আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ধরাশায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
নিম্নকক্ষ ডেমোক্রেটদের, উচ্চকক্ষ রিপাবলিকানদের দখলে, পাশাপাশি সাফল্যের অভিযাত্রায় মুসলিমরাও
আহমেদ রাশিদ, নিউয়র্ক: মার্কিন শাসনব্যবস্থার শীর্ষে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট। ওই পদের মেয়াদ চারবছর। প্রতি চারবছর অন্তর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। তাতে যিনি জয়ী হন, দু’বছরের মাথায় আরো একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। সেটিকেই মধ্যবর্তী নির্বাচন বলা হয়। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে মানুষের কী ধারণা, তাঁর কাজকর্ম পছন্দ হচ্ছে কিনা, দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা কতটুকু,এই নির্বাচনেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছিল। তাতে বিপুল ভোটে জয়ী হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দেশের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একটা অংশের কাছে যা অপ্রত্যাশিত ছিল। কারণ রিপাবলিকানদের তরফে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনীত হওয়া থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত— একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু ৯ নভেম্বর ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর সব হিসাব পাল্টে যায়। ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়ী হন ট্রাম্প।
তারপরেও বিতর্ক থামেনি। ২০১৭-র ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেওয়ার পরই অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি শুরু করেন। স্বাস্থ্য বিল হোক বা কর্মক্ষেত্রে সন্তান সম্ভবা মহিলাদের সুযোগ-সুবিধা, একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মমাফিক গেল ৬ই নভেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত একসাথে ৫০টি অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মধ্যবর্তী নির্বাচন।
সেই নির্বাচনে মার্কিন কংগ্রেস দুইভাগে বিভক্ত। একটি অংশ রিপাবলিকানদের দখলে এবং অন্যটি ডেমোক্র্যাটদের। এ অবস্থায় বিশ্বের অনেক মানুষ বুঝতে পারছেন না ক্ষমতা আসলে কার। এজন্য তারা গুগলের সাহায্য নিচ্ছেন। এছাড়া অনেকেই মধ্যবর্তী নির্বাচন সম্পর্কেও স্পষ্ট কোনও ধারণা রাখেন না।মধ্যবর্তী নির্বাচনে উচ্চকক্ষ বা সিনেট মোট ১০০টির মধ্যে রিপাবলিকানরা ৫১টি পেয়ে তাদের দখলে নিয়েছে।আর ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ৪৬টি। অপর দিকে হাউজ অফ রিপ্রেজেন্ট্রিটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটরা ৪৩৫টির মধ্যে ২২৩টি পেয়ে তাদের দখলে নিয়েছে। সেখানে রিপাবলিকানরা পেয়েছে ১৯৯টি।অন্যদিকে পঞ্চাশটি স্টেটের গভর্নর পদে মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানরা পেয়েছে ২৬টি আর ডেমোক্র্যাটরা পেয়েছে ২৩টি। তবে কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের ফলাফল এখনও আসেনি।
হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস বা নিম্নকক্ষ: কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ ৪৩৫ জন প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত। এদের প্রত্যেকের মেয়াদ দুই বছর। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার অনুপাতে সেখানে নিম্নকক্ষের প্রতিনিধি কতজন হবে তা নির্ধারণ করা হয়। প্রত্যেক প্রতিনিধি তার নিজের অঞ্চলের হয়ে কাজ করেন।
নিম্নকক্ষের সদস্যরা সরকারি কর্মকর্তাদের অভিশংসন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন। এছাড়া ব্যয় সংক্রান্ত বিল তৈরির ক্ষমতাও রয়েছে তাদের। এবার নিম্নকক্ষে ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেশি হওয়ায় বিভিন্ন ব্যয় নির্বাহের বিষয়ে সিনেটর বা উচ্চকক্ষের সদস্যদের ওপর চাপ তৈরি করতে পারবে তারা। আর এদের চাপে হয়তো নিজেদের সমর্থকদের বিপরীতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সিনেটরদের।
সিনেট বা উচ্চকক্ষ: সিনেট বা উচ্চকক্ষকে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর কারণ হলো উচ্চকক্ষের সদস্য সংখ্যা নিম্নকক্ষের চেয়ে অনেক কম। তার ওপর সাংবিধানিকভাবে এদের অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
সিনেটে সব মিলিয়ে ১০০ জন সদস্য রয়েছেন। প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে দুজন করে সিনেটর নির্বাচিত হন। এদের মেয়াদ ৬ বছর।
সংবিধান সিনেটরদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষমতা দিয়েছে। সে হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কে হবে তা নির্ধারণ করে উচ্চকক্ষ বা সিনেট সদস্যরাই। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নির্বাচন এবং বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি সম্পাদন করেন এরাই।
যদিও অভিশংসন প্রক্রিয়া প্রথম শুরু হয় নিম্নকক্ষে, তারপর সেটা উচ্চকক্ষে আসে। অভিশংসনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের সদস্যরা অনেকটা জুরি বোর্ডের মতো কাজ করে। কোনও প্রেসিডেন্টকে সরাতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরের সমর্থন লাগে।
ক্ষমতা কার বেশি: কার ক্ষমতা বেশি এই আলোচনার পর অবশ্য পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এ সম্পর্কে রটগার্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বেকারের একটি বক্তব্য প্রাসঙ্গিক। বেকার বলেন, যদিও উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের দায়িত্ব প্রায় একই তারপরও সাংবিধানিকভাবে তাদের (সিনেটরদের) আলাদা কিছু বিশেষত্ব রয়েছে।
মূলত কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের খুব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। উচ্চকক্ষে নমিনেশন ও বিভিন্ন চুক্তি সম্পর্কিত এবং নিম্নকক্ষে কর ও ব্যয় নিয়ে কাজ করতে হয়।
মধ্যবর্তী নির্বাচনে সাফল্যের অভিযাত্রা মুসলিমরাও: যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দুজন মুসলিম নারী ও একজন পুরুষ এটর্নী জেনারেল নির্বাচিত হয়েছেন।
তারা হলেন- ফিলিস্তিন বংশাদ্ভুত রাশিদা তালিব, সোমালি বংশাদ্ভুত ইলহান ওমর ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এটর্নী জেনারেল কেইথ এলিসন।
ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে তালিব কংগ্রেসের ১৩ নম্বর আসন থেকে জয় পান। অপরদিকে একই দলের হয়ে ওমর কংগ্রেসের ৫ নম্বর আসনে জয় পান। ওমরের আগে এই আসনে কংগ্রেসে প্রথম মুসলিম প্রার্থী হিসেবে কেইথ এলিসন জিতেছিলেন। রাষ্ট্রীয় অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়ার দৌড়ে অংশ নিতে গিয়ে তাকে আসনটি ছাড়তে হয়েছিল।
রাশিদা তালিব ফিলিস্তিন অভিবাসী বাবা-মার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মিশিগানের আইনসভায় ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তিনি প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে ইতিহাস গড়েছিলেন। অপরদিকে ইলহান ওমর সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ১৪ বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন।
আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম মুসলিম এটর্নি জেনারেল নির্বাচিত হয়েছেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কেইথ এলিসন।তিনি মেনিসোটা স্টেটের এটর্নী জেনারেল। উল্লেখ্য এর আগে তিনি একই স্টেট থেকে দুইবার কংগ্রেসম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসে ইতিপূর্বে আরো বেশ ক’জন মুসলিম কংগ্রেস ও সিনেটর (পুরুষ) নির্বাচিত হয়েছিলেন।
দুই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতের অবিস্মরণীয় সাফল্য: জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর হয়েছেন বাংলাদেশি আমেরিকান শেখ রহমান। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে সিনেট ডিস্ট্রিক্ট-ফাইভ থেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বিকে ধরাশায়ী করেন তিনি। জর্জিয়া স্টেট সিনেটর পদে এই প্রথম নির্বাচিত হলেন কোন বাংলাদেশি আমেরিকান। কিশোরগঞ্জের সন্তান শেখ রহমান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য।
অন্যদিকে নিউ হ্যামশায়ার স্টেট সিনেটর পদে পুনঃরায় জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশি-আমেরিকান আবুল খান। রিপাবলিকান পার্টি ডিস্ট্রিক্ট-টুয়েন্টি থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদের জন্যে স্টেট সিনেটর হলেন বরিশালের ভান্ডারিয়ার সন্তান আবুল খান।
উল্লেখ্য, আবুল খানই একমাত্র রিপাবলিকান যিনি মার্কিন প্রশাসনে উচ্চ পর্যায়ের নির্বাচিত বাংলাদেশি।
উল্লেখ্য যে এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে হাউজ অফ রিপ্রেজেন্ট্রেটিভস বা প্রতিনিধি পরিষদে বিপুলসংখ্যক নারী বিজয়ী হয়েছেন। প্রতিনিধি পরিষদে ৯৬জন নারী নির্বাচিত হয়ে চমকে দিয়েছেন সমগ্র আমেরিকানদের। নারীদের এই সংখ্যা আগে ছিল ৮৫।