সহনশীলতার উপর প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ইসলাম নিয়ে অপপ্রচারের দাঁতভাঙা জবাব

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী দুবাইতে সহনশীলতার উপর প্রথম বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবসের সাথে মিল রেখে দু্বাই শহরের আরমানি হোটেলে গত ১৬ ও ১৭ নভেম্বর দু’দিন ব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ১,০০০ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সরকারি ও বেসরকারি খাতের নেতৃস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ এই সম্মেলনে যোগদান করেন।

‘বহুত্ববাদের অভ্যুত্থান: উদ্ভাবন ও সহযোগিতার মাধ্যমে বৈচিত্র্যতার আলিঙ্গন’ এই বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত সহনশীলতার উপর প্রথম এই বিশ্ব সম্মেলন সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য এক বিশাল মাইলফলক মনে করছেন দেশটির কর্তাব্যক্তিরা। পাশাপাশি এই সম্মেলন ইসলাম ও মুসলমানদের সহনশীলতাকে বিশ্বব্যাপী ফুটিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে উক্ত সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের অনেক অমুসলিম নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশীদ আল মাকতূমের উপস্থিতিতে দু’দিন ব্যাপী সম্মেলনের প্রথম দিন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন দেশটির সহনশীলতা মন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক সহনশীলতা ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি শেখ নাহইয়ান মোবারক আল নাহইয়ান।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিরিজ ভিডিও প্রদর্শনের মাধ্যমে সহনশীল বিশ্বব্যবস্থার উপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হয়। প্রদর্শিত ভিডিওতে আমিরাতের মূল ভিত্তিব্যবস্থাও তুলে ধরা হয় যা দেশটির আদি প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহইয়ান কর্তৃক পরিচালিত ও দৃঢ়ভাবে গাঁথা দয়া, অনুকম্পা ও একতার উপর দাঁড়িয়ে আছে।

আরব আমিরাতের ঐক্যের প্রশংসা করে মন্ত্রী শেখ নাহইয়ান মোবারক বলেন, শেখ জায়েদ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দয়া, অন্যদের জানা এবং সাহসিকতার সাথে নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য একজন অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন। আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশীদ আল মাকতুম, আবুধাবির যুবরাজ ও সশস্ত্র বাহিনীর উপ-অধিনায়ক শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহইয়ানসহ আরব আমিরাতের সকল নেতৃবৃন্দের দ্বারা দৃঢ়ভাবে সমর্থিত রাষ্ট্রপতি শেখ খলীফা বিন জায়েদ আল নাহইয়ানের নেতৃত্বে এসব মূল্যবোধ ও মূলনীতির প্রতি আমাদের দেশের অঙ্গিকারগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রতিটি কর্মশালায় তিনটি করে বিষয়ের উপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এ্যামিরেটাস ডিপ্লোমেটিক একাডেমির সহকারী অধ্যাপক ড. নূরা এস. আল মাজরুয়েই এর পরিচালনায় ‘সহনশীলতা মজলিস রুম এ’ শুরু হয়। জাতিগুলোর মাঝে সহনশীলতা ও শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে পারে সঙ্গীতের এমন চারটি মাত্রা আলোচিত হয় এই কর্মশালায়।

‘আজকের তরুণরাই ভবিষ্যতের নেতা’ এই বিষয়বস্তুর উপর ইয়ামকোনি’র জেনারেল ম্যানেজার অধ্যাপক ড. মালেক ইয়ামানি পরবর্তী কর্মশালাটি পরিচালনা করেন। মানুষের উপর বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের উপর বিনিয়োগ এবং তাদের সক্ষমতার উপর আস্থা কীভাবে একটি গতিশীল সমাজ গঠন করতে পারে ড. ইয়ামানি এই বিষয়ের উপর আলোচনা করেন।

দুবাই কোর্টের ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিষ্পত্তি বিভাগের প্রধান আব্দুল্লাহ মাহমুদ আল যারূনী ‘একটি সহনশীল দেশ, একটি সুখী সমাজ’ এই বিষয়ের উপর পরবর্তী কর্মশালা পরিচালনা করেন। কর্মশালাটি সভ্যতার মজবুত ভিত্তি এবং আসল সুখের চাবিকাঠি হিসেবে সত্যিকারের সহনশীলতার মহিমা ফুটিয়ে তুলে।

শেখ জায়েদের মূল্যবোধের উপর আমিরাতের ‘ইসলামী বিষয়াদি ও সম্পত্তির সাধারণ কর্তৃপক্ষ’ সংস্থার ইসলামী বিষয়াদি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ড. ওমর হাবতূর আলদারেই এবং ‘এ্যামিরেটাস এ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস’ এর সদস্য আহমেদ ইবরাহীম আহমেদ মোহাম্মদ এর পরিচালানায় ‘সহনশীলতা মাজলিস রুম বি’ অনুষ্ঠিত হয়। তারা দুজনই আমিরাতের আদি প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের দৃঢ়ভাবে গাঁথা সহনশীলতার মূল্যবোধগুলো তুলে ধরেন। তার উত্তরসূরী ও আমিরাতের জনগণের চোখে সহনশীলতার মূলনীতিগুলো বোধগম্য করার জন্য ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে বিগত শাসকের ভিশন আলোচনা করা হয়।

পরবর্তীতে নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গ সমতার উপর একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। কর্মশালাটিতে আমিরাতের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলাপমেন্ট’ বিভাগের পরিচালক বোর্ডের সদস্যা এইচ.ই. থোরায়া আহমেদ এবং কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চেয়ারপার্সন এবং সৌদি আরবের সূরা কাউন্সিলের সদস্যা হোদা আল হেলাইসি ‘প্রথা ও রীতিনীতির আলোকে নারীর সমাধিকার উপভোগ’ এর উপর আলোচনা করেন।

‘শিক্ষাক্ষেত্রে সহনশীলতার বিস্তৃতি’ শীর্ষক কর্মশালা পরিচালিত হয় আলেকজান্দ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদের ডীন ড. শেবি বাদরান এবং শিক্ষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. খালেদ সালাহ হানিফ মাহমুদ এর নেতৃত্বে। এই দুজন শিক্ষাবিদ শিক্ষাক্ষেত্রে সহনশীলতা ও নাগরিক মূল্যবোধের উন্নতিসাধনে এবং ছাত্রদের মাঝে সহনশীলতার সংস্কৃতির বিস্তারে আরব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকার উপর তাদের মতামত তুলে ধরেন।

প্রথম দিনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কীভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহনশীলতা, সংলাপ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংস্কৃতির উন্নতি সাধন এবং বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি ছড়িয়ে দেয়া যায় তার উপর। সহনশীলতা নেতৃবৃন্দের বিতর্কে সুখী ও সহনশীল সমাজ বিনির্মাণে জন্য সহনশীলতার উন্নয়নে বিশ্বনেতাদের ভূমিকার উপর আলোচনা হয়।

‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং বৈচিত্র্যতার মাধ্যমে সহনশিলতায় উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনায় সহনশীলতার মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষা কর্মসূচী এবং পাঠ্যসূচী প্রণয়নের গুরুত্বারোপ করা হয়। আলোচনায় প্যানেল এই বিষয়ে একমত হন যে, শিক্ষা অসহিষ্ণুতা দূরীভূত করে এবং নতুন নেতৃত্বের জন্য সহনশীল পৃথিবী বিনিমার্ণে শিক্ষা বাধ্যতামূলক।

অন্য একটি আলোচনায় সহনশীলতার উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা এবং বর্তমান প্রচেষ্টাকে চালু রাখতে ‘সহনশীলতা কৌশল’ প্রণয়ণের উপর জোর দেয়া হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমান সুযোগের উপর গুরুত্বারোপ করে সমতার তাৎপর্য্যের উপরও আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

মিডিয়া সেশনে প্যানেল আলোচনার সময় সহনশীলতা বিস্তারে গণমাধ্যমের শক্তির উপর সাধারণ মতৈক্য ফুটে উঠে। গণমাধ্যম যেভাবে ঘৃণা ছড়াতে পারে তেমনি সামাজিক অস্থিরতা লাঘবে এবং সমতা বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়ে প্যানেল সদস্যগণ ঐক্যমত প্রকাশ করেন।

সাংগঠনিক লক্ষ্য অর্জন, শান্তির লালন এবং সহনশীলতা বিস্তৃতির মাধ্যমে সাংগঠনিক সংস্কৃতি বিনির্মাণের উপর আলোচনায় বর্ণ, সংস্কৃতি এবং ধর্মের বৈপরিত্যকে উপেক্ষা করে জনগনকে ঐক্যবদ্ধকরণে প্রযু্ক্তির ব্যবহার এবং সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনার গুরুত্ব উঠে আসে। কোম্পানীগুলোর মূল্যবোধ নির্ধারণ এবং সংকল্পবদ্ধ হয়ে ও বিশেষ চাহিদার্ আলোকে কর্মক্ষেত্রে কর্মী গ্রহণ ও কর্মীদের সম্মানের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোচনা হয়।

সর্বশেষ প্যানেল আলোচনাটি ছিল নতুন প্রজন্মের মধ্যে সহনশীলতার গুণ বদ্ধমূলকরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বের উপর। এই অংশে তরুণ প্রজন্মের নৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার উপর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠে আসে। নারীর ভূমিকা বিশেষ করে সন্তানদেরকে বৈচিত্র্যতার মাঝে এবং অন্যকে সম্মান প্রদানের ক্ষেত্রে সহনশীলতা অনুশীলনের গুরুত্ব শিক্ষাদানে মাতৃত্বের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

সমাজের সর্বক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং সহনশীলতার বিস্তারে বৈশ্বিক সহযোগিতা নিশ্চয়তার উপর এক ‘সম্মেলন ঘোষণা’র মাধ্যমে বিশ্ব সহনশীলতা সম্মেলন ২০১৮ সমাপ্ত হয়।

সহনশীলতা সম্মেলনটি ছিল ‘মোহাম্মদ বিন রাশীদ আল মাকতুম গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’ এর অধীন ‘আন্তর্জাতিক সহনশীলতা ইন্সটিউট’ এর একটি উদ্যোগ।

একটি মুসলিম দেশের উদ্যোগে প্রথম কোন ‘বিশ্ব সহনশীলতা সম্মেলন’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য্য পশ্চিমা বিশ্বের নিকট ফুটে উঠেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে আইসিস, আইএসআই, আল কায়েদা বা তালেবানদের দোহায় দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে বিশ্বব্যাপী যেভাবে জঙ্গী ও অসহিষ্ণু হিসেবে পরিচয়ের জোর প্রচেষ্টা চলছে সম্মেলনটি তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button