স্বাধীন উইঘুরিস্তানের স্বপ্ন ও সংগ্রাম
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা: উইঘুর মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত নির্যাতিত ও স্বাধীকার হারানো জাতিগোষ্ঠী। তারা মূলত চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে বসবাস করেন। উইঘুররা এই অঞ্চলের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্যতম। এখানকার ৮০% উইঘুর অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তারিম বেসিনে বসবাস করেন। জিনজিয়াং এর বাইরে উইঘুরদের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় দক্ষিণ মধ্য হুনান প্রদেশে রয়েছে। চীনের বাইরে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর বাস করেন। এছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, রাশিয়া, সৌদি আরব, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কে অল্পসংখ্যক উইঘুর রয়েছেন।
অতীতে উইঘুরিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র থাকলেও তা এখন শুধু অতীত স্মৃতি; হারানো দিনের ইতিহাস। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই উইঘুর মুসলমানদের কেটে গেছে শত শত বছর। জাতিগত নিপীড়ন ও নিধনের মুখোমুখী হয়েও তারা আগামী দিনের রক্তিম সূর্যের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন। তারা শত বাধা-প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজেদের আদর্শ, বোধ-বিশবক্স ও স্বকীয়তা হারিয়ে বসেননি বরং তাদের স্বাধীকারের সংগ্রাম এখনও অব্যাহত রেখেছেন এবং অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার আগ পর্যন্ত তাদের এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তাই তাদের ওপর নির্মমতাও ক্রমবর্ধমান।
মূলত জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলমানদের উপর কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীনের দমনপীড়নের অভিযোগ সর্বসাম্প্রতিক নয় বরং বেশ পুরোনো। একবিংশ শতাব্দীতেও জাতিগত পরিচয়ে নিপীড়নের স্বীকার এসব ভাগ্যাহত মুসলিমরা। কথায় কথায় নিষিদ্ধ, সন্দেহ হলেই প্রমাণ ছাড়া আটক ও নির্যাতন এখন তাদের তাদের নিয়তি হয়ে গেছে। তাদের ওপর অভিনব সব বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞা পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৮ বছর বয়সের নীচে গোঁফ ছাড়া দাঁড়ি রাখা, পুরুষের মসজিদে প্রবেশ ও নারীদের হিজাব ব্যবহারে আছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এ ছাড়াও রাস্তায় দলবদ্ধ হয়ে চলা ও টুপি পরার উপরও আছে বিধি-নিষেধ। এমনকি শিশুদের ধর্মীয় নাম রাখার ক্ষেত্রেও আছে নানাবিধ জটিলতা।
উইঘুরদের ধর্মীয় কাজ দেখা হয় সন্দেহের দৃষ্টিতে। তাই রোজা রাখা কিংবা নামাজ পড়া এখানে চরমপন্থী, সন্ত্রাসবাদী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। চীনা ভাষায় কুরআন অনুবাদের অপরাধে সালিম দামল্লাম নামে উইঘুর নেতাকে গ্রেফতার করা হলে দীর্ঘ কারাভোগে তাকে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। জিনজিয়াংয়ে উইঘুর সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি লম্বা দাঁড়ি রাখার অপরাধে তাকে ছয় বছরের কারাদন্ড দিয়েছে চীনের একটি আদালত। কিন্তু এত কিছুর পরেও তারা ভুলে যাননি নিজেদের আত্মপরিচয়। বরং শত অত্যাচারের মধ্যেও সব সময় সরব থেকেছে নিজেদের অধিকার নিয়ে।
হিজরি প্রথম শতকে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর আদেশে আসহাবে রাসুল (সা.)দের হাত ধরে এই অঞ্চলে ইসলাম ও মুসলমানদের আবির্ভাব ঘটে এবং ক্রমেই তা এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। বর্তমান চীনে দুই কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মুসলিম বাস করে। মূলত দুই ধরনের মুসলিমরা সেখানে বাস করেন। ‘হুই’ মুসলমান ও ‘উইঘুর’ মুসলমান। ‘হুই’দের পূর্বপুরুষরা মূলত পারস্য, সিরিয়া, ইরাক ও আনাতোলিয়া থেকে চীনে এসেছিলেন জীবন-জীবিকার সন্ধানে । চীনে এসে চীনা ‘হান’ সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিয়ে করে এখানেই স্থায়ী হতে থাকেন । বর্তমানে এদের সন্তানরাই ‘হুই’ বলে পরিচিত। অপর দিকে ‘উইঘুর’রা জিনজিয়াং বা কাশগর এলাকায় হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় এই সত্যই বেরিয়ে আসে।
