কষ্ট করুন তবুও ঋণী হবেন না
খান আখতার: সীমিত আয়ের এক চাকরিজীবী। বেতন যা পান তা দিয়ে সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে মাসের ১৫/২০ তারিখে টাকা ধার করে চলতে হয়। পরবর্তী মাসে বেতন পেয়ে দেনা পরিশোধ করার পর হাতে তেমন টাকা থাকে না। এভাবে কোন রকমে চলছিল তার সংসার। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ঈদের বাজার করার পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় সে তাঁর এক ধনাঢ্য বন্ধুর কাছে টাকা ধার চাইলো। ধনাঢ্য বন্ধুটি তার চাকরিজীবী বন্ধুর চাহিদা অনুযায়ী নগদ ৫,০০০/- (পাঁচ হাজার) টাকা তাকে ধার দিলেন। তখন চাকুরিজীবী বন্ধুটি টাকা হাতে নিতে নিতে অত্যন্ত খুশী হয়ে হাস্যচ্ছলে ধনাঢ্য বন্ধুটিকে বলেছিলেন যে, “তোর এ ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না”। এরপর প্রায় এক বছর পার হতে চলেছে। ধনাঢ্য বন্ধুটি দেখলেন যে, তাঁর ঐ চাকরিজীবী বন্ধু সে-ই যে গত ঈদের আগে ৫,০০০/- টাকা ধার নিয়ে তা আর ফেরৎ দিলেন না। এদিকে আর এক ঈদ এসে গেল। এমতাবস্থায় ধনাঢ্য বন্ধু তাঁর চাকরিজীবী বন্ধুর কাছে টাকা ফেরৎ চাইলেন। কিন্তু তিনি টাকার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ভাবখানা এমন দেখালেন যে, বলিস কিরে তুই টাকা পাবি-আ-আ-আমার কাছে। হে-হে-হে শব্দে হেসে উঠলেন ঋণী বন্ধুটি। ধার দাতা ধনাঢ্য বন্ধু তো অবাক! কেন, গত ঈদের আগে তুই ৫,০০০/- টাকা আমার কাছ থেকে ধার নিস নি? বলেই পাল্টা প্রশ্ন করলেন বন্ধু। এবার কিছুটা ভেবে চাকরিজীবী বন্ধু বললেন, ও-হ্যাঁ-টাকা? মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। উ-উ-হু, টাকা—৫,০০০/- তোর কাছ থেকে এনেছিলাম ঠিকই মনে হয়েছে। তবে আর একটা কথা সেই সাথে মনে পড়েছে। আর তা হচ্ছে, টাকা হাতে নিয়ে আমি বলেছিলাম যে, “তোর এ ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না”। আর তাই তো আমি এতদিন তোকে টাকাগুলো দেই নি এবং কোন দিন দেবোও না। আর না হোক কথার হেরফের আমি করতে শিখিনি। এই বলে চাকরিজীবী বন্ধুটি তার ঋণের বোঝা হালকা করতে চেষ্টার ত্রুটি করলেন না। একথা শুনে ধনাঢ্য বন্ধু বিস্ময়ে চোখ জোড়া কপালে তুললেন।
গল্পটা যাঁদের জানা নেই তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ করছি যে, দয়া করে টাকা ধার দেবেন না বা নেবেন না। কারণ টাকা-পয়সা ধার দেয়া-নেয়া করলে এক পর্যায়ে মনোমালিন্য হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই এ ব্যাপারে রীতিমত স্থায়ী আদেশ থাকা উচিৎ যে, “টাকা ধার দেয়া বা নেয়া যাবে না”। এ নিয়ম সর্বত্র চালু হলে ভাল হত কী মন্দ হত সেটা বিবেচনার ভার সম্মানিত পাঠক, আপনাদের উপর রইলো। তবে এ অভ্যেসটা যে, ভাল নয় এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বেঁচে থাকার তাগিদে অর্থ বা আয় রোজগার করা অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। এক্ষেত্রে কারো আয়ের মাত্রা কম আবার কারো আয়ের মাত্রা বেশী। যাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী তাদের প্রয়োজন মেটাতে কোন না কোন বিকল্প রাস্তা খুঁজতে হয়। ধার-কর্জ করা বিকল্প রাস্তাগুলোর মধ্যে একটি। বলা যায় ঠেকায় পড়ে অনেক সময় আমরা এ কাজটি করে থাকি। এই ধার দেয়া-নেয়াটা যদি যথাসময়ের মধ্যে শোধবাদ হয়ে যায় অর্থাৎ পরিশোধ হয়ে যায় তাহলে ঝামেলা বাঁধে না মোটেই। আমার বয়সে টাকা-পয়সা ধার দেয়া-নেয়া নিয়ে অনেক গ-গোল ফ্যাসাদ হতে দেখেছি ও শুনেছি। এমনকি অনেক আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে চরম ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর্যায়ে চলে যেতে দেখেছি। অনেকের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে। এরপর তারা হয়েছে একে অপরের শত্রু। যিনি টাকা ধার দিয়েছিলেন তিনি কী যেচে বলেছিলেন যে, “কারো টাকা ধার লাগবে নাকি? লাগলে ধার নিয়ে যাও।” যখন পার তখন দিও। বরং ধার-কর্জ যিনি নিয়েছিলেন তিনি কোন না কোন সমস্যায় পড়েই টাকা ধার চেয়েছিলেন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব এবং এটাই হয়। এখন কথা হচ্ছে তাকে সাহায্য করাই সামাজিক দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। তাই বলে সাহায্যকারী টাকা ধার দিয়ে অন্যায় কিছু করেন নি। পক্ষান্তরে যিনি ধার কর্জ করেন তিনিই বা কী দোষ করেছেন? সমস্যায় না পড়লে তো আর ধার করার প্রয়োজন হতো না। তবে কথা হলো বিপদ যখন উদ্ধার হয়েছে তখন সময়মত টাকা পরিশোধ করে দিলেই তো সব ল্যাটা চুকে যেতো। যাহোক, যে সব ক্ষেত্রে টাকা-পয়সা ধার গ্রহণ-প্রদানে অনিয়ম হয় তার কিছু ধারণা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
* ধার গ্রহণকারী ব্যক্তি টাকা ধার নেয়ার পর বার বার একই সমস্যায় বা নতুন নতুন সমস্যায় পড়লে এমন হতে পারে।
* টাকা ধার নিয়ে পরিশোধ না করাটাই তার অভ্যাস।
এক্ষেত্রে যিনি টাকা ধার করলেন তাকে টাকা পরিশোধের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। যদি কোন কারণে সময়মত টাকা পরিশোধে সমস্যা হয় তাহলে যথাসময়ের আগেই টাকা ধার প্রদানকারীকে সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে এবং আরও কিছু সময় চেয়ে নিতে হবে। বর্ধিত সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে পারলে কোন ঝামেলাই আর থাকে না। সবচেয়ে ভাল হয় যদি টাকা ধার না করে পারা যায়। এজন্য আমাদের প্রত্যেককেই হিসেবী হতে হবে। আজকাল যে অবস্থা তাতে চুলচেরা হিসেব নিকেশ করেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। কোনভাবে হিসেবের বাইরে একটু বেশী ব্যয় হলেই ঘাটতি পড়ে, যা সহজে কাটিয়ে ওঠা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।
প্রসঙ্গত, একটা বাস্তব গল্প বলা প্রয়োজন। আমার এক ভাগ্নে মোঃ সাইফুল ইসলাম-এর কাছে তারই এক বন্ধু (সেও সাইফুল ইসলাম) ২০,০০০/- টাকা ধার চাইলো। ভাগ্নে ভাল করেই জানে যে, তার বন্ধুটি বেকার। টাকা ধার দিলে সহজে সে পরিশোধ করতে পারবে না। অথচ টাকা না দিলে বন্ধুটি অবশ্যই মনে কষ্ট পাবে। এমন কি বন্ধুত্ব নষ্ট হতে পারে। ভাগ্নেটি দেখলো যে, বন্ধুত্ব যখন ঠিক রাখা যাচ্ছে না তখন টাকা ধার না দেয়াই উত্তম। এতে বন্ধুত্ব না থাকলেও টাকা গুলোতো থাকছে। শেষতক টাকা দেয়া-নেয়া আর হয় নি। যা হয়েছে তা হলো দুজনের মধ্যে কিছুদিনের জন্য কথা বন্ধ থেকেছে। এরপর মনের ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট কিছুটা মিটে যেতে থাকায় দু’জনের সাথে আবার অল্প অল্প কথা বলা শুরু হয়েছে। বলা যায় বন্ধুত্ব এখন আরও গাঢ় হবার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে ভাগ্নেটি আমার। “আপন ধন পরকে দিয়ে বামুন মরে হতাশ হয়ে” এমন কাজটি করা আদৌ ঠিক নয়। আর একটি কথা না বললেই নয় যে, টাকা ধার প্রদানকারী ব্যক্তি টাকা ধার দেয়ার আগে যেন ভাল করে বুঝে দেখেন প্রার্থীত ব্যক্তিকে টাকা ধার দিলে তা সহজে ফেরৎ পাওয়া যাবে কিনা এবং এ নিয়ে কোন ঝামেলা হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে কী-না? তাহলে হয়তো এ সমস্যা কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব। আমরা অনেকে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করি। এটাও এক ধরনের ধার। তবে এটা আরও মারাত্মক বলে মনে করি। ব্যাংকের নিয়ম-কানুন মেনে নিয়ে সুদে লোন বা ঋণ গ্রহণ করে সময়মত তা পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ খেলাপী হিসেবে সহায় সম্পত্তি হারাতে হতে পারে। তখন অবস্থা হয় আরও মারাত্মক।
অনেকে টাকা ধার করে বা ব্যাংক লোন নিয়ে পরিশোধ করার আগেই মারা যান। ফলে সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যদের কাছে ঐ ঋণ অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। ঋণের বোঝা টানতে না পেরে তাদেরকে কঠিন সমস্যায় পড়ে মানবেতর জীবন যাপনও করতে হয় কারো কারো। অনেকে টাকা ধার করে বিয়ে করেন বা মেয়ের বিয়ে দেন-যৌতুক দেন। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের পর খরচ আরও বাড়তে পারে। তখন ঋণ পরিশোধ করা আরও কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে ধার কর্জ না করাই শ্রেয়। মুরুব্বীদের বলতে শুনেছি যে, ধার করে বিয়ে করো না বরং ধার করে সম্পত্তি করো। যা একদিন কাজে লাগবে। স্বাবলম্বী হয়ে বিয়ে করলে জীবনে পস্তাতে হয় না। ধার-কর্জ করা জামাই কে ঘরের বউ, আত্মীয়-স্বজন কেউ ভালো চোখে দেখেন না। ধার করে পড়ালেখা করলে অবশ্যই তারও একটা ভবিষ্যত আছে। ভাল দিক আছে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
মোদ্দাকথা একেবারেই উচিত নয়। ধার করে বড় হওয়া যায় না সামনে এগুনো যায় না। এটা ভাল কাজ নয়। বরং আপনি যা কিছু আয় করেন তা থেকে অল্প অল্প করে বাঁচিয়ে জমানোর চেষ্টা করুন। একদিন দেখবেন ঐ জমাকৃত অর্থ বড় অংকে দাঁড়িয়েছে। যেমনটি বিন্দু বিন্দু জলে বিশাল সিন্ধু নদে পরিণত হয়। তখন আপনাকে আর ধার করতে হবে না। এজন্য প্রথমে আপনার কিছুটা হলেও কষ্ট স্বীকার করতে হবে। মন চাইবে অনেক কিছু খরচ করতে। মনকে তখন চেক দিতে হবে সাময়িক কায়দায়। মনের সব চাহিদা পূরণ করা যাবে না। মনের প্রতি নির্দয় হতে হবে। পাষাণ হতে হবে। তবেই আপনি পারবেন।
একথা মনে মনে ভাবুন যে, যিনি আপনাকে টাকা ধার দিবেন, যার কাছে টাকা ধার চাইবেন, তিনি কোন অবস্থা থেকে সংগ্রাম করে ওঠে এসেছেন। তিনি পারলে আপনি কেন পারবেন না? পারতে আপনাকে হবেই-হবে। মনে করতে হবে জগতে অসাধ্য কিছু নেই, তাহলেই পারবেন।
আরও একবার কড়জোড়ে মিনতি করছি, “দয়া করে ধার কর্জ করবেন না”। কষ্ট করুন তবুও না। আজ এ মুহূর্ত থেকে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করুন। সফল হবেনই হবেন ইনশাল্লাহ।