গবেষণায় বলা হয়, আগামী ২০৭০ সালের পর বিশ্বে ইসলাম হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম। এর আগে বিশ্বে ২০৫০ সাল নাগাদ মুসলিম জনসংখ্যা হবে খ্রিস্টানদের প্রায় সমান। ইসলাম হবে এ দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্মবিশ্বাস। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা এক হিসাবে (প্রজেকশান) এমনটিই দেখা গেছে। উল্লেখ্য, পিআরসি-র ধর্মীয় রূপরেখা বিষয়ক এক সমীক্ষায় এ কথা বলা হয়েছে। সারা বিশ্বের জন্মহার, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ধারা এবং ধর্মান্তরের পরিসংখ্যানের তথ্যের ভিত্তিতে এ সমীক্ষা করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত ইন্দোনেশিয়াকেও ছাড়িয়ে যাবে। মুসলিম জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত ইন্দোনেশিয়াকে ছাড়িয়ে গেলেও দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে।
এতে বলা হয়, প্রায় প্রতিটি ধর্মের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা। এরপরেই রয়েছে খ্রিস্টান ও হিন্দু জনসংখ্যা।
সমীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের সংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ২৭৬ কোটিতে। ওই সময় মুসলমানরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হবে। ২০৫০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৯শ’ কোটি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষণা বলা হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে একটা সমতা বজায় থাকবে। খ্রিস্টানদের সংখ্যা বাড়লেও মুসলমানদের হারে বাড়বে না। মুসলমানদের সংখ্যা হবে ২৮০ কোটি যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ এবং খ্রিস্টানদের সংখ্যা ২৯০ কোটি (মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ) গিয়ে দাঁড়াবে। যদি এই ধারা চলতে থাকে তাহলে ২০৭০ সালের পর বিশ্বে ইসলামই বেশি জনপ্রিয় ধর্ম হবে।
২০৫০ সালে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হবে মুসলিম যা ২০০৯ সালে ছিল ৫ দশমিক শতাংশ। অর্থাৎ ২০৫০ সালে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের বেশি হয় মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান হবে। একই সময়ে ইউরোপে হিন্দুদের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে। বতর্মানে সেখানে হিন্দুদের সংখ্যা ১৪০ কোটি। অভিবাসনের ফলেই এটা ঘটবে। ২০১০ সালে বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ১৬০ কোটি যখন খ্রিস্টানদের সংখ্যা ছিল ২১৭ কোটি।
গবেষণায় বলা হয়, সামনের দিনগুলোতে একদিকে বাড়বে যেমন ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা, ঠিক তেমিন বিপুল পরিমাণ মানুষ ধর্ম বিশ্বাস, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মান্তরিত হবে।
আরও বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে পিউর গবেষণায়। যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিক সহ ধর্মহীনদের সংখ্যা ১৬ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশে উন্নীত হবে। তবে বিশ্বব্যাপী নাস্তিক সহ কোনো ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, এমন মানুষের সংখ্যার হার হ্রাস পাবে।
যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টানদের জনসংখ্যা ৭৮% থেকে হ্রাস পেয়ে ৬৬% হবে। ইসলাম হবে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, ইহুদী ধর্ম নেমে যাবে তৃতীয় স্থানে। সাব-সাহারা অঞ্চলের আফ্রিকান দেশগুলোতে বিশ্বের মোট খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ৪০% বসবাস করবে। ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি খ্রিস্টান বসবাস করবে নাইজেরিয়ায়।
