কওমি স্বীকৃতি: বঙ্গবন্ধুকন্যার অর্জন শিরোপার সোনালি পালক
মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী: উপমহাদেশের শিক্ষার শুরু হয়েছে কওমি মাদরাসা থেকে। মুসলিম শাসন যুগে এ অঞ্চলের প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রভাষা ফার্সি হওয়ায় শিক্ষিত ব্যক্তিকেই গুলিস্তা-বোস্তা-পান্দেনামা ইত্যাদি পড়তে হত। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই আরবি-ফার্সি জানতেন।
রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আরবি-ফার্সি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ও সংগ্রাহক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যের অমিয় পীযূষ ধারা বিশ্ব প্রেমিক মহা কবি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির সেসব কিতাব থেকেও লাভ করেন, যা তার দাদা মহাশয়ের গ্রন্থালয়ে তিনি পড়েছিলেন।
মুসলিম কওমি শিক্ষা প্রসারের জন্য তৈরি হুগলির হাজী মুহম্মদ মহসীন শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা করেছিলেন আরেক সাহিত্য প্রতিভা বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আরবি-ফার্সি সাহিত্যের লালিত্য মেখে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যা সাগরসহ দেশীয় বহু মনীষী।
এই দেওবন্দের সন্তানরাই ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের মূল প্রেরণাদায়ী ও ক্ষেত্র বিশেষে চালিকা শক্তি ছিলেন। ব্রিটিশ যুগ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানের ২৪ বছর কওমি শিক্ষা কোনো স্বীকৃতি পায়নি। যদিও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ই মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতাহার আলী, খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দীক আহমদ, পাকিস্তানের মুফতি শফিসহ ওলামায়ে কেরাম স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাঙালার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। ফার্সির স্থলে ইংরেজি হয় রাষ্ট্রভাষা। মাদরাসাগুলো পরিণত হয় পোড়োবাড়িতে। বহু মাদরাসা রুপান্তরিত হয় স্কুল কলেজে। যেমন ঢাকার হাম্মাদিয়া স্কুল।
চট্রগ্রামের মুহসিনিয়া মাদরাসা, রাজশাহী ও সিলেটের অনেক মাদরাসা। ধাপে ধাপে সরকারি মাদরাসার নিউস্কিম প্রজেক্টই এদেশের সব স্কুল কলেজের সূচনা।
অর্থাৎ মাদরাসাগুলোর রূপান্তর হচ্ছে স্কুল কলেজ ইত্যাদি। কওমি শিক্ষার জন্য ওয়াকফকৃত বাংলার মোট জমির ৪০ ভাগ ইংরেজরা এক কলমের খোঁচায় বাতিল ঘোষণা করে। যখন বাংলা প্রদেশেই ছিল ৮০ হাজার মাদরাসা। মাদরাসাগুলো বন্ধ হওয়ার পথে চলে যায়।
দিল্লির মাদরাসাগুলো কলেজে পরিণত হওয়ার পর ১৭৮০ সালে কওমি জগতের মুকুটহীন সম্রাট, ইসলামি অঙ্গনের সকল মত ও পথের উৎসপুরুষ শাহওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. এর শিষ্য মোল্লা মাজদুদদীন (ওরফে মোল্লা মদন) ইংরেজদের সহায়তা নিয়ে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
সে হিসেবে আলিয়া পদ্ধতি কওমিরই উপজাত। একশ বছর স্বাধীনতা সংগ্রাম উপরোল্লেখিত শাহ সাহেবের বড় ছেলে শাহ আবদুল আজিজ দেহলভীর রহ. একটি বিপ্লবী ফতোয়ার দ্বারা পরিচালিত হয়।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর এ দেশে হাজার বছরের কওমি শিক্ষা বন্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। ছয় মাসের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার আলেমকে হত্যা করা হয়। ১৪ হাজার আলেমকে রেঙ্গুন থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত শেরশাহসুরি মহাসড়কের দু’পাশে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।দিল্লীর লাল কেল্লা ও জামে মসজিদের আশেপাশে শতশত আলেমকে উত্তপ্ত চর্বির কড়াইয়ে ফেলে হত্যা করা হয়। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে বহু আলেমকে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়।
দিল্লির মাদরাসা কলেজে রূপন্তরিত হলেও সেখানকার কওমি আলেম অধ্যাপকদের কাছে শিক্ষিত ব্যক্তিরা নতুনকরে কওমিধারা ধরে রাখার সংগ্রামে নিয়োজিত হন। দিল্লির ইসলামিয়া কলেজের মাওলানা মামলুক আলীর ছাত্র মাওলানা কাসেম নানুতুবীসহ বড় আলেমরাই দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা ও মুরব্বি।
সিপাহী বিপ্লবের মহা নায়করা কওমি শিক্ষাকে ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেন দারুল উলুম দেওবন্দ। দিনটি ছিলো ৩০ জুন, ১৮৬৬ বৃহস্পতিবার। যে দেওবন্দের বয়স আজ ১৫২ বছর।
এই দেওবন্দের সন্তানরাই ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের মূল প্রেরণাদায়ী ও ক্ষেত্র বিশেষে চালিকা শক্তি ছিলেন। ব্রিটিশ যুগ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তানের ২৪ বছর কওমি শিক্ষা কোনো স্বীকৃতি পায়নি। যদিও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময়ই মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা আতাহার আলী, খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দীক আহমদ, পাকিস্তানের মুফতি শফিসহ ওলামায়ে কেরাম স্বীকৃতির জন্য চেষ্টা করেছিলেন।
