আবুধাবিতে ব্যতিক্রমধর্মী ইসলামী সংস্কৃতি ও শিল্প উৎসব
সংস্কৃতির চর্চাকে সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য শিল্পকলার গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করা যায় না। শিল্প কলার শক্তির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাদের নিজস্ব সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব। আর এই মাধ্যমের উপর ভিত্তি করে ইসলামি শিল্প শুধুমাত্র একটি নতুন পথের সন্ধান পাবে তা নয়, বরং এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ইসলামী সংস্কৃতি আরো বিকশিত হবে। বিশ্বব্যাপী অসাধারণ প্রতিভাবান মুসলিমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন যারা তাদের প্রতিভাকে কাজেলাগিয়ে ধর্ম বিশ্বাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে আমাদের সহায়তা করতে পারেন।
তাদের আধ্যাত্মিক, সৃজনশীল শক্তি এবং শৈল্পিক এই ভ্রমণের মাধ্যমে একটি প্রশ্ন এখন আমাদের সামনে উঠে আসে আর তা হচ্ছে- বর্তমানে ইসলামিক শিল্প বলতে আসলে কি বোঝায়? কেতাবি দিক থেকে ইসলামি শিল্পকলা বলতে শুধুমাত্র একক কোনো শৈলী বা একক কোনো স্টাইলকে বোঝায় না, বরং এটি বৃহৎ অর্থে বিভিন্ন ভূ-অঞ্চলের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝায়।
গত ১৪০০ শত বছর যাবত ইউরোপের স্পেন থেকে শুরু করে ভারতীয় উপমহাদেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ইসলামিক শিল্প গড়ে উঠেছে। খ্রিস্টানিটি, জুড়াইজম, হিন্দুইজম থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মের মত ইসলামি শিল্পকলা শুধুমাত্র মুসলিম শিল্পীগণ কর্তৃক বিকশিত হয় নি এবং তা ধর্মীয় শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। ইসলামি শিল্পকলা গড়ে উঠেছে নির্মাণ শৈলী, অলঙ্করণ শিল্পসহ অন্যান্য শৈল্পিক সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে একই সাথে মুসলিম এবং অমুসলিম শিল্পীগণ অবদান রেখেছেন। ইসলামিক শিল্পের এই আন্দোলন প্রথমে শুরু হয়েছে প্রাকৃতিক বিভিন্ন বস্তু দ্বারা শৈল্পিক ভাব প্রকাশের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে তা ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতি এবং প্রাকৃতিক ফুলের দৃশ্যায়নের মাধ্যমে বিকশিত হয়। সুতরাং যখন আমরা ইসলামিক শিল্পের বিষয়ে আলোচনা করবো তখন আমাদেরকে অবশ্যই এর বৃহৎ পটভূমির দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর ইসলামিক শিল্প বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন রকম করে ফুটে উঠেছে।
চলতি সপ্তাহে আবু দাবিতে ‘Al Burda’ নামে ইসলামিক সাংস্কৃতিক উৎসবের শুরু হয়েছে যার মাধ্যমে ইসলামিক শিল্পের অতীত এবং বর্তমানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ উৎসবের মাধ্যমে বৈচিত্র্যপূর্ণ ইসলামি শিল্পকলার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা কারা হয়েছে এবং একই সাথে সেখানে শিল্পীগণ সরাসরি অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন যার মধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতির গভীর মূল্যবোধের সাথে সকলকে পরিচিত করিয়ে দেয়া হচ্ছে।
নতুন নতুন ভূমি এবং নতুন জনগোষ্ঠীর নিকটে ইসলাম যত বেশী পৌঁছিয়েছে ইসলামিক শিল্পে তত বেশী নতুন ধারণা যুক্ত হয়েছে এবং নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এই শিল্প পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রেখেছে। ইসলামি এসব শিল্পকলা বর্তমানের এই পর্যায়ে আসতে কয়েক শতাব্দী সময় লেগেছে যা আমরা প্রায়শই এড়িয়ে যাই। ইসলামের শিক্ষা যেখানে যেখানে গিয়েছে ঠিক সেখানকার সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে স্থানীয় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে ইসলামি শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এর ফলাফল স্বরূপ ইসলামিক শিল্প সমসাময়িক বিভিন্ন দিকের সাথে মিল রেখে তার প্রভাব অব্যাহত রেখেছে।
