ওয়াশিংটন পোস্টে জামাল খাশোগির ‘শেষ কলাম’
ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা নিজের ‘শেষ কলামেও’ আরব বিশ্বজুড়ে অবাধ মত প্রকাশের সুযোগ চেয়েছিলেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি।
রাজপরিবারের নীতির সমালোচনা করে মত প্রকাশের জন্য সৌদি এ সাংবাদিককে বছরখানেক আগেই নিজের দেশ ছাড়তে হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থেকেও অবশ্য ‘শেষ রক্ষা হয়নি’। দুই সপ্তাহ আগে তুরস্কের সৌদি কনসুলেটে নিজের বিয়ের কাগজপত্র আনতে ঢুকেছিলেন গত বছর থেকে ওয়াশিংটন পোস্টে নিয়মিত কলাম লিখে যাওয়া খাসোগি; এরপর থেকেই তার আর কোনো খোঁজ নেই।
সৌদি এ সাংবাদিককে তার দেশের গুপ্তচররাই ইস্তাম্বুলের কনসুলেটের ভেতর হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আঙ্কারার। রিয়াদ এ অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও তদন্তের গতিপ্রকৃতিতে ‘খাসোগিকে খুন করা হয়েছে’ এমনটাই উন্মোচিত হচ্ছে বলে ধারণা পশ্চিমা গণমাধ্যমের।
এর মধ্যেই বুধবার ওয়াশিংটন পোস্ট নিখোঁজ হওয়ার আগে তাদেরকে পাঠানো খাসোগির সর্বশেষ কলাম ছাপায়। ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে প্রবেশের আগেই ৭০০ শব্দের ওই নিবন্ধটি সহকারীকে পাঠিয়েছিলেন আল-আরব নিউজ চ্যানেলের সাবেক এ প্রধান সম্পাদক।
খাসোগির নিখোঁজ নিয়ে আঙ্কারা ও রিয়াদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এবং পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগের মধ্যেই ৩ অক্টোবর ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে কলামটি পৌঁছায়। সপ্তাহ দুয়েক অপেক্ষার পর সেটি ছাপার সিদ্ধান্ত হয়।
৭০০ শব্দের এ কলামে খাসোগি আরব বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগ উন্মোচনের জোর দাবি জানান। বলেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে চাওয়া অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোই মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশে এ ধরনের ‘লোহার পর্দা’ চাপিয়ে দিয়েছে।
তথ্য ও ধারণার অবাধ বিনিময় চেয়ে লেখা কলামটির শিরোনামও হচ্ছে- ‘আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যা দরকার, তা হল অবাধ মতপ্রকাশ’।
রাজনৈতিক অধিকার ও বেসামরিক নাগরিকদের স্বাধীনতা নিয়ে ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনের কথাও উল্লেখ করেন খাসোগি। বেশিরভাগ আরব রাষ্ট্রই এ ধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা দেয় না বলে ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আরবের সরকারগুলো গণমাধ্যমের মুখচেপে ধরলেও সেখানে খুবই অল্প প্রতিবাদ হয় বলেও জানান খাসোগি। সাধারণ মানুষও এ দেখে আরও চুপ মেরে যায়।
ভিন্নমতাবলম্বী লেখক, চিন্তাবিদ ও প্রতিবেদকদের জন্য বিকল্প গণমাধ্যমের কথাও ভাবতে বলেন এ সাংবাদিক।
সোভিয়েত আমলে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপিত ‘রেডিও ফ্রি ইউরোপের’ মত কিছু আরব বিশ্বকে লক্ষ্য করে বানানো যায় কিনা, তারও প্রস্তাব করেন এক সময়ে সৌদি রাজপরিবারের উপদেষ্টা ও অঘোষিত মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করা খাসোগি।
পরের দিকে ইয়েমেনের যুদ্ধ, নারী আন্দোলনকর্মীদের আটক এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বিষয়ে রিয়াদের অবস্থানের সমালোচক হিসেবেও আবির্ভূত হন এ সাংবাদিক।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান লেখালেখিতে বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন খাসোগি, এরপর থেকে ভার্জিনিয়াতেই বাস ছিল তার।
তুর্কি বাগদত্তা হেতিস চেঙ্গিসকে বিয়ে করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করতে গত ২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসুলেটে ঢুকেছিলেন ওয়াশিংটন পোস্টের এ কলামনিস্ট।
নয় ঘণ্টা অপেক্ষার পরও খাসোগি কনসুলেট থেকে বেরিয়ে না আসায় তুর্কি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানান হেতিস। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে সৌদি সাংবাদিককে কনসুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে আঙ্কারা।
এ সংক্রান্ত অডিও প্রমাণও হাতে পাওয়ার কথা জানান তুর্কি তদন্ত কর্মকর্তারা। রিয়াদ এ অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে খাসোগির অন্তর্ধান তদন্তে সহায়তা করতে কর্মকর্তাদের কনসুলেট ভবনের ভেতর তল্লাশির অনুমতি দেয়।
খাসোগি যেদিন কনসুলেট ভবনে গিয়েছিলেন সেদিনই ১৫ সদস্যের একদল সৌদি গুপ্তচর ইস্তাম্বুল নেমেছিল বলে দাবি করে তুরস্ক। ওই গুপ্তচররাই রাজপরিবারের সমালোচক সাংবাদিককে কনসুলেট ভবনের ভেতর হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে বলে জানায় তুর্কি সূত্রগুলো।
চলতি সপ্তাহে সিএনএন ও নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, খাসোগিকে কনসুলেটের ভেতর হত্যার স্বীকারোক্তি দিতে যাচ্ছে সৌদি আরব। এ ঘটনার জন্য জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব থাকা কর্মকর্তাদের ওপর দোষ চাপানোর কথাও ভাবছে তারা।
মার্কিন গণমাধ্যম দুটি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা খাসোগিকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্সই। ‘ভুল পথে পরিচালিত’ জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনেই খাসোগির মৃত্যু হয়, রিয়াদ তাদের দায় স্বীকারে এমনটি বলতে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ক্রাউন প্রিন্সের দায় মোচনের চেষ্টা চলছে বলেও মত নিউ ইয়র্ক টাইমসের।
খাসোগির নিখোঁজকাণ্ডে সমালোচনা চলছে যুক্তরাষ্ট্রও। মার্কিন সাংসদদের অনেকেই সৌদি আরবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবতে প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছেন বলেও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
সৌদি সাংবাদিককে ‘হত্যা করা হয়েছে’, তুরস্কের কাছে থাকা এ বিষয়ক জোরাল প্রমাণ চেয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেওকে রিয়াদেও পাঠিয়েছিলেন তিনি।