কওমির সনদের স্বীকৃতি, শোকরিয়া মাহফিল এবং রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক
সৈয়দ মবনু: বাংলাদেশের মৌলিক সমস্যাগুলোর মধ্যে আমাদের দৃষ্টিতে সবচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থায়। এবিষয়ে আমার পৃথক লেখা থাকায় এখানে সেদিকে আলোকপাত করছি না। এই একটি জায়গায় ত্রুটির কারণে আমাদের অনেক জায়গায় ঘাটতি স্পষ্ট। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ফার্মের মোরগের মতো প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষিত তৈরি করছে, কিন্তু এই শিক্ষিতরা তাদের শিক্ষাকে কর্মক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছেন না মেধাশূন্যতার ফলে। বাংলাদেশে যে ত্রি-ধারার শিক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, সবগুলোতেই একই অবস্থা। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির মূল সমস্যা হলো পরীক্ষায় পাশের উদ্দেশ্যে নোট মূখস্ত করে বিভিন্ন স্থরের প্লাস নিয়ে শিক্ষিত হওয়া। ফলে মূল বই-এ যে জ্ঞানগুলো রয়েছে তা থেকে শিক্ষিতরা বঞ্চিত হয়ে মেধাশূন্য হচ্ছে। তাই কর্মক্ষেত্রে যেদিকেই দৃষ্টি দেন না কেন, দেখবেন মেধাশূন্য লোকদের রাজত্ব।
বিশাল মানব সমাজে শৃঙ্খলার জন্য জাতি-গোষ্ঠিতে বিভক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু মূর্খ এবং মেধাশূন্য সমাজে যখন গোষ্ঠি ভিত্তিকতা গজিয়ে উঠে তখন তা হয়ে যায় মারাত্মক ক্ষতিকর বিষয়। বাংলাদেশে এই মেধাশূন্যতার ফলে গোষ্ঠি-ভিত্তিকতা সর্বক্ষেত্রে মারাত্মক ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে। এখানে কেউ এখন কিছুতে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সঠিক-বেঠিক পর্যালোচনা করে না, সবাই গোষ্ঠির চিন্তা-চেতনায় আলোচনা-সমালোচনা করতে থাকে। শ্রোতা এবং বক্তা যখন সমান তালের তখন কে কার ভুল সংশোধন করে দিবে? সবাই ফার্মের মোরগের মতো ফর্মার ভেতর একের পর এক মুখস্ত কথা বলে যাচ্ছেন, আর আমরাও ফর্মার ভেতর বসে তাদের পন্ডিত্য দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে তাদের কথাই সত্য মনে করছি। এভাবে চলছে যুগ যুগ থেকে। ফলে এখানে যা পরিবর্তন হচ্ছে সবই কাঠামোগত, কোথাও কোন পরিবর্তন হচ্ছে না চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আমরা বৃটিশ এবং ভারতের কাছ থেকে স্বাধীন হয়েছি; যা প্রকৃত স্বাধীনতা ছিলো না, ছিলো দেশ-বিভক্তি। ফলে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষার জন্য একটি সংগ্রাম এবং ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার জন্য একটি যুদ্ধের প্রয়োজন হলো। একাত্তরে আমরা স্বাধীন হই। স্বাধীনতার পর আমাদের যে কাজগুলো প্রথমে করার প্রয়োজন ছিলো তা আজও আমরা পূর্ণাঙ্গরূপে শুরু করতে পারিনি। প্রথমত উচিত ছিলো আমাদের ত্রি-ধারার শিক্ষা পদ্ধতিকে ভেঙে একটা নীতির মধ্যে নিয়ে আসা। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এমন একটি শিক্ষানীতিই প্রণয়ন করতে পারিনি যা দিয়ে এই ত্রি-ধারায় সমন্বয় করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত: আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে সক্ষম হলেও মানসিক স্বাধীনতার জন্য একটি চিন্তার বিপ্লব সংগঠিত করতে পারিনি। আমরা এমন একটি দর্শন আজও আমাদের জন্য তৈরি করতে পারিনি যা দিয়ে ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে গোটা জাতিকে সংঘবদ্ধ করা যেতে পারে। এই না পারার পিছনে মূল কারণ, আমাদের মধ্যে এমন কোন চিন্তকের জন্ম হয়নি যিনি অপ্রতিরোধ্য মেধাশীল মুক্তচিন্তার অধিকারী। অনেক মেধাশীল এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য না হওয়ায় তাঁর চিন্তা থেকে গোষ্ঠিতান্ত্রিকতার উর্ধে নতুন এমন কিছু বেরিয়ে আসতে পারেনি যা দিয়ে গোটা জাতির মধ্যে ঐক্যের একটি বীজ রোপন করা সম্ভব হতো।
আবুল মনসুর আহমদ এবং আহমদ ছফাকে এখানে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়, তাঁরা বাঙালি বা বাংলাদেশীদের বিবেকে বুদ্ধিভিত্তিক প্রথম কিছুটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের মতো এভাবে চিন্তামূলক নাড়া আর কেউ দিতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। তাঁদের পরে বাঙালীর চিন্তার জগতে কিছু কাজ শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফর্মা ভাঙার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কিন্তু কেউ যেন ফর্মা ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে পারছেন না গোষ্ঠিতান্ত্রিক লেজুর ভিত্তিকতার ফলে। বাংলাদেশে অসংখ্য গোষ্ঠিবদ্ধ পন্ডিত আমরা দেখি, যারা নিজ গোষ্ঠির চিন্তাকে অতিক্রম করে কিছু দিতে পারছেন বলে মনে হয় না। আমি তাদের কর্মকে শ্রদ্ধা করি, হোক তা গোষ্ঠিভিত্তিক। আমি মনে করি সকল গোষ্ঠির পন্ডিতদের চিন্তাকে সমন্বয় করলে নিশ্চয় এমন কিছু বেরিয়ে আসবে যা আমাদেরকে নতুন পথের সন্ধান দিবে।
কওমির স্বীকৃতি আওমীলীগ সরকার দিয়ে কৃতিত্ব তাদের জন্য নিয়েছে, যা ইচ্ছে করলে বিএনপির জোট সরকারও নিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি-জোট সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের বাস্তবতা হলো, সে কারো জন্য অপেক্ষা করে না, দাঁড়িয়ে থাকে না। সে চলতে থাকে নিজের গতিতে এবং সে যাকে ইচ্ছে তাকে তার বাহনে উঠিয়ে কৃতিত্ব দান করে এবং যাকে ইচ্ছে অপমানিত করে নিজের ঘরের বন্ধি করে রাখে।
বাংলাদেশে বর্তমানে খুব প্রয়োজন সমন্বয়বাদি একটি চিন্তক গ্রুপের, যাদেরকে আমরা দয়াদর্শনের ভাষায় আদর্শ নাগরিক বলতে পারি। দয়াদর্শনে আদর্শ নাগরিক তাকেই বলা হয়, যারমধ্যে সবর্দা জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম এবং প্রেমের সমন্বয় দেখা যায়, যিনি সর্বদা রাষ্ট্র এবং সরকারকে পৃথকভাবে বিবেচনা করেন, সবসময় নিজকে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি মনে করেন, সরকারের সাথে মতের ভিন্নতা থাকলেও তিনি রাষ্ট্রের মঙ্গল চিন্তা থেকে