উদাহরণ স্বরূপ দুবাই ভিত্তিক শিল্পী আল সেদের কথা ধরা যাক। যিনি প্রকাশযোগ্য ক্যালিগ্রাফির জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। আল স্বেদ আবুধাবিসহ বিশ্বের অনেক স্থানে স্প্রের মাধ্যমে দেয়ালে আঁকা আঁকি করে থাকেন। তিনি ২০ জন বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীকে নিয়ে আবুধাবি মিউনিসিপালিটি বিল্ডিং এর দেয়ালে অসাধারণ একটি ক্যালিগ্রাফি এঁকে বিখ্যাত হয়েছেন।
করিম জাবেরি নামের শিল্পী যিনি আলোক চিত্র এবং আলোর ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি করে থাকেন। তিনি তার ক্যালিগ্রাফিতে প্রাচীন আরবের কিছু ভাষা যেমন খুফিক এবং মাগরিবের ব্যবহার করে সেগুলোকে আরো ভাবপূর্ণ করে তোলেন। এ সমস্ত উদাহরণ হয়ত ঐতিহ্যবাহী শিল্পের বিপরীত মনে হতে পারে। আসল সত্য হচ্ছে ইসলামিক শিল্প শুধুমাত্র ধর্মীয় শিল্প বা ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শহরগুলোর নির্মাণ শৈলীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
Al Burda ইসলামি সংস্কৃতির উৎসবের মাধ্যমে ইসলামি শিল্পকলায় দক্ষ শিল্পীদের একই ফ্লাট-ফর্মে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। একই সাথে এ উদ্যোগ ইসলামি শিল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেসব শিল্পী তাদের সৃজনশীল শক্তির ব্যবহার করতে চান তাদের জন্য একটি অনন্য সুযোগ নিয়ে এসেছে। এধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতির একেবারে কেন্দ্রিক দিকসমূহ উঠে আসে এবং একই সাথে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে। এই উদ্যোগ ইসলামি সংস্কৃতিকে সংরক্ষণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে একে আরো শক্তিশালী করার জন্য উৎসাহ যোগাবে। ইসলামি শিল্পে তরুণ প্রজন্মের যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে তা এক নতুন মাত্রা পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম তাদের সৃজনশীল প্রতিভার মাধ্যমে ইসলামি ঐতিহ্যসমূহ তুলে ধরার মাধ্যমে এর সাথে নতুন প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটাচ্ছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের নতুন এই উদ্যোগের মাধ্যমে ইসলামি সংস্কৃতি বিকাশের জন্য আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করতে চায় যা ভবিষ্যতে আরো নতুন নতুন উদ্যোগ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করবে। Al Burda’ ইসলামিক উৎসবের মাধ্যমে আরব আমিরাতের সংস্কৃতি এবং জ্ঞান চর্চা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইসলামিক সংস্কৃতি এবং শিল্পের বিকাশের জন্য নতুন কৌশল এবং নীতি অনুসরণ করতে চায়। এসকল উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান চালু, নতুন দক্ষতা তৈরির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা এবং সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত করে সকলের জীবন যাত্রাকে আরো উন্নত করা। সংস্কৃতি এবং জ্ঞান চর্চা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ইসলামিক শিল্প এবং সংস্কৃতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়। একটি বৈশ্বিক ফ্লাট-ফর্ম তৈরির করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ভিত্তিতে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ইসলামি সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করা ‘Al Burda’ উৎসবের অন্যতম লক্ষ। আমরা আশা করি এ উৎসব সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামি সংস্কৃতি এবং শিল্পের বিকাশ এবং সচেতনতা তৈরীর ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে।
Al Burda উৎসবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৪৭ জন বিশেষজ্ঞ বক্তা বিভিন্ন বিষয়ের উপর ইসলামি ইতিহাস এবং ঐতিহ্য তুলে ধরেন। অনেক ধরনের উদ্দেশ্যের মধ্যে এ উৎসবের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে ইসলামি ঐতিহ্য শিক্ষা দেয়া যাতে করে তারা তাদের এসব ঐতিহ্যসমূহ উদযাপন করতে পারে কারণ ইসলামিক সংস্কৃতির সংরক্ষণ করার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য নতুন প্রেরণা রেখে যাওয়া।