বাংলাদেশে নারী অপরাধের কারণ ও তার প্রতিকার
উম্মে আইরিন: ইউরোপের শিল্প বিপ্লব সমাজ সংস্থায় পূর্ণ মাত্রার পরিবর্তন এনেছিল। শিল্প বিপ্লব সমাজকে নবতর ভিত্তিতে গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। শিল্প বিপ্লবোত্তর কালে নারী যখন সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় শ্রম করতে শুরু করেছিল, তখন নারী সমাজের মনে বিরাট বিপ্লব সূচিত হল এবং তাদের জীবন যাত্রায় আমূল পরিবর্তন সূচিত হলো। স্বোপার্জিত অর্থ সম্পদের তারা হল মালিক। সমাজ সমষ্টির সাথে তাদের কার্যক্রমের সম্পর্ক স্থাপিত হল। নারীরা এখন আর কোন ক্ষেত্রেই নিজদেরকে অস্তিত্বহীন এবং দুর্বল মনে করে না। তাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য পুরোপুরি ভাবে বিকশিত ও অনস্বীকার্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে সমাজ জীবনের সকল স্তরে নারীদের বিচরণ তাদেরকে অপরাধ জগতের সাথে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করেছে। অনেক সময় তাদেরকে সমাজের বিরুদ্ধে কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হতে হয়। অপরাধ হচ্ছে সমাজের বিরুদ্ধে মন্দ কাজ যা রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ ও শাস্তি যোগ্য। এমন শাস্তি যোগ্য অপরাধে পুরুষের পাশাপাশি বাংলার নারীদের একটা বিরাট অংশ বেশ জড়িয়ে পড়েছে।
যেহেতু বাংলার নারী সমাজ এখনও পুরোপুরি ভাবে পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, যে কারণে বাংলাদেশের পুরুষদের চেয়ে মহিলারা কম অপরাধে লিপ্ত হয়। নারী ও পুরুষদের অপরাধের তুলনা ৯৭:৩। গত শতাব্দীর শেষে ২০০০ সালে দেশের বিভিন্ন জেল খানায় মহিলা কয়েদীর সংখ্যা ছিল ১৮৯৯ জন। এ সব কয়েদীর মধ্যে সাজা প্রাপ্ত, বিচারাধীন ও নিরাপত্তা প্রহরায় আটক এই তিন ধরনের কয়েদী।
লক্ষ্য করা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালের মহিলারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। এমন কি মাদক দ্রব্য, যেমন হেরোইন, ফেনসিডিল, মারজুয়ানা ইত্যাদি পাচারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে কিছু নারী। এ ছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যেমন অনৈতিক ব্যবসা, হাইজ্যাকিং, স্মাগলিং জাল টাকার ব্যবসা নিষিদ্ধ অস্ত্র বহন ইত্যাদি নিষিদ্ধ অপরাধজনক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাস হতে ডিসেম্বর এই অল্প সময়ে মহিলাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া সংক্রান্ত ৩৪০টি রিপোর্ট ১২টি জাতীয় এবং ১৯৮টি আঞ্চলিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ৪৭৭ন জন মহিলা বিভিন্ন অপরাধজনক কাজে লিপ্ত হয়েছে যাদের ৪০৬ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ সমস্ত ঘটনা নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে ১০৮টি। ২০০৫সালে বিভিন্ন কোর্টে মহিলা অপরাধ সংক্রান্ত ১৩টি রায় দিয়েছে। এ সব দন্ডাদেশে রয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের জেল ও জরিমানা।
এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, ঢাকায় পঞ্চাশের অধিক মাদক কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে রয়ের নারী। মাদক ব্যবসা দেশে প্রচন্ড ক্ষমতা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে মাদক সম্রাজ্ঞীরা । তাদের সহাতায় রয়েছে পুরুষ সহযোগী। পারুল বেগম (৩০) এক অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছিল। যাদের মধ্যে ছিল ৫০ জন সক্রিয় সদস্য। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা মাদক সম্রাজ্ঞী হিসেবে পরিচিত লিপি বেগমকে এক কিলোগ্রাম হেরোইন এবং নগদ ২ লক্ষ টাকা সহ গ্রেফতার করে। এ গুলি সে আয় করেছিল অবৈধ ড্রাগ ব্যবসার মাধ্যমে, সে মুক্তি পাবার জন্য ব্যুরো কর্মকর্তাদেরকে এক কোটি টাকা দুই কিস্তিতে ঘুষ হিসেবে দেবার ওয়াদা করেছিল বলে জানা যায়।
ঢাকার যে সব নারী মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তাদের কেউ কেউ অতি দ্রুত বিত্তশালী হয়েছে। এদের অনেকে স্বেচ্ছায় এ অবৈধ ব্যবসাকে বেছে নিয়েছে, আবার কেউ কেউ তাদের স্বামীদের কারণে এ পথে পা দিয়েছে। সম্প্রতি জানা যাচ্ছে চরম সন্ত্রাসীর বিভ্রান্ত ধর্মোন্মাদ দলের সাথে জড়িয়ে পড়ছে নারীরা। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে তারা রাষ্ট্র ও সমাজ বিরোধী ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ সব ক্ষেত্রে নারীদেরকে সক্রিয় অংশ গ্রহণে উপযুক্ত ও সুইসাইড স্কোয়াড গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গোটা বাংলাদেশে পাঁচ হাজারের অধিক নারী চরমপন্থীরা তাদের পুরুষ সহযোগীদের সহায়তা প্রদানে সক্রিয়। এ সব নারীরা আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা হামলায়ও পারদর্শির্নী। নারীদের এমনি ভাবে অপরাধজগতের সাথে জড়িয়ে পড়ার কারণ খুঁজে বের করে তাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার নৈতিক দায়িত্ব সমাজপতি, বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী গুণীদের।
এক সময় নারী সমাজ তাদের অস্তিত্ব, ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা বলতে কোন কিছুর সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পায়নি। নিছক পরাধীন সত্তা অনুযায়ী ব্যক্তি জীবন ছিল তাদের। অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্বিক ও চিন্তাগত ভাবে তারা একটা ভিন্ন ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। তারা তাদের নিজস্ব ব্যাপারাদি নিয়ে ও নিজস্ব ভাবে চিন্তা করার অধিকার বা সুযোগ পায়নি। তাদের জন্য যা কিছু ভাবনা চিন্তার ব্যাপার ছিল, তা করতো তাদের পিতা মাতা, বড় ভাইবোন বা তাদের স্বামীরা । তারা সমাজ নিয়েও মাথা ঘামাত না। যে কারণে নারী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ ছিল না।
নারীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে কেউ কেউ দারিদ্র্য, যৌতুক আদায়, অপরাধী স্বামীকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য টাকা সংগ্রহ, আবার কোন সময় মাদকাসক্ত স্বামীর টাকার চাহিদা মেটানোকে দায়ী করেন। আসলে এ গুলো প্রকৃত কারণ নয়, পার্শ্ব কারণ। মূল কারণ শিল্প বিপ্লব ও পশ্চিমা ধাচের সভ্যতা সংস্কৃতির চর্চা। পশ্চিমা শিল্প বিপ্লব পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে নব্য যুবক যুবতীদেরকে গ্রাম এলাকা থেকে শহর এলাকায় এনে জড়ো করে ফেলছে। এখানে নৈতিক শৃংখলা ছিল সম্পূর্ণ শিথিল,যে কারণে কর্মক্ষেত্রে হাজির হল তারা এক মুঠি খাবার যোগাবার জন্য, আর এর বিনিময়ে তারা নৈতিক চরিত্র হীনতার কাজে ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ল।
পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষা ব্যবস্থায় নারীদেরকে সাম্যের মন্ত্রে দীক্ষিতকরণ নারীদের পাপাচার, নির্লজ্জতা ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। মার্কস, ফ্রয়েড ও দরখায়েম প্রমুখ দার্শনিক নারীদেরকে আহ্বান জানাল যৌন উচ্ছৃংলতার পথে চলতে। নারীদেরকে বুঝান হল তারা এই সব কাজ করলেই থাকতে পারবে পুরুষদের পাশাপাশি সমান অধিকার নিয়ে।
আমাদের দেশে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থ সামাজিক পরিবর্তনে নারী সমাজ ব্যাপক ভাবে অংশ গ্রহণ করছে। যে কারণে তাদের সনাতনী জীবনাচারে পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্র চালু হবার কারণে নারী স্বাধীনতায় ধীর ও মন্থরগতিতে হলেও জোয়ার বইতে শুরু করেছে। প্রচুর সংখ্যক নারী এখন ঘরের বাইরে যেমন গার্মেন্টস শিল্প, এনজিও সহ বিভিন্ন সমিতিতে কাজ করছে। গ্রামের নারীরা বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ সব বিষয়গুলি সামনে রেখে এ সিদ্ধান্তে উপনিত হওয়া সম্ভব যে অনিয়ন্ত্রিত নারী স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার যে ধারণা সমাজে চালু হয়েছে তাকে পূঁজি করে সমাজের অসাধু পুরুষেরা নারীদেরকে অধিক ক্ষেত্রে অপরাধ জগতে আসবার সুযোগ করে দিয়েছে।
সঠিক উপাত্তের কমতি থাকার পরেও বলা চলে যে,আমাদের দেশে অপরাধ জড়িত নারী সংখ্যা পুরুষ অপরাধীদের চেয়ে অনেক কম। এর কারণ হয়ত লিঙ্গ ও যৌনস্তরভেদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। আমাদের সমাজে মেয়েদের প্রতি ছেলেদের চেয়ে বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়, ফলে তারা নারীসুলভ চরিত্রে বড় হয়ে ওঠে। সামাজিক এই জীবনবোধ নারীদেরকে উগ্র সাংস্কৃতিক অঙ্গন, পাপ ও অপরাধ জগতের প্রবেশ পথে বাতাবরণ সৃষ্টি করে থাকে।
আমেরিকায় যে হারে নারী অপরাধ বেড়ে চলছে আমাদের দেশে নারী অপরাধ বৃদ্ধির হার সে তুলনায় অনেক কম। এই অপরাধকে আরো কমিয়ে আনতে হলে নারী পুরুষদের জীবনাচার ও কর্মাঙ্গনের স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিতে হবে। দায়িত্ব ও কর্তব্যের এই সুনির্দিষ্ট পরিধিকে সামনে রেখেই নারীপুরুষের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের একটি সীমারেখা টেনেছে ইসলাম।
বাংলাদেশে নারী অপরাধ কম হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি সমাজ বোধ। পুরুষ ও নারীর আচরণ বিশ্লেষণে গঠনের সৃষ্টিগত দিকটিকে উপেক্ষা করা চলে না। নারী পুরুষের দৈহিক কাঠামোগত পার্থক্যকে তাদের আচরণগত পার্থক্যের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা প্রবল ভাবে ধর্মীয় ও পিতৃতান্ত্রিক। পিতৃতান্ত্রিকতা ধর্মীয় বোধ থেকে উৎসাহ পেয়ে থাকে যদিও সমাজে ধর্মীয় চেতনা থেকে পিতৃতান্ত্রিকতা অধিকতর বিস্তৃত ও গভীর। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে লক্ষ্য করা গেছে যে, পশ্চিমা জগত জ্ঞান বিজ্ঞানে যত উন্নতি করে চলেছে পাশাপাশি এর সাথে নির্লজ্জতা, উলঙ্গপনা ইত্যাদি এতটা সীমা অতিক্রম করে চলছে, পৃথিবীর ইতিহাসে যার কোন উদাহরণ মেলে না। আমেরিকায় যে হারে নারী অপরাধ বেড়ে চলছে আমাদের দেশে নারী অপরাধ বৃদ্ধির হার সে তুলনায় অনেক কম। এই অপরাধকে আরো কমিয়ে আনতে হলে নারী পুরুষদের জীবনাচার ও কর্মাঙ্গনের স্বাতন্ত্র্যকে মেনে নিতে হবে। দায়িত্ব ও কর্তব্যের এই সুনির্দিষ্ট পরিধিকে সামনে রেখেই নারীপুরুষের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের একটি সীমারেখা টেনেছে ইসলাম। এই স্বাতন্ত্র্যের সীমা রেখার মধ্যেই তাদের বাস্তব কর্মক্ষেত্র গঠনের মধ্যেই রয়েছে নারী অপরাধ মুক্তির মূল শক্তি।