বস্তুত, জিনজিয়াং প্রথম দিকে চীনের অধিকারে ছিল না, সেটি ছিল মুসলমানদের স্বাধীন ভূমি। কিন্তু চীনারা তা কোন ভাবেই স্বীকার করে না। এ প্রসঙ্গে ‘চাইনাস মুসলিম ফর নর্থওয়েস্ট’ গ্রন্থের লেখক মাইকেল ডিলন বলেছেন, ‘আমি চীনের বহু মানুষের সাথে অঞ্চলটি নিয়ে কথা বলেছি তাদের কেউই এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। তারা একে সবসময়ই জংগুয়ো জিনজিয়াং (চীনা জিংজিয়াং) বলে অভিহিত করে যেমনটি তিব্বতের ক্ষেত্রে তারা জংজুয়ো জিজাং (চীনের তিব্বত) বলে উল্লেখ করে। তারা এভাবে মনে করে যে এ অঞ্চল সবসময় চীনের অংশই ছিল।’ মূলত মি. ডিলনের বক্তব্য ইতিহাস বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা দেখা যায়, উইঘুরিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান কখনোই চীনের অংশ ছিল না বরং তা অতীতে স্বাধীন রাষ্ট্রই ছিল।
মূলত মুসলিম শাসনকালে এই এলাকার নাম ছিল উইঘুরিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান। ১৬৬৪ সালে বর্তমান চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঞ্চু শাসকরা কিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে অন্যান্য এলাকার সঙ্গে মুসলমানদের স্বাধীন এলাকাও তারা দখল করে। কিন্তু স্বাধীনচেতা উইঘুররা তা মেনে নেয় নি। তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করে। অব্যাহত স্বাধীনতা লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৮৬৪ সালে ২০০ বছর পর কিং শাসকদের বিতাড়িত করে কাশগরকেন্দ্রিক আবার স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করে উইঘুর মুসলমানরা। কিন্তু ভাগ্য তাদের সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। স্বাধীনতাকামী এ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আবারও আক্রমণ করে চীন। ১৮৭৬ সালে চীন আবারও উইঘুর সাম্রাজ্য দখল করে এর নাম দেয় জিনজিয়াং। সেই থেকেই ঘুরে ফিরে চলতে থাকে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ উইঘুর মুসলিমদের জীবন। আরাকানের মুসলমানদের মতো তারাও নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। কিন্তু তারা তাদের লক্ষ্যে এখনও পরিশ্রান্ত নন বরং অবিচল।
কমিউনিস্ট আমলে উইঘুরদের নিপীড়নের ইতিহাস খুবই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। কিন্তু স্বাধীনচেতা উইঘুররা চালিয়ে যেতে থাকেন তাদের মুক্তির সংগ্রাম। ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে পরপর দুইবার বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং শেষবার তারা সফলও হন। প্রতিষ্ঠা করে পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র। চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার স্বাধীন তুর্কিস্তানকে স্বীকৃতি দেয়। এমনকি জোসেফ স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নও সমর্থন জানায় নতুন এই স্বাধীন রাষ্ট্রকে। কিন্তু এর মধ্যেই মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চীনে শুরু হয় বিপ্লব। লাল বাহিনীর কাছে গৃহযুদ্ধে হেরে যায় চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার। ক্ষমতার শুরুতেই কমিউনিস্টদের নজরে আসে পুর্ব তুর্কিস্তান। দ্রুতই মাও সেতুং এর নেতৃত্বে বিজয়ী কমিউনিস্টরা তুর্কিস্তানকে চীনের সাথে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু লড়াকু ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান উইঘুর নেতারা এই প্রস্তাবে রাজি হননি। এরপর একের পর এক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে থাকেন পূর্ব তুর্কিস্তানের সব শীর্ষ উইঘুর নেতারা। জনশ্রুতি আছে যে, উইঘুরদের নেতৃত্বশূণ্য করতেই মাও সেতুংম এর চক্রান্তেই ওই বিমান দুর্ঘটনা ঘটানোগুলো হয়েছিল। এতে সফলতাও পেয়েছিল তারা।