ভিন্ন হন না। যখন আদর্শ নাগরিকের সরকারের সাথে মতবিরোধ হয় তখনও তিনি সরকার পতনের চেষ্টা করলেও রাষ্ট্রের সম্পদ এবং মানুষের অমঙ্গল থেকে নিজকে রক্ষা করেন। যেমন হযরত ওমর (রা.) একজন আদর্শ নাগরিক ছিলেন, তিনি যখন ফিলিস্তিন অবরোধ করেন তখন তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে রাষ্ট্রের একটি গাছের পাতারও ক্ষতি করা না হয়। আদর্শ নাগরিক মনে করেন, সরকার রাষ্ট্রের সেবক বা পরিচালক মাত্র। সরকার পরিবর্তনশীল, রাষ্ট্র স্থায়ি। রাষ্ট্রের স্থায়ি পরিচালক বেতনধারী কর্মচারী বা আমলারা, আর আদর্শ নাগরিক হলেন রাষ্ট্রের অবৈতনিক স্থায়ি পরিচালক বা সেবক। সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু আমলা কিংবা আদর্শ নাগরিকের পরিবর্তন হয় না।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে আদর্শ নাগরিকদের মূল কাজ হবে, সকল গ্রুপের চিন্তাকে জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম এবং প্রেমের ভিত্তিতে সমন্বয় করে একটি জাতীয় চিন্তার পথে গোটা জাতিকে নিয়ে যাওয়া। বর্তমানে গোষ্ঠিতান্ত্রিকতা, আঞ্চলিকতা ইত্যাদি ত্যাগ করে চিন্তার সমন্বয়টা খুবই জরুরী। শিক্ষা ক্ষেত্রে ত্রি-ধারায় বাংলাদেশে যে আকাশ-পাতাল দূরত্ব ছিলো তা হয়তো কিছুটা হ্রাস পাবে কওমি মাদরাসার শিক্ষাকে সরকারী স্বীকৃতি দানের মধ্যদিয়ে। আওয়ামীলীগ সরকার তাদের শাসনকালে যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে তার মধ্যে এই কাজটি আমার দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষায় পদ্ধতিগত-মানগত দূরত্বের ফলে আমাদের নেতৃত্বেও চিন্তাগত দূরত্ব ছিলো, তা হয়তো ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। চিন্তাগত দূরত্ব দূর হলে হয়তো একদিন জাতি হিসাবে আমাদের মধ্যে কিছুটা মৌলিক বিষয়ে ঐক্য তৈরি হতে পারে। জাতীয় চিন্তার ঐক্যের জন্য এই স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, যার সু-ফল এই জাতি আগামীতে অনুভব করবে।
যারা এই স্বীকৃতির সমালোচনা করছেন তাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে, প্রথম গ্রুপ: যারা ইসলামপন্থী হলেও আদর্শগতভাবে কওমি আলেম বিরোধী। ওরা আবার দুই গ্রুপে বিভক্ত। ক-গ্রুপ; যারা দেওবন্দীদেরকে ওয়াহাবী মনে করেন। খ-গ্রুপ; জামায়াতে ইসলামী। দ্বিতীয় গ্রুপ-ইসলাম বিদ্বেষীগ্রুপ। এখানে তৃতীয় আরেকটি গ্রুপ রয়েছে, যারা কওমিরই অংশ, তবে জামায়াত-বিএনপি জোটের সাথে সম্পৃক্ত। ওদের সমস্যা হলো, সফলতার কৃতিত্ব নিয়ে গেলো আওয়ামীলীগ সরকার, তাদের জোটের পক্ষে এই কৃতিত্ব নেওয়া সম্ভব হলো না। তারা আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন না, এই স্বীকৃতিতে তাদের অবদান রয়েছে, কৃতিত্ব রয়েছে। জামায়াত কিংবা দেওবন্দ বিরোধী ইসলামিক গ্রুপগুলোর বিরোধীতা আকিদা বা আদর্শগত কারণে হলেও জামায়াত-বিএনপি জোটের সাথে সম্পৃক্ত কওমি গ্রুপগুলোর বিরোধীতা শুধু জোটের চামচামী ছাড়া কোন আদর্শিক কারণে নয়। বিরোধীতাকারিদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে আসে তাদের ভেতরের জ্বালাসমূহ। যারা শুধু আওয়ামীলীগের বিরোধীতার জন্য কওমির স্বীকৃতির বিরোধীতা করছেন তারা মূলত মূর্খতা এবং মেধাশূন্যতারই পরিচয় দিচ্ছেন। কওমির স্বীকৃতি আওমীলীগ সরকার দিয়ে কৃতিত্ব তাদের জন্য নিয়েছে, যা ইচ্ছে করলে বিএনপির জোট সরকারও নিতে পারতো। কিন্তু বিএনপি-জোট সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের বাস্তবতা হলো, সে কারো জন্য অপেক্ষা করে না, দাঁড়িয়ে থাকে না। সে চলতে থাকে নিজের গতিতে এবং সে যাকে ইচ্ছে তাকে তার বাহনে উঠিয়ে কৃতিত্ব দান করে এবং যাকে ইচ্ছে অপমানিত করে নিজের ঘরের বন্ধি করে রাখে। যে কৃতিত্ব বিএনপি-জোট সরকারে পাওয়ার কথা ছিলো সেই কৃতিত্ব পেয়েছে আওয়ামীলীগ সরকার, ব্যবধান এতটুকুই। তবে কাজটি ছিলো রাষ্ট্রের। সরকার তো রাষ্ট্রের সেবক বা পরিচালক মাত্র।
স্মরণ রাখতে হবে, এখানে শেখ হাসিনা বিষয় নয়, বিষয় হলো রাষ্ট্রের কর্ণদার প্রধানমন্ত্রী। বিশাল আয়োজনে কারো কারো বক্তব্যে অতি আবেগ ফূটে ওঠেছে, তা সত্য। বক্তব্যে দু-একটা ভূল থাকলেও থাকতে পারে। তবে তা তেমন মারাত্মক নয় যা দিয়ে এই মাহফিলকে অকৃতকার্য প্রমাণ করা যাবে।
কওমির স্বীকৃতি দানের ফলে কওমী শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে বিশাল একটি শোকরিয়া মাহফিল হয়েছে। প্রশ্ন হলো এই শোকরিয়া কার প্রতি। কওমির অনেক নেতা বলছেন, তা আল্লাহ এবং সরকার প্রধানের শোকরিয়া, আর কেউ কেউ বলছেন শুধু আল্লাহর শোকরিয়া। দুটাই শুদ্ধ। কেউ যদি সরকারের শোকরিয়া জ্ঞাপন করে তাতেও আল্লাহর শোকরের পর সরকারের শোকরিয়ায় আসবে। কারণ, ‘আশ-শুকুরু’ আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে এই নামের ছায়া তাঁর মধ্যে থাকতেই পারে। তবে সে কখনও কোনক্ষেত্রে সার্বভৌমের উপযুক্ত নয়। তাই কেউ কারো বা কোন প্রতিনিধির শোকর আদায় করলেই তা প্রথমে সার্বভৌম আল্লাহর দিকেই নিসবত বা ইঙ্গিত করবে। তাই, এই শোকরিয়া মাহফিল মূলত আল্লাহর কাছে শোকরিয়ার অংশই ছিলো। যে কারো সাহায্য-সহযোগিতার শোকর আদায় করে না তাকে ইসলামি বিধানে নাশোকরকারি অকৃতজ্ঞ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অকৃতজ্ঞদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। তাই কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতির পর এমন একটি শোকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা মাহফিলের প্রয়োজন ছিলো বলে আমরা মনে করি। স্মরণ রাখতে হবে, এখানে শেখ হাসিনা বিষয় নয়, বিষয় হলো রাষ্ট্রের কর্ণদার প্রধানমন্ত্রী। বিশাল আয়োজনে কারো কারো বক্তব্যে অতি আবেগ ফূটে ওঠেছে, তা সত্য। বক্তব্যে দু-একটা ভূল থাকলেও থাকতে পারে। তবে তা তেমন মারাত্মক নয় যা দিয়ে এই মাহফিলকে অকৃতকার্য প্রমাণ করা যাবে। বরং যারা অতিমাত্রায় সমালোচনা করছেন, তা মূলত নিজেদের মূর্খতা এবং মেধাশূন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন।