ইতিহাস গড়লেন শুহাইদা বিনতে শামসুদ্দিন
মালয়েশিয়ায় শরিয়া উচ্চ আদালতে প্রথম নারী বিচারক
ইসলামিক আইন বই দ্বারা পরিবেষ্টিত আদালতের লাইব্রেরিতে অবসরের বেশিরভাগ সময় কাটান ভদ্র এবং মৃদুভাষী নেনি শুহাইদা বিনতে শামসুদ্দিন। সেখানে বসেই তিনি তার কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘যখন আমি আদালতে বসি তখন আমি একজন নারী বা একজন পুরুষ থাকি না, তখন আমি একজন বিচারক হয়ে যাই।’
কোনো কোনো দিন তিনি ইসলামিক আইন ভঙ্গ করার জন্য অপরাধীকে বেত্রাঘাত করার দ- দিয়ে থাকেন আবার কোনো কোনো দিন একজন পুরুষকে দ্বিতীয় বিবাহ করার জন্য অনুমতি দেন।
যদিও নারীবাদীরা ইসলামিক আইনের মূল্য সম্পর্কে অস্বীকার করে থাকেন কিন্তু শুহাইদা বিনতে শামসুদ্দিনের নিকট ইসলামিক আইনের গুরুত্ব অপরিসীম।
গত বছর মুসলিম অধ্যুষিত মালয়েশিয়ার শরিয়া ভিত্তিক উচ্চ আদালতের বিচার নিযুক্ত হয়ে তিনি ইতিহাস গড়েছেন। এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার শরিয়া উচ্চ আদালতে তিনি এবং আরেকজন নারী বিচারক রয়েছেন। ‘শরিয়া’ একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ইসলামিক আইন।
৪২ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী শুহাইদা বিনতে শামসুদ্দিন ইসলামিক আইন ভঙ্গের দায়ে অপরাধীকে কঠিন শাস্তি দিতে দ্বিধাবোধ করেন না।
তিনি বলেন- ‘কোন পক্ষপাতিত্ব না করেই সুবিচার নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব।’
মালয়েশিয়ায় বর্তমানে অনেক নারীই ইসলামিক বিচার ব্যবস্থায় বিচারক এবং আইনজীবী হওয়ার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
মালয়েশিয়ায় দুধরনের আদালত ব্যবস্থা রয়েছে। ইসলামিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আদালতসমূহ মুসলিম পারিবারিক এবং ছোটখাট অপরাধসমূহের বিচার করে থাকে যেমন- মদ্যপান, জুয়াখেলা, বহুবিবাহ ইত্যাদি, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ আদালতসমূহে বিভিন্ন ফৌজদারি এবং দেয়ানী অপরাধের বিচার হয়ে থাকে।
মালয়েশিয়ায় ২০১০ সাল থেকে শরিয়া আদালতে নারী বিচারক নিয়োগ দেয়া শুরু হয় এবং বর্তমানে দেশটির ১৬০টি শরিয়া আদালতে অন্তত ২৭ জন নারী বিচারক কর্মরত আছেন।
মালয়েশিয়ার সেলানগোর অঞ্চলের সাবেক চীফ জাস্টিস মোহাম্মদ মুখতার নেনি শুহাইদা বিনতি শামসুদ্দিনের নিয়োগ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা আমাদের বিচার ব্যবস্থায় সবচেয়ে সেরা লোকজনদের নিয়োগ দিয়ে থাকি।’
এদিকে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান এবং সুদানে শরিয়া আদালত বিদ্যমান রয়েছে এবং এইসমস্ত আদালতে যদিও ইসলামিক আইন দ্বারা বিচার পরিচালনা করা হয় কিন্তু এগুলোতে নারী বিচারকদের নিয়োগ দেয়ার নজির নেই।
২০০৬ সালে মালয়েশিয়ার ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ একটি ফতোয়া জারি করে নারীদের জন্য শরিয়া আদালতের বিচারক নিয়োগ হওয়ার বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা দূর করে।
শারিনা শেরিফ বলেন, ‘যদিও শরিয়া আদালতসমূহে নারী বিচারকদের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় অনেক বেড়েছে কিন্তু পুরুষ বিচারকদের তুলনায় এ সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।’
নারীরাও আবেগ সরিয়ে রাখতে পারেন : মালয়েশিয়ায় একজন মুসলিম পুরুষ ইচ্ছা করলে চারজন মহিলাকে বিবাহ করতে পারেন কিন্তু তাদেরকে এ জন্য শরিয়া আদালতের অনুমতি গ্রহণ করতে হয়।
বিনতে শামসুদ্দিন বলেন, তিনি এ ধরনের মামলা বা আবেদন শুনানির সময় আবেদনকারী ব্যক্তির আয় এবং সক্ষমতা বিবেচনা করেন, যাতে করে তিনি একের অধিক স্ত্রীর সকল চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হন। এমনকি পূর্বের স্ত্রীর অনুমতি রয়েছে কিনা সে বিষয়টিও দেখা হয়।
বিনতে শামসুদ্দিন বলেন, ‘যদি পূর্বের স্ত্রীর সম্মতি থাকে এবং স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে উপযুক্ত হন তখন আমি অনুমতি দিয়ে থাকি।’
বিনতে শামসুদ্দিন অবশ্য ‘খালাওয়াত’ মামলার শুনানি করেন। এটি হচ্ছে এমন এক ধরনের অপরাধ যেখানে অবিবাহিত নারী এবং পুরুষকে একসাথে কোনো বদ্ধ ঘরে একাকী পাওয়া যায়।
বিনতে শামসুদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত তিনি সবচেয়ে গুরুতর শাস্তি দিয়েছিলেন একটি মামলায়। সেই মামলায় তিনি অপরাধীকে ৬ বার বেত্রাঘাত, ৫,০০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত এবং এক মাসের কারাদ- প্রদান করেন।
নেনি বিনতে শামসুদ্দিন আশাবাদী যে, যেভাবে শরিয়া আদালতে নারী বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে শরিয়া আইনের ক্ষেত্রে পুরুষ শাসিত দিকের পরিবর্তন ঘটবে। এবং একই সাথে এ ধরণারও পরিবর্তন ঘটবে যে, শরিয়া আদালত নারীদের জন্য উপযুক্ত ন্যায় বিচার প্রদান করে না।
তিনি বলেন, ‘জনসাধারণের মধ্যে এই ধারণা রয়েছে যে, পুরুষ বিচারকেরা নারীদের প্রতি সুবিচার করেন না। আমি আশা করি শরিয়া আদালতে নারী বিচারক নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে এ ধরাণার অবসান ঘটবে।’
গত পাঁচ বছরে মালয়েশিয়া শরিয়া আইনজীবী এসোসিয়েশনের সদস্যদের মধ্যে নারী আইনজীবীর সংখ্যা ৪০ শতাংশ হারে বেড়েছে।
সাদিহা বিনতে দিন নামের নারী আইনজীবী শরিয়া আদালতে আইন চর্চা করার পূর্বে ধর্ম নিরপেক্ষ আদালতে আইন চর্চা করতেন।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে শরিয়া আদালতে আইন চর্চা করাটা আমার আইন পেশার জন্য একটি মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মত ব্যাপার।’ তার ভাষায় নারী মক্কেলগণ শরিয়া আদালতে নারী বিচারকের সামনে তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি শরিয়া আদলতে নারী বিচারক নিয়োগ দেয়ার ফলে ভুক্তভোগী নারীরা পূর্বে তুলনায় অনেক বেশি ন্যায় বিচার পাবেন।’
সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ নাইম যিনি বর্তমানে শরিয়া আদালতে বিচার কার্য পরিচালনা করেন, তিনি বলেন- তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে আইন পড়ান এবং সেখানে নারী শিক্ষার্থীরা পুরুষ শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো ফলাফল করছে।
২২ বছর বয়সী নুর ফারহানা নামের একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘ইসলামিক আইনের বেশিরভাগই এসেছে পবিত্র কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে এবং এ জন্যই আমি শরিয়া আইন পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠি।’
বিনতে শামসুদ্দিন স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নের সময় আইনজীবী হিসেবে আইন চর্চা করেছিলেন। বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়ার শরিয়া বিচার ব্যবস্থায় একটি সফল পেশা গড়ে তুলতে তরুণী নারীদেরকে উৎসাহ দিয়ে চলেছেন।
তিনি বলেন, ‘এই পর্যন্ত আসতে আমার অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমাকে পুরুষ অফিসারদের সাথে প্রতিযোগিতা করে আসতে হয়েছে। কিন্তু এখন আর তা পূর্বের মত নেই এখন সবকিছু যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয়।’