১৯৬৭ সালে মাওলানা আতাহার আলীর আহ্বানে কিশোরগঞ্জে বেফাকুল মাদারিস গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। নানা কারণে যা বাস্তবায়িত হতে দশ বছর সময় লাগে। এর মধ্যে ১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর মাওলানা আতাহার আলী মৃত্যু বরণ করেন।
অবশেষে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আলেমদের চেষ্টায় ১৯৭৮ সালে নানা টানাপোড়েনের ভেতরেও বেফাক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে মাওলানা রিজাউল করীম ইসলামাবাদী, খতীব উবায়দুল হক, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মাওলানা আতাউর রহমান খান, মাওলানা শামসুদ্দিন কাসেমী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা লালবাগের নবাব শায়েস্তা খাঁ হলে পটিয়ার হাজী ইউনুসকে সভাপতি ও ঢাকার আল্লামা আজিজুল হককে মহাসচিব করে বেফাকের অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। এর কিছুদিন পর হাজী ইউনুস সভাপতি ও মাওলানা আতাউর রহমান খান মহাসচিব নির্বাচিত হন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর এ দেশে হাজার বছরের কওমি শিক্ষা বন্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। ছয় মাসের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার আলেমকে হত্যা করা হয়। ১৪ হাজার আলেমকে রেঙ্গুন থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত শেরশাহসুরি মহাসড়কের দু’পাশে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।দিল্লীর লাল কেল্লা ও জামে মসজিদের আশেপাশে শতশত আলেমকে উত্তপ্ত চর্বির কড়াইয়ে ফেলে হত্যা করা হয়। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে বহু আলেমকে ফাঁসীতে ঝুলানো হয়।
তিন মেয়াদে মহাসচিব থাকাবস্থায় বেফাকের প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও উন্নয়ন ঈর্ষণীয় পর্যায়ে থাকার সময়ই মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান খান প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় বেফাকের গঠনতন্ত্রকে অনুসরণ করে মহাসচিব পদ ছেড়ে দেন।
অবশ্য তিনি আমৃত্যু বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। তখন মহাসচিব হন বেফাকের শুরু থেকেই নিবেদিত কর্মবীর, সাবেক দফতরসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী রহ.।
বলা চলে আজকের বেফাক এ দুই পরম পেশাদারিত্ব লালনকারী মহাসচিবেরই অনুপম ত্যাগ ও অক্লান্ত কর্মযজ্ঞের ফসল। মাওলানা আবদুল জব্বারের ইন্তেকালের পর বর্তমানে ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বেফাকের মহাসচিব হন।
হাজী ইউনুসের পর মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী, এর পর মাওলানা নুরুদ্দীন গহরপুরী বেফাকের সভাপতি ছিলেন। তারপর বর্তমান সভাপতি আল্লামা শাহ আহমদ শফী দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪৭ বছর সব সরকারের আমলেই কওমি সনদের স্বীকৃতি নিয়ে কমবেশি চেষ্টা, ওয়াদা, একবার গেজেট পর্যন্ত জারি হয়েছে। শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, মুফতি ফজলুল হক আমিনীসহ দেশের সব কওমী আলেম নানাভাবে এর জন্য চেষ্টা আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন।
কওমি আলেমদের সামাজিক সম্মান সরকারিভাবে উর্ধ্বে তুলে ধরা এবং কওমি পড়ুয়া উচ্চশ্রেণীর ১৪ লাখসহ দেশের মোট ৭০ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষার সনদকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার এ দাবি পূরণ করা লেখা ছিলো আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভাগ্যলিপিতে। তার হাতেই বহুবাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত কওমী সনদের স্বীকৃতি আজ দিবালোকের মত উজ্জ্ব এক বাস্তবতা। যা সবসময়ই কওমি অঙ্গনে এক অভাবনীয় বাস্তবতা ও অধরা স্বপ্ন হয়েই ছিলো।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় সংকল্প ও অনমনীয় ইচ্ছাশক্তি আজ এ স্বপ্নকেই বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে। এ পর্যায়ে যে কথা বলতে দ্বিধা নেই, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও তার সরকারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় কওমি অঙনের বহুধা বিভক্ত শিক্ষাবিদদের একীভূত করে, অনেকগুলো বোর্ডকে সমন্বিত করে স্বীকৃতি লাভের কাজটি কওমি স্বকীয়তা বহাল রেখে যথাযথভাবে সম্পাদনের কৃতিত্ব আল্লামা শাহ আহমদ শফীর প্রাপ্য।
স্বাধীন বাংলাদেশে কওমী জগত আজ স্বীকৃত এক শক্তি। দীর্ঘ দেড়শ’ বছরের যাত্রায় যত মানুষ যতভাবে এ অঙ্গনে ভ‚মিকা ও অবদান রেখেছেন আজকের এই অবসরে সবাইকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।
লেখক: সভাপতি, দেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র, শিক্ষাবিদ, গ্রন্থকার ও সম্পাদক