দ্যা লন্ডন ফেইথ এন্ড বিলিফ এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হলেন জামান

জীবনের গতি অনেক সময় নদীর জোয়ার ভাটার মতো পাল্টে যায়। কিন্তু তারপরও নদী তার মতোই সব বাধা পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায়। এই পরিবর্তনশীল জীবনটা কখনো থেমে থাকেনা। আর পরিবর্তনের সাথে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারাটা একজন মানুষের জীবনে অনেক বড় স্বার্থকতা।

বিলেতের মাটিতে এই বাধা আর সংগ্রামকে সাথে নিয়ে ব্রিটিশ কমিউনিটিতে বিশেষ অবদানের জন্য এমএফএ জামান দ্যা লন্ডন ফেইথ এন্ড বিলিফ ফোরাম এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছেন। বিগত দুই দশক ধরে দ্যা লন্ডন ফেইথ এন্ড বিলিফ ফোরাম বৃটেনের বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণের মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন আর একটি সুন্দর সমাজ গঠনে সরকার এবং কমিউনিটি সার্ভিসের সাথে কাজ করছে। প্রায় চব্বিশ হাজার সংগঠন বহু সংস্কৃতির শহর লন্ডনকে সবার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়ে কাজ করছে। এসব সংগঠন এবং তাদের ভলান্টিয়ারদের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি আর অনুপ্রেরণা দিতেই দ্যা লন্ডন ফেইথ এন্ড বিলিফ ফোরাম প্রতিবছর এওয়ার্ড প্রদান করে। আগামী মঙ্গলবার ২৭ নভেম্বর লন্ডনের দ্যা রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিন হলে এক জাকজমকপূর্ণ গালা ডিনার পার্টিতে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে যেখানে উপস্থিত থাকবেন স্যার লেফটেন্যান্ট ক্যান ওলিসা – গ্রেটার লন্ডন, ফিল চ্যাপমেন – ডাইরেক্টর দ্যা লন্ডন ফেইথ এন্ড বিলিফ ফোরাম এবং কমিউনিটির বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, এমপি সহ আরো অনেকে।

লন্ডন অলিম্পিক ২০১২ এম্বেসেডর জামান ব্রিটিশ কমিউনিটিতে একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন উন্নয়ন এবং সামাজিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তবে এই পথটা কখনোই তার জন্য মসৃণ ছিলো না। কারণ বিদেশ বিভুইয়ে যখন একজন মানুষ আসে তখন সবকিছুই তার প্রতিকুলে। কারণ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম আর জীবনযাত্রা নতুনদের কাছে অনেকটা অপরিচিত। কিন্তু তারপরও জীবন যুদ্ধের একজন সংগ্রামী সৈনিক হিসেবে অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যেও নিজের বিশ্বাস, স্বকীয়তা বজায় রেখে তিনি আজ এতদূর আসতে পেরেছেন। এজন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে যা ছিলো খুবই বেদনাময় আর কষ্টের। কারণ হারানোর পর সবাই আবার দাড়াঁতে পারে না। তখন মনে থাকে শুধু হতাশা আর ভয়। আর এটি আরো কঠিনতর হয়ে উঠে যখন আপনি প্রবাসে শুধুই একা; এমনকি কনকনে শীতের মাঝে আপনার মাথা গুজার ঠাইটা পর্যন্ত থাকেনা। পথহারা পথিকের মতো কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের নিচে আপনি শুধু একবুক হতাশা নিয়ে হেটে চলছেন। কিন্তু এতকিছুর পরও জামান মহান আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হননি। তিনি আবার নতুন উদ্যোম আর আশা নিয়ে পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এগিয়ে যেতে থাকেন। কারণ বাঘের ভয়ে তো আর নিজের জীবনকে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখার যাবেনা কিন্তু এই বাঘকে মোকাবেলা করে নিজের জীবনকে এগিয়ে নিতে পারাটাই হলো বীরত্বের। একটু একটু করে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ আর আত্ববিশ্বাস আজ তাকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে; যা আমাদের জন্য একটি উদাহরণ স্বরূপ।

আজ তিনি শুধু নিজের জন্য কাজ করছেন না; যারা নিজের জীবনের মোড়টা ঘুরাতে চায়, তাদেরকে সাহায্য করছেন তার নিজের অভিজ্ঞতা আর সময় দিয়ে। মানবতার সেবায় নিজের প্রতিষ্ঠান ‘সেইফ এন্ড সেইভ‘ এর মাধ্যমে কমিউনিটির ঘরহারা মানুষদের খাবার, বস্ত্র দিয়ে তাদের পাশে দাড়িয়েছেন। সমাজের বয়বৃদ্ধ আর যাদের কেউ নেই তাদের সাথে নিজের মূল্যবান সময় ব্যয় করছেন, তাদের শেষ সময়টুকুতে একটু হলেও প্রশান্তির মায়াটুকু দেবার চেষ্টা করছেন। আর যারা নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বে ভুগছেন কিন্তু কেউ নেই শোনার, তাদের পাশে বসে একটু হলেও সঙ্গ দেয়ার মাধ্যমে তাদেরকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। আর এসব সেবা দেয়ার কারণ হলো তিনি নিজে একসময় এইসবের মধ্য দিয়ে দিনরাত-বছর পার করেছেন, তাই তাদের কষ্টটুকু বুঝতে পারেন, যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

জামান ব্রিটিশ কমিউনিটিতে এক অনন্য যোগসূত্র স্থাপনের অবদানের জন্য ২০১৮ সালের দ্যা মুসলিম নিউজ আল-বিরুণী এওয়ার্ডে ভূষিত হন। এছাড়া তিনি ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংস্থা মুসলিম এইডের সেরা ভলান্টিয়ার নির্বাচিত হনএবং ২০১৭ সালের দ্যা ক্যালাডরেল কমিউনিটি স্পিরিট অব দ্যা ইয়ার এওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ২০১৭ সালের রমজান মাসে তিনি জো কক্স এমপি ফাউন্ডেশন এন্ড ইডেন প্রজেক্টের এম্বেসেডর হিসেবে ৬১৬ মাইল পায়ে হেটে ইয়র্কশায়ার থেকে লন্ডন আসেন। একমাত্র মুসলিম হিসেবে তিনি বিভিন্ন কমিউনিটি প্রজেক্ট, চ্যারিটি এবং স্থানীয় এমপি, মেয়রদের সাথে মিলিত হন।

জামান বলেন, প্রতিটি মুহুর্ত আমাকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে, যা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা কিংবা আমি প্রস্তুত ছিলাম না। প্রতিটি দিন সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি অনাকাঙ্খিত মূহুর্তের শংকায় থাকতাম। জীবনটা যেন সুনামীর আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমি আবার শুরু করি নতুন প্রত্যয় আর স্বপ্ন নিয়ে। আমার সাথে কেউ ছিলো না। তারপরও আমি একটু একটু করে হেটে আজ এতদূর আসতে পেরেছি। এজন্য আমি মহান প্রভুর কাছে কৃতজ্ঞ আর সেইসব মহৎ মানুষদের প্রতি যারা নিঃস্বার্থভাবে আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য এবং অনুপ্রাণিত করেছেন। কারণ তাদের সহযোগীতার জন্যই আজ আমি এতদূর আসতে পেরেছি; তা না হলে আজ হয়তো আমার অস্তিত্ব থাকতো কি না সন্দেহ।

খুবই দুঃখের বিষয় এই সমাজ একজন ব্যক্তিকে তার সামাজিক অবস্থান আর অর্থবিত্তের মাধ্যমে মূল্য দেয়। কিন্তু টাকা-পয়সার মানদন্ডে একজন মানুষকে সম্মান দেয়া ঠিক নয়, যদি না তার মাঝে সততা আর মনুষত্বের ঘাটতি খাকে। জীবনে কিছু অর্জন করতে হলে প্রতিদানের আশা না করে নিজের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসকে বিলিয়ে দিতে হয়। আমি আজ এই অবস্থানে এসেছি শুধূমাত্র আমার ভলান্টিয়ার কাজের জন্য কিন্তু আমি কখনো এই কাজের প্রতিদান আশা করিনি কিংবা কোনো বিশেষ পদের জন্য অনুরোধ করিনি। আমি কোথায় থেকে এসেছি তা কখনো ভুলিনি। প্রতিটি মুহুর্ত আমাকে চ্যালেঞ্জের সাথে মোকাবেলা করতে হয়েছে, যেখানে শুধু আমার বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম আজ এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আমার প্রতিটি পদক্ষেপ একমাত্র মহান আমার প্রভুকে খুশি করার জন্য। আর তার কাছেই আমি উত্তম প্রতিদান আশা করি। আমাদের দৈহিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য কাজ সবোর্ত্তম উপকরণ আর ভালো কাজ মানুষকে সবসময় খারাপ কাজ-চিন্তা থেকে দূরে রাখে। একজন মানুষের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে এই সততা আর কর্মপ্রচেষ্টা।আজ অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমি এখানে আসতে পেরেছি; যা হয়তো অন্যদেরকে উৎসাহিত করবে কিভাবে জীবনকে পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু এখানেই শেষ নয় আমার যাত্রা কারণ এই সাফল্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আশা করি আমি আমার ভালো কাজের মাধ্যমে এই পৃথিবীকে একটি শান্তির আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।

উল্লেখ্য বিবিসি, আইটিভি, চ্যানেল এস সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমএফএ জামানের কাজের উপর বিশেষ সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। এছাড়া তিনি প্রথম বাঙালি হিসেবে বিবিসি দ্যা ওয়ান শো তে কমিউনিটিতে কাজ করার বিশেষ অবদান হিসেবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন; যেখানে অতিতে ব্রিটেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন।

আগামী ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের নির্বাচক জামান লন্ডন অলিম্পিক ২০১২ এর লন্ডন এম্বেসেডর এবং ২০১৫ সালের রাগবি ওয়ার্ল্ড কাপ ইংল্যান্ডের একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমিউনিটি অব জিউস এন্ড মুসলিম এর ফাউন্ডার জামান ভলান্টিয়ার সেন্টার লুইসামের একজন ট্রাস্টি এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ৩ বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি টিম লন্ডন, নিউহাম ক্রিকেট ক্লাব, ইউনিভার্সেল পিস ফেডারেশন, নিয়ার নেইবার্স, মেট্রোপলিটন এসেক্স ক্রিকেট এসোসিয়েশন এবং বারটস হেলথ এনএইচএস ট্রাস্টের একজন সদস্য। জামান ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের একজন ক্রিকেট আম্পায়ার হিসেবে বিলেতের ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে আসছেন। তিনি পঙ্গু শিশুদের সাহাযার্থে ফান্ড রাইজিংয়ের জন্য লন্ডন ম্যারাথন সহ বিভিন্ন ম্যারাথন দৌড়ে অংশগ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button