ওই বিমান দুর্ঘটনার পরপরই জেনারেল ওয়াং ঝেনের নেতৃত্বে বিশাল এক চীনা বাহিনী মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পূর্ব তুর্কিস্তানে হামলা চালিয়ে দেশটি আবারও দখল করে নেয়। দখলের পরপরই তারা ওই ভূখন্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখে জিনজিয়াং। হামলা শুরু করে উইঘুর নেতাদের উপর। অনেক স্বাধীনতাকামী উইঘুর নেতা পালিয়ে তুরস্কে ও বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে চলে যান। তখন থেকেই জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে পরিণত হয়। তৎকালীন জিনজিয়াংয়ে কমিউনিস্ট পার্টির গভর্নর হন সাইফুদ্দিন আজিজি নামে এক কমিউনিস্ট নেতা।
চীনা ভূখন্ডের ছয় ভাগের এক ভাগ জুড়ে অবস্থিত জিনজিয়াং প্রদেশের আয়তন পূর্ব ইউরোপের দেশ জার্মান, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেনের সমন্বিত আয়তনের প্রায় সমান। তাই এটি স্বাধীন দেশ হলে তা হতে পারতো ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ১৬তম বৃহৎ দেশ। লক্ষ্যণীয় যে, জিনজিয়াং এর এই বিশাল এলাকায় চীনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশ লোক বাস করে। প্রদেশের মোট জনসংখ্যা হলো প্রায় ৮ মিলিয়ন। আর প্রদেশটিতেই মজুদ রয়েছে চীনের বিশাল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল সম্পদ।
কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে চীন এখান থেকে মধ্য এশিয়ার দেশ এবং নিকটবর্তী প্রদেশগুলোয় গ্যাস ও তেল সরবরাহ করে থাকে। ফলে চীনের কাছে অর্থনৈতিক ভাবে এই অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খনিজ ও তেল সম্পদে সমৃদ্ধ এই প্রদেশটি কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয় চীন। কিন্তু প্রভূত সম্পদ-সম্ভার থাকার পরও কোনো লাভ হয়নি উইঘুরদের। বরং ক্রমাগত বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও প্রবঞ্চনা। সরকারি চাকরিতে তাদের নিয়োগ একেবারেই নেই বললেই চলে। যেসব মুসলিম চাকরির সুযোগ পেয়েছেন, সেখানেও তারা বেতনের ক্ষেত্রে নানাদিক থেকেই বৈষম্যের শিকার। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চাকরিতে একই পদে একজন ‘হান’ যা বেতন পাচ্ছেন, একজন মুসলিম তা পাচ্ছেন না। যেন মুসলমান হওয়াই এদের গুরতর অপরাধ! ধর্মীয় ও জাতিগত কারণে এমন বৈষম্যের ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।
শুধু অর্থনৈতিক আর সামাজিক ভাবে নয় পাশাপাশি সাংস্কৃতিক প্রবঞ্চনাও এখানে বেশ প্রবল। এদের ভাষা উইঘুর। প্রাচীনকালে এ ভাষার বর্ণমালা উইঘুর হরফে লেখা হতো। ইসলামের আবির্ভাবের পর ১৩শ থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত উইঘুর বর্ণমালা আরবি হরফে লেখা হতো। এরপর কিছুদিন অন্য হরফে লেখা হলেও ১৯৮৫ সাল থেকে আবারো সরকারিভাবে আরবি হরফ চালু করা হয়েছে। সেখানে তাদের এখন বাধ্য করা হচ্ছে মান্দারিন ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের জন্য। যা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বৈ কিছু নয়।
এত কিছুর পরও উইঘুর মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, বোধ-বিশ্বাস, সমাজ-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ কোনভাবেই নির্মূল বা ধ্বংস করা যায়নি বরং তারা স্বাধীকারের আন্দোলনে সবসময়ই আপসহীন। কর্তৃপক্ষ ১০ লাখেরও অধিক উইঘুর মুসলমানকে বন্দীশিবিরে আটক রেখেও তাদেরকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি বরং ক্রমেই স্বাধীন উইঘুরিস্থান আন্দোলন শানিত হচ্ছে এবং চীনা কর্তৃপক্ষ মনে করছে যেকোন মহুর্তে উইঘুর পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই চীনে মুসলমানদের উত্থান ঠেকাতে তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। আর এজন্য তারা মুসলমান ও মুসলানদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিভিন্ন অপবিশেষণে বিশেষিত করছে। যা মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন বাড়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে।