গবেষণায় জানানো হয়, বিশ্বে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ৩৪ শতাংশ হারে বাড়ছে। এর ফলে জনসংখ্যা ১ বিলিয়ন থেকে ২০৫০ সালে ১ দশমিক ৪ বিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। বিশ্বের জনসংখ্যার আধিক্যের দিক দিয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। এছাড়া কোনো ধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন মানুষের সংখ্যা হবে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে এরা জনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী ৪ দশকে বিশ্বে মুসলিমদের সংখ্যা দ্রুতহারে বাড়তে থাকলেও বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় জনসংখ্যা হবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। ২০১০ সালে বিশ্বে খ্রিস্টান জনসংখ্যা ছিল ২.১৭ বিলিয়ন, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১.৬ বিলিয়ন। সেখানে ২০৫০ সালে বিশ্বে খ্রিস্টান জনসংখ্যা হবে ২.৯ বিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ। মুসলিম জনসংখ্যা হবে ২.৮ বিলিয়ন যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। আর বৌদ্ধদের সংখ্যা বাড়বে শুধুমাত্র চীন, জাপান ও থাইল্যান্ডের মতো কয়েকটি দেশে।
মেসিডোনিয়া, নাইজেরিয়া সহ প্রায় ৫১ টি দেশে মুসলিম জনসংখ্যা ৫০% এরও বেশী হবে। মেসিডোনিয়া আর বসনিয়া খ্রিস্টান প্রধান থেকে মুসলিম প্রধান দেশে পরিণত হবে।
পৃথিবীতে মুসলিম জনগষ্ঠি বিপুল বৃদ্ধির অনেক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে উচ্চ জন্মহার। ইউরোপ, রাশিয়া, চীনসহ আমেরিকার দেশগুলোতে ধর্মহীন জীবন-যাপন করা, লিভটুগেদার আর বিয়ে বা সংসার করে বাচ্চা-কাচ্চা নেয়ার প্রবণতা অনেক কম। তাছাড়া টোটাল ফার্টিলিটিও কম। তাই এসব অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা নিতান্ত অপ্রতুল (বৃদ্ধির হার – ০.৫ থেকে ০.৯)। অন্যদিকে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলোতে ধর্মীয় প্রভাব আর পারিবারিক অবকাঠামো অটুট থাকার পাশাপাশি উচ্চ জন্মহারের কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশী (বৃদ্ধির হার ১.০ থেকে > ২.০)।
পিআরসি বলে, বিশ্বের ১৭৫টি দেশের ২ হাজার ৫০০ জরিপ থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণ করেছে পিউ। তবে তারা এটাও বলেছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় ধরণের সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তন, সশস্ত্র যুদ্ধ, ইত্যাদি বিষয়গুলো এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে ব্যাহতও করতে পারে। তা না হলে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ধর্মভিত্তিক মানচিত্র হবে এ রকমই।
পিউ রিসার্চের ২০১৭ সালের তথ্যেও দেখা যায়, ইসলাম হচ্ছে সর্বাধিক জনপ্রিয় রাষ্ট্রীয় ধর্ম। শিয়া ও সুন্নি ইসলাম মিলিয়ে ২৭টি দেশে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
পিউ-র গবেষণায় বলা হয়, ২০৫০ সালে ইউরোপের ১০ শতাংশ মানুষ মুসলমান হয়ে যাবে। একই সময় নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়াবে ২.১ শতাংশ। সেখানে মুসলমানদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ৪৮ শতাংশ মার্কিনির। অন্যদিকে দলীয় ভিত্তিতে ৫৬ শতাংশ ডেমোক্র্যাট মুসলিমদের পছন্দ করে। তবে রিপাবলিকানদের মধ্যে মুসলিমদের পছন্দ করে ৩৯ শতাংশ।
এদিকে চীনে প্রতিনিয়তই মুসলিম নির্যাতনের খবর শোনা যায়। কিন্তু চীনা তরুণদের মধ্যে দেখা গেছে এর বিপরীত চিত্র। নতুন এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, চীনা তরুণদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। সেখানকার মুসলিমদের রোজা রাখা, নারীদের হিজাব পরাসহ ইসলাম পালন নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষাপটে এই তথ্য বেশ তাৎপর্যপ‚র্ণ।
বেইজিংয়ের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত ‘চীনা ধর্ম জরিপ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, ৩০ বছরের নীচের তরুণদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। এর আগে ২০১০ সালে পিউ রিসার্চ জানায় যে ‘নাস্তিক’ চীনে ২ কোটি ৩৩ লাখ মুসলমান বাস করেন, যা মোট জনসংখ্যার ১.৮ শতাংশ।
পিউ রিসার্চের গবেষণায় বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩ কোটিতে উন্নীত হবে। জরিপে বলা হয়, চীনে মুসলমানদের জন্মহার সবচেয়ে বেশি, গড়ে ১.৭। দেশটির গড় উর্বরতার হার ১.৪।