কুরআন তেলাওয়াতের আদব

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব: হাদিস শরিফে আছে, ‘যে কুরআনের একটি হরফ উচ্চারণ করবে, সে দশ নেকি পাবে।’ রাসূলুল্লাহ সা: এটাও বলে দিয়েছেন, ‘আমি বলি না আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ; বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ ও মিম একটি হরফ।’ কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, আমরা এত বড় সাওয়াবের একটি ইবাদতকে অত্যন্ত গুরুত্বহীনতার সাথে আদায় করে থাকি। কুরআন তেলাওয়াতের সাধারণ নিয়মাবলি ও আদবের প্রতি লক্ষ্য করি না। বরং কুরআনের সাথে চরম বেয়াদবি করে থাকি।

কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত পূর্ণ আদব ও আজমতের সাথে, আল্লাহ তায়ালাকে হাজির-নাজির জেনে এবং কুরআনে কারিম তেলাওয়াতের সাধারণ যে নিয়মাবলি রয়েছে, তার প্রতি লক্ষ রেখে। কুরআনে কারিমে সূরা মুজ্জাম্মিলের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনি কুরআন তেলাওয়াত করুন স্পষ্ট উচ্চারণে, ধীরে ধীরে।’ এই আয়াতে ‘তারতিল’ শব্দটির উল্লেখ আছে। তারতিল অর্থ হলো অন্তর্নিহিত অর্থের প্রতি খেয়াল করে, স্পষ্ট উচ্চারণে ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করা। রাতের নামাজে রাসূলুল্লাহ সা:-এর তেলাওয়াত কেমন ছিল- এমন প্রশ্নের উত্তরে নবীপত্নী হজরত উম্মে সালমা রা: নবীজীর অনুকরণে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনান। তাতে প্রতিটি হরফ স্পষ্ট ছিল। (জামে তিরমিজি) হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, হজরত উম্মে সালমা রা: নবীজীর তেলাওয়াতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে যে, তার তেলাওয়াত ছিল : হরফ পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারিত। (সুনানে আবু দাউদ ১৪৬৬, জামে তিরমিজি, হাদিস নম্বর ২৯২৩, সহি ইবনে খুজায়মা, হাদিস নম্বর ১১৫৮)

হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আনাস রা:কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তেলাওয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তার তেলাওয়াত ছিল (মদের স্থানগুলো) টেনে পড়া। এরপর তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পাঠ করে শুনান এবং তাতে বিসমিল্লাহ, আর রাহমান ও রাহিমের মদগুলো টেনে উচ্চারণ করে দেখান (সহি বুখারি, হাদিস নম্বর ৫০৪৬)।

এক ব্যক্তি হজরত ইবনে মাসউদ রা:কে বলল, আমি নামাজের এক রাকাতে মুফাসসাল সূরা পাঠ করি। উত্তরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বললেন, সে তো কবিতা আওড়ানোর মতো পাঠ করা। (সহি বুখারি, হাদিস নম্বর ৭৭৫, সহি মুসলিম, হাদিস নম্বর ৮২২) একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘কুরআন তেলাওয়াতকারী বা হাফেজকে (কিয়ামতের দিন) বলা হবে, তুমি তেলাওয়াত করতে থাকো আর ওপরে উঠতে থাকো। তুমি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করো, যেভাবে তুমি ধীরে ধীরে দুনিয়াতে তেলাওয়াত করতে। তোমার অবস্থান হবে সর্বশেষ আয়াতের স্থলে, যা তুমি তেলাওয়াত করতে।’ হাদিসটি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ১৪৬৪, জামে তিরমিজি, হাদিস নম্বর ২৯১৪, সহি ইবনে হিব্বান, হাদিস নম্বর ৭৬৬)।

ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, খুব দ্রুত তেলাওয়াত করা যাতে উচ্চারণ বিঘিœত হয়Ñ মাকরুহ। তারতিলের সাথে এক পারা তেলাওয়াত করা সমপরিমাণ সময়ে তারতিল ব্যতীত দুই পারা পড়ার চেয়ে উত্তম। কয়েকটি কারণে তারতিলের সাথে তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব।

তারতিলের সাথে তেলাওয়াত করা হলে কুরআনের বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ করা যায়। আল্লাহর কালামের প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অন্তরে অধিক ক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সুতরাং যে কুরআনের অর্থ বোঝে না, তার জন্যও তারতিলের সাথে তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব।

আল্লামা জারকাশি রহ: বলেন, পরিপূর্ণ তারতিল মানে কুরআনের শব্দগুলো ভরাট উচ্চারণে পাঠ করা এবং হরফগুলোকে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা। অন্যথায় এক হরফ আরেক হরফের সাথে যুক্ত হয়ে যাবে। কারো কারো মতে, এটা হলো তারতিলের সর্বনি¤œ মাত্রা। পরিপূর্ণ তারতিল হলো, কুরআন বর্ণিত বিষয়বস্তুর বর্ণনাভঙ্গির প্রতি লক্ষ রেখে তেলাওয়াত করা। যেমনÑ শাসনবাণী বিষয়ক আয়াত তোলাওয়াতের সময় শাসনবাণী উচ্চারণকারীর মতো উচ্চারণ করা এবং সম্মান প্রদর্শনবিষয়ক আয়াতের তেলাওয়াতের সময় সম্মান প্রকাশ করার ভঙ্গিতে উচ্চারণ করা ইত্যাদি। (আল বুরহান ফি উলুমিল কুরআন, ১/৬৩৫, আল ইতকান ১/৩১০) ইমাম নববী রহ: তার লিখিত কিতাব আত-তিবইয়ানে বলেন, ‘উচিত হলো কুরআনকে তারতিলের সাথে পড়া।

ওলামায়ে কেরাম তারতিল মুস্তাহাব হওয়ার ওপর ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে নবী! আপনি কুরআন তেলাওয়াত করুন স্পষ্ট উচ্চারণে, ধীরে ধীরে। হজরত উম্মে সালমা রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নবীজীর তেলাওয়াতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- তার তেলাওয়াত ছিল ‘প্রতিটি হরফ পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারিত।’ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আবু দাউদ সুনানে আবু দাউদ শরিফে, (হাদিস নম্বর ১৪৬৬) এবং ইমাম তিরমিজি তার লিখিত হাদিস গ্রন্থ জামে তিরমিজিতে, (হাদিস নম্বর ২৯২৩) ইমাম তিরমিজি বলেন, হাদিসটি হাসান সহি। ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, তেলাওয়াতে অর্থ অনুধাবনের জন্য তারতিল মুস্তাহাব। ওলামায়ে কেরাম আরো বলেন, আজমি, যারা কুরআনের অর্থ বোঝে না, তাদের জন্য তারতিল মুস্তাহাব। কেননা তা সম্মানের অধিক নিকটবর্তী এবং অন্তরে অধিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী।

হজরত আলকামা রা: একবার এক ব্যক্তিকে কুরআন তেলাওয়াত করতে শুনে বলেন, ‘লাকাদ রাত্তালাল কুরআনা, ফিদাহু আবি ও উম্মি।’ অর্থাৎ লোকটি তারতিলের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করেছে। তার প্রতি আমার বাবা-মা উৎসর্গ হোক।
কুরআন যথাসাধ্য সুমিষ্ট ও সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত করা উচিত। সুন্দর কণ্ঠে তেলাওয়াতের প্রতি ইসলামি শরিয়ত গুরুত্ব দিয়েছে এবং তা সুন্নত। এক হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমরা শ্রুতিমধুর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত করো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ১৪৬৮, সুনানে নাসায়ি, হাদিস নম্বর ১০১৫, সহি ইবনে খুজায়মা, হাদিস নম্বর ১৫৫১, সহি ইবনে হিব্বান, হাদিস নম্বর ৭৪৯) অপর এক হাদিসে আছে, ‘তোমরা সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত করো। কেননা সুন্দর আওয়াজ কেরাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।’ (সুনানে দারেমি, হাদিস নম্বর ৩৭৭৩, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস নম্বর ২১২৫) সুন্দর আওয়াজে কুরআন তেলাওয়াত সম্পর্কে অনেক সহি হাদিস রয়েছে। সুতরাং তেলাওয়াতকারী যদি সুন্দর আওয়াজের অধিকারী না-ও হয়, তবুও যথাসম্ভব সুন্দর করার চেষ্টা করবে। তবে সুন্দর করতে গিয়ে দৃষ্টিকটু পর্যায়ের টানাটানি করবে না। সুর করে তেলাওয়াত করা, যদি তাতে উচ্চারণ-বিকৃতি না ঘটে, তবে তাতে আপত্তির কিছু নেই। আর উচ্চারণ-বিকৃতি ঘটলে নাজায়েজ। ইমাম নববী রহ: বলেন, সুন্দর আওয়াজের অধিকারী কুরআন তেলাওয়াতকারীর কাছে তেলাওয়াত শুনতে চাওয়া এবং মনোযোগের সাথে তা শোনা মুস্তাহাব। সহি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূল সা: সুন্দর আওয়াজে তেলাওয়াতকারী সাহাবিদের থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনেছেন। (আত-তিবইয়ান, পৃ: ১৩০)

সুতরাং কুরআনকে তারতিলের সাথে ও সুন্দর আওয়াজে পড়া সুন্নত। আমাদের দেশে তারাবির নামাজে যেভাবে কুরআন পড়া হয়, তা বলা যায় একটি অপসংস্কৃতি। এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। হাফেজ সাহেবকে ভাবতে হবে যে, তারাবির রূহ বা প্রাণ হলো কুরআন তেলাওয়াত। এভাবে কুরআন তেলাওয়াতের দ্বারা কুরআনের আজমত তো রক্ষা হয়ই না, বরং কুরআনের সাথে চরম বেয়াদবি ও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা হয়। তাই এত দ্রুত তেলাওয়াত করা যাবে না যে, তেলাওয়াতের কিছুই বুঝা যায় না। আবার এত ধীরেও পড়া যাবে না যে, মুসল্লিদের কষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে হাফেজ সাহেবরা বায়তুল্লাহ শরিফ ও মসজিদে নববীর তেলাওয়াতের অনুকরণ করতে পারেন।

মসজিদ কমিটিকে ভাবতে হবে, এত কষ্ট করে নামাজ পড়ে সামান্য একটু সময়ের সাশ্রয় করতে গিয়ে পুরো নামাজের সাওয়াবই বিনষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমার সব কাজ ঠিক থাকবে, আবার আল্লাহ তায়ালার কাছে অফুরন্ত পুণ্যের আশা করব, এটা তো হতে পারে না। যেখানে এত দীর্ঘ সময় নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম, সেখানে সামান্য সময়ের জন্য এমন কী আহামরি ক্ষতি হয়ে যাবে! বরং এটা হচ্ছে শয়তানের ধোঁকা। আমরা যদি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেই তাহলে ধীরস্থীরভাবে নামাজ পড়া অসম্ভব কিছু নয়। তা ছাড়া এতে সময় খুব বেশি সাশ্রয় হয় না। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, তারতিলের সাথে কুরআন তেলাওয়াত আর দ্রুততার সাথে তেলাওয়াতের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য হয় না। সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ মিনিটের কম-বেশি হয়। তাই মসজিদ কমিটি ও সাধারণ মুসল্লিদের উচিত, একটু বিলম্ব হলে বিরক্তি প্রকাশ না করে বরং ধীরস্থিরভাবে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে হাফেজ সাহেবদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করা। কারণ হাফেজ সাহেবরা নির্বিঘেœ নামাজ পড়ানোর জন্য তাদের সহযোগিতা একান্ত জরুরি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, টঙ্গী, গাজীপুর

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button