সম্প্রতি চীনের জিনজিয়াংয়ের অঞ্চলের যে সব অধিবাসী কথিত ‘চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সাথে জড়িত ও বিদেশি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে, তাদেরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে চীনা কর্তৃপক্ষ। রক্ষণশীল ইসলামী পদ্ধতি মেনে চলে এমন মুসলিমদেরও একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে। ফলে চীনা কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
গত ১৮ নবেম্বর হামি শহরের সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের অফিসিয়াল একাউন্টে এই নির্দেশের নোটিশ পোস্ট করে বলে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে। নোটিশে বলা হয় যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের কাছে ৩০ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করবে তাদের অপরাধ ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা হবে বা তাদের শাস্তি থেকে রেহাই দেয়া হবে। মূলত এই ঘোষণার মাধ্যমে তারা উইঘুরের স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরকে ফাঁদে ফেলা চেষ্টা করছে। এ ধরনের চেষ্টা অতীতেও হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। আর স্বাধীনতাকামীরা কর্তৃপক্ষের এমন ফাঁদে পা দেবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই।
গণ-বন্দীশিবিরে ১০ লাখ বা তার বেশি সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমকে গোপনে আটকে রাখা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত রিপোর্ট পাওয়া গেছে। চীন দাবী করছে, তারা কাউকে জোর করে রাখেনি। তবে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না বা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মত কোন উপাদানও পাওয়া যাচ্ছে না।
মূলত চীনের সংখ্যালঘু উইঘুর মসুলিমকে বিশাল বন্দীশিবিরে আটকে রাখা ও তাদের ওপর নজরদারির অভিযোগে সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বেইজিং। চীন এই সমালোচনা নাকচ করে দিয়ে বলেছে, তারা সংখ্যালঘুদের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু, ‘চরমপন্থী’ দলগুলোর প্রভাব মোকাবেলায় তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। কিন্তু বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের অভিযোগ সত্য নয় বরং তারা ইসলামী আদব-কায়দা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও ধর্মাচারকেই সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা আখ্যা দিয়ে তাদেরকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই।
আর তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে চীনের সরকারি ঘোষণা থেকেই। সাম্প্রতিক ঘোষণায় বলা হয়, ‘যেসব ব্যক্তি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িত তাদেরকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে বিচারিক প্রতিষ্ঠানের কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বীকারোক্তি এবং তাদের অপরাধের বিষয়ে তথ্য দিতে বলা হচ্ছে,’ জানানো হয় নোটিশে। এতে আরও বলা হয়, বিদেশি ‘সন্ত্রাসী’ দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং রক্ষণশীল ইসলামী আদব-কায়দা মেনে চলে এমন ব্যক্তিদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। যারা কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী সম্পূর্ণ জীবন যাপন করে, অন্যকে টিভি দেখতে বাধা দেয় বা মদ ও ধূমপান নিষিদ্ধ করে এবং বিয়েতে নাচ-গানে নিষেধ করে তাদের সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলা হয় নোটিশে।
আপত্তিকর আচরণের তালিকায় আরও রয়েছে, প্রকাশ্যে সরকারি পরিচয়পত্র নষ্ট করা, সরকারের দেয়া বাড়ি, সুবিধা, সিগারেট ও মদ ‘হারাম’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা। যারা স্বেচ্ছায় ধরা দিবে তাদের সