উগ্রবাদী বৌদ্ধদের নিধনযজ্ঞ চলছেই : রোহিঙ্গা মুসলামনরা কী মুছে যাবে পৃথিবী থেকে
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা : ‘অহিংসা পরমধর্মং’ তথা বিদ্বেহীনতাই প্রকৃত ধর্মÑগৌতম বুদ্ধের ধর্মের মূলনীতি হলেও উগ্রবাদী ও ধর্মান্ধ বৌদ্ধরা বোধ হয় তা অসার প্রমাণ করেছে। বৌদ্ধধর্মে জীব হত্যাকে মহাপাপ বলা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের যেভাবে হত্যা করে চলেছে, তাতে বোধ হয় তারা মুসলমানদের জীব মনে করছে বলে মনে হয় না। মিয়ানমারের প্রাচীন রোসাঙ্গের অধিবাসী মুসলমানরা এখন বৌদ্ধ ধর্মোন্মানদের উন্মাদনায় শুধু জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তায় ভুগছেন না বরং তারা স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বজনমত সম্পূর্ণ নির্বিকার। কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যোদ্ধারা ও তথাকথিত মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা তাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে অনুভূতির বাইরে রেখেছেন। বিশ্বে অর্ধশতাধিক মুসলিম রাষ্ট্র থাকলেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুর্দিনে তারাও কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না বা চেষ্টাও করছে না। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসিকে মাঝেমাঝে নর্তন-কুর্দন করতে দেখা গেলেও, তা কখনোই ফলদায়ক হতে দেখা যায় না। ফলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে প্রতিনিয়ত মিয়ানমারের রাজপথ মুসলমানদের রক্ষে রঞ্জিত হচ্ছে। সহায়-সম্পদ, স্বজন ও ভিটেমাটি হারিয়ে তারা এখন ইতিহাসের মারাত্মক ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার।
অতিসম্প্রতি ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসি মিয়ানমারে মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জাতিসংঘের মহাসচীব বান কি মুনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ২০১২ সালের জুন মাস থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চালানো গণহত্যায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হন। এছাড়াও সহায়-সম্বল হারিয়ে পথে বসেছেন কয়েক লাখ মুসলমান। গণহত্যা থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয় নিয়েছেন উদ্বাস্তু শিবিরে। কিন্তু সেখানেও তারা নিরাপদ বোধ করছেন না বরং প্রতিনিয়ত নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা সেখানেও তাদের ওপর হামলা চালিয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মিয়ানমারে ২ বছর আগে সামরিক জান্তার শাসনের অবসানের পর দেশটিতে রাজনৈতিক সংস্কার আনার যে কর্মসূচি নতুন সরকার হাতে নিয়েছে তা রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে অনেকটাই গতিহীন, নিষ্ক্রিয় ও ম্লান হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনরত ওআইসি প্রতিনিধিরা মিয়ানমান সরকারকে মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। জাতিসংঘে ওআইসি গ্রুপের প্রধান ও সংস্থাটিতে নিযুক্ত জিবুতির রাষ্ট্রদূত রোবল ওলহাইয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদে ওপর চালানো গণহত্যাকে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি গত ৮ জুলাই নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মুসলিমবিরোধী সহিংসতা বন্ধ করতে মিয়ানমার সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তিনি এ ব্যাপারে সংস্থাটির অবস্থান স্পষ্ট করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
গত ৮ জুলাই জাতিসংঘের মহাসচীব বান কি মুন নিউইয়র্কে গ্রুপ অব ফ্রেন্ডস অন মিয়ানমারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাশাপাশি ইউরোপ ও এশিয়ার বেশিরভাগ দেশকে এ নিয়ে গ্রুপটি গঠিত। সাক্ষাতে মি. মুন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মিয়ানমার সরকার দেশটির সব নাগরিকের অধিকর সমানভাবে রক্ষা করবে। অপর এক খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের মিকতিলায় মুসলিম-বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় জড়িত থাকার দায়ে ২৩ জনকে কারাদ- দিয়েছেন দেশটির একটি আদালত। শাস্তিপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে হত্যা, হামলা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। গত মার্চে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলের শহর মিকতিলায় ওই সহিংসতায় কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছিলো। এদের মধ্যে মিকতিলার একটি মাদরাসার ছাত্ররাও ছিল। বৌদ্ধ উগ্রপন্থী ও ধর্মান্ধদের ওই হামলায় ১২টি মসজিদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১২ সালে পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ রাখাইন ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘটিত জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জেরধরে মিকতিলায় সহিংসতা শুরু হয়। সেখানে মুসলিম মালিকানাধীন একটি জুয়েলারি কারখানায় সহিংসতার পরপরই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। খোলা তলোয়ার ও লঠিসোঁটা নিয়ে উগ্রবাদী বৌদ্ধ যুবকরা ২০ ও ২১ মার্চ মিকতিলাজুড়ে ব্যাপক নৈরাজ্য ও তা-ব চালায়। হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে গোটা শহরে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যাসহ দাঙ্গায় জড়িত থাকার কথিত অভিযোগে কমপক্ষে ১০ মুসলিমকে এর আগেই কারাদ- দেয়া হয়। এবারের বিচারে কতজন মুসলমানের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ আনা হয়েছে, তা স্পষ্ট করে জানায়নি মিয়ানমান কর্তৃপক্ষ। তবে এবার শাস্তিপ্রাপ্তদের অধিকাংশই বৌদ্ধ চরমপন্থী বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। দাঙ্গাচলাকালে বেশ কয়েকটি হামলার সময় পুলিশ তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী মুসলমানরা। এ সহিংসতার সূত্র ধরেই মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী রেঙ্গুনের সন্নিকটে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। সে সময় মিয়ানমারের মুসলিমদের রক্ষার জন্য আরও বেশি কিছু করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচীব বান কি মুনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। গত ৮ জুলাই সৌদি আরব অভিযোগ করেছে, মুসলমানদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক সংস্কার ও মুক্ত অর্থনীতি নিয়ে মিয়ানমার এই মুহূর্তে বিশ্বের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমা যাপন করছে।
মূলত মিয়ানমারে বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মারাত্মক গণহত্যাসহ নির্মম নিপীড়ন চালালেও, সেসব বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের সাথে মুসলমানদের যুগপৎভাবে সন্ত্রাসের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বিচারে মূলত সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে গেলেও, পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের দ-িত করা হচ্ছে। মুসলমানরা গণহত্যার জবাবে আত্মরক্ষা করতে গেলেই তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের অভিযোগ আনা হচ্ছে। এসব বিষয়ে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ অনেক কথা বললেও বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। ওআইসিও মাঝেমাঝে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে কথা বলতে শোনা গেলেও, এর কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না বরং সমস্যা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে গেছে। তাহলে কী রোসাঙ্গের মুসলমানরা ইতিহাসের কালেরগর্ভে হারিয়ে যাবে?