এক সিংহপুরুষের চিরবিদায়
আবদুল কাদের তাপাদার: তিনি সত্যিই এক বীর সিপাহসালার। তিনি আমাদের কালের এক সিংহপুরুষ। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ইসলামের বিরুদ্ধাচরণকারীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি জ্বলন্ত আতংক। তাঁর হুংকারে, গর্জনে বাতিলের তখতে তাউস কেঁপে উঠতো। তিনি প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান।
নগরীর কাজিরবাজার জামেয়া মাদানিয়ার আজীবন প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমানের সমস্ত আবেগ, বীরত্ব আর সংগ্রাম সাধনা মিশে গিয়েছিলো হযরত শাহজালালের( রঃ) উত্তরসুরী সিলেটবাসীর আধ্যাত্মিক পটভূমিতে। তিনি যেনো হয়ে উঠেছিলেন এই ধর্মপ্রাণ সিলেটবাসীর এক স্বার্থক ও সফল অগ্রপথিক।তিনি এই জনপদের ইসলামপ্রিয় জনতাকে বারে বারে পথ দেখিয়েছেন, সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁর অসাধারণ মেধা ও নেতৃত্বে।
সিলেটের পবিত্র ভূমিতে গত চল্লিশ বছরে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিলেটবাসীর অধিকারে গড়ে উঠা সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে উত্তাল মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। সেই উত্তাল মিছিল শ্লোগান আর মাওলানার অসাধারণ বাগ্মিতায়, হুংকারে একাকার হয়ে যেতেন জনসাধারণের অনেকেই। দেখতে কিছুটা খাটো অথচ মাথায় পাগড়ি পরা এক তেজস্বী মাওলানার আহবানে বার বারই আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
১৯৮৭-৮৮ সালে দাউদ হায়দার ও সরদার আলাউদ্দিনের নাস্তিকতা ও ইসলাম বিরোধী আন্দোলনের শুরু হয় সিলেট থেকে।তরুণ মাওলানা হাবিবুর রহমান মিছিল নিয়ে নামেন রাজপথে।যুগপৎ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। দাউদ হায়দার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
নব্বই দশকে তসলিমা নাসরিন ইসলাম ও আল্লাহ এবং রাসুলের (সাঃ) বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করলে দেশে প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ সময় চ্যালেন্জ নেন প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান।তিনি সিলেটে বড় আন্দোলনের ডাক দেন। তসলিমার মাথার দাম ঘোষণা করা হয় ৫০ লাখ টাকা। এই ঘোষণায় তোলপাড় শুরু হয় জাতীয় ও বিশ্বমিডিয়ায়।এ নিয়ে তাঁর পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক লেখালেখি হয়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নামকরণ বিরোধী আন্দোলনে সিলেটে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। এসময় এই আন্দোলনে সামনের কাতারে থেকে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান। সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন।
মাওলানা হাবিবুর রহমান একাধারে একজন সেরা আলেম, লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।তিনি ইসলামী ঐক্যজোট হয়ে খেলাফত মজলিসে যোগ দেন।পরে খেলাফত বিভক্ত হয়ে তিনি এক অংশের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৯৬ সালে গোলাপগন্জ বিয়ানীবাজার থেকে মিনার প্রতীক নিয়ে সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হন।
মাওলানা হাবিবুর রহমান পড়ালেখা করেন ফুলবাড়ি মাদ্রাসা ও সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায়। তিনি সিলেট আলিয়া থেকে কামিলে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এরপর কাজিরবাজারে মসজিদে ইমামতি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে এই বিচক্ষণ তরুণ আলেম গড়ে তুলেন জামেয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসা আলেম গড়ার কাজে পালন করে চলেছে এক ঐতিহাসিক কর্মকান্ড।
মাওলানা হাবিব সব সময়ই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ইসলামের পক্ষে তাঁর আজীবন লড়াকু মন মানসিকতা তাঁকে এনে দিয়েছে ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা সিলেটের ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে মরহুমের এক ঐতিহাসিক জানাজা প্রমাণ করলো তিনি এ মাটিতে কতোটা জনপ্রিয়। লাখো মানুষের ঢল মাঠ ছাড়িয়ে আশপাশের সড়কে ছড়িয়ে যায়।
আমি এই আলেমের রুহের মাগফেরাত ও আল্লাহতায়ালার কাছে তাঁর জান্নাতুল ফিরদাউস কামনা করছি।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জালালাবাদ, সিলেট।