আল্লামা ইকবাল: স্বাধীন কাশ্মির আন্দোলনের ‘ফাউন্ডার’
জি. মুনীর: একজন নেতা, লেখক কিংবা কবির জীবনে স্মরণীয় দিনটি আসে তখন, যখন তিনি দেখতে পান তার ধারণা বাস্তব রূপ নিয়েছে। মহাকবি ইকবাল সে দিনটি পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেননি, যেদিন দক্ষিণ-এশিয়ায় তার স্বপ্নের স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্রের স্বপ্ন বস্তবে রূপ নেয় ১৯৪৭ সালের ১ আগস্ট। তিনি মুসলিম লীগ নেতাদের গ্যালাক্সির কোনো অংশ ছিলেন না, যারা ১৯৩০ সালের ২৪ মার্চ লাহোরের মিন্টু পার্কে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে আগ্রহী জনতা সমবেত হয়েছিল ইকবালের ‘মুসলিম হোমল্যান্ড’ ধারণাকে স্বাগত জানাতে। এই ধারণা কবি ইকবাল দিয়েছিলেন ১৯৩০ সালের ৩০ ডিসেম্বর, এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে। তার এই ধারণা এই সম্মেলনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। তার এই লাহোর প্রস্তাব এখন পাকিস্তানে পরিচিত ‘ছধৎধফধফ-ব-চধশরংঃধহ’ নামে। এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দুই বছর আগেই তিনি এই জাগতিক দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। তার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন ছিল সেটি, যখন জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণ বিদ্রোহ করেছিল বর্বর সামন্ত স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। তিনি সেই দিনটিতে দেখতে পেয়েছিলেন, তার আলাদা ‘মুসলিম হোমল্যান্ডের’ স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়িত হবে।
ড. মুমতাজ হাসান বলেছেন, একদিন তিনি আল্লামা ইকবালের সাথে বসে কাশ্মিরের রাজনৈতিক লড়াই নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখন কথা হচ্ছিল ১৯২০ সালে কাশ্মিরের নিশারবাগে থাকাকালে তার লেখা ‘পয়াম-এ- মাশরিকির’ বইয়ের কবিতা ‘সাকি নামা’ নিয়ে। তখন আল্লামা ইকবাল তাকে বলেছিলেন, ‘এই কবিতার একটি পঙ্ক্তিতে আমি উল্লেখ করেছি সিল্ক কারখানা ও সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের সম্পর্কে। আমি অভিভূত হয়েছিলাম, কাশ্মিরের রাজনৈতিক লড়াই ১৯২৪ সালে সূচনা হয়েছিল এই রেশম কারখানার শ্রমিকদের এক বিদ্রোহের মাধ্যমে।’
ড. মুমতাজ জানিয়েছেন, তার কাছে ‘পয়াম-এ-মাশরিকি’র বইয়ের একটি কপি রয়েছে, যাতে আল্লামা ইকবালের স্বাক্ষর রয়েছে। এই কবিতার বইটি ছাপা হয়েছিল ১৯৩২ সালে। এর শুরুতেই রয়েছে ‘বারেশাম-কাবা’ নামের কবিতাটি। একই কবিতায় আল্লামা ইকবাল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন : ‘Bring revolution in the hearts of Kashmiris, so that they can leave with honour in this world….(Rozgar-e- Fiqar, page 359)। আল্লামা ইকবাল এক চিঠির মাধ্যমে একই কথা জানিয়েছেন মৌলভী আবদুল হকের কাছে (Allama Iqbal aur Abdul HaQ, Letters, page56)। এক বছর আগে কাউন্টার কারেন্টে প্রকাশিত একটি লেখায় শ্রীনগরের লেখক ও কলামিস্ট জেড. জি মাহমুদ ১৯০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইকবালের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন, তার দৃষ্টিতে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনে নবযুগ সূচনাকারী কবি আল্লামা ইকবাল ‘ফাউন্ডারের’ ভূমিকা পালন করেন। অস্বীকার করার উপায় নেই এ ক্ষেত্রে ইকবাল ছিলেন ‘গাইডিং লাইট’। ইকবালকে এমনটিই অভিহিত করেছেন কাশ্মির কমিটির আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত স্কলার হাফিজ মালিক। আসলে ইকবাল ছিলেন কাশ্মিরের জনগণের পক্ষে জনমত গঠন ১৯৩১ সালের ১৪ আগস্টে ‘কাশ্মির ডে’ উদযাপনে এক প্রেরণাশক্তি।
তখন গোটা ভারত থেকে মুসলমানেরা সে দিবস উদযাপনে সমবেত হয়েছিল কাশ্মিরের প্রতি সমর্থন জানাতে। সেখানে ইকবাল একটি আহ্বান প্রকাশ করেন, যাতে অন্য আরো কয়েকজন স্বাক্ষর করেছিলেন। এই আহ্বানটি ছিল এরূপ : ‘‘After attacking repeatedly the enemy has deluded itself into believing that Muslims are dead nation. To refute this misbelief, you must make the Kashmir Day a resounding success, By actions, Muslims must demonstrate that they were not going to be willing victims of their enemies injustice and repression’.
‘জুলাই ম্যাসাকার’ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ইকবালের মনে। এটি তার হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। তিনি সন্ত্রাসের শিকার লোকদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করেন। তিনি সংগৃহীত অর্থ কাশ্মিরের নেতাদের কাছে পাঠান। সেই সাথে তিনি কিছু সুপরিচিত আইনজীবীদের কাশ্মির সফরের আহ্বান জানান। তিনি কারাগারে থাকা কাশ্মিরিদের আইনি সহায়তা দেয়ার আহ্বানও জানান। কর্তৃপক্ষ এসব নেতাদের বহিষ্কার করে। ড. ইকবালসহ আরো কিছু নেতাকে কাশ্মিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ড. হাফিজ মালিক তার লেখায় সবিশেষ উল্লেখ্য করেন- ‘ইকবালের কর্মতৎপরতার কারণে ব্রিটিশ সরকার নিয়োগ করেন গ্ল্যান্সি কমিশন। এই কমিশন এই রাজ্যে ব্যাপক তদন্তের পর বিভিন্ন ধরনের সাংবিধানিক সংস্কারের সুপারিশ করে।’
তখন ভারতের অনেক কাশ্মিরি বংশোদ্ভূত মুসলমান ছিল, যাদের কাশ্মির সম্পর্কে তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। এমনকি তাদের মধ্যেও ১৯৩১ সালের ১৪ আগস্টে কাশ্মির দিবসে মুসলমানদের সম্পর্কে ইকবালের ঝড় তোলা বক্তব্য এক জাগরণের সৃষ্টি করে। বিশেষত, জম্মু কাশ্মিরের মুসলমানদের ব্যাপারে পাঞ্জাবের মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি জাগরণ দেখা দেয়।
ড. ইকবাল বেশ কিছু কুৎসিৎ উদ্যোগ নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব উদ্যোগের মাধ্যমে কিছু মহল কাশ্মির কমিটিকে বিশেষ কোনো ধর্মীয় মতবাদ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল, যা আসলে ইসলামের প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। এর ফলে কাশ্মিরি মুসলমানদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হতে পারত, যা ইতোমধ্যেই তিনটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। তিনি কাশ্মির আন্দোলনকে ১৯২০ সালের খিলাফত আন্দোলনের সাথে সমীকরণ করেন, যার ফলে বাস্তবে কাশ্মির আন্দোলন জোরদার হয়। কাশ্মিরের জনগণকে সহায়তা দেয়ার জন্য ১৯৩৩ সালের ৩০ জুন তিনি এবং মালিক বরকত আলী একটি আহ্বান প্রকাশ করেন কাশ্মিরের লোকদের সহায়তা করতে ও তহবিল সংগ্রহ করতে। তাদের আহ্বান ছিল : ‘Kashmiris are an inseparable part of the Muslim Nations, and to separate their fate from our national destiny amounts to cosign the entire nation to self-destruction.’
১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়টা ইকবালের জীবনে ছিল একটি রগরগে সময়। এরই মধ্যে তিনি স্বীকৃতি পেয়ছেন মুসলমান নেতা ও চিন্তাবিদ হিসেবে। তা সত্ত্বেও, কাশ্মিরের বিষয়টি প্রাচ্যের এই দার্শনিক-কবির কাছে এতটাই প্রিয় ছিল যে, কাশ্মির নিয়ে কথা বলতে তিনি কখনোই ভোলেননি।
১৯৩২ সালে তিনি হন অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্সের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। লাহোরে এই কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণে তিনি আভাস দেন, কতটুকু গভীরভাবে কাশ্মির সমস্যা তাকে ভাবিত করে তুলেছিল। কিন্তু কাশ্মিরের লোাকেরা আট দশক ধরে যার কবিতা বারবার পাঠ করছে, সেই কাশ্মিরিরা ১৯৩৩ সালের ৭ জুন দেয়া তার বিবৃতির সারবস্তুর প্রতি কোনো মনোযোগ দেয়নি। তখন তার বিবৃতিটি ছিল : ‘I appeal to Muslims of Kashmir to beware of the forces that are working against them and uniting their ranks. The time for two or three Muslims political parties has not yet come. The supreme need of the moment is a single party representing all Muslims in the State.’
তার কথা হচ্ছে, কাশ্মিরের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক শত্রুতা দূর করতে না পারলে কাশ্মিরের মানুষের স্বার্থ কার্যকরভাবে আদায় করা যাবে না। কাশ্মির সম্পর্কে ড. ইকবালের এই সতর্কবার্তা আজকের দিনের কাশ্মিরের বিদ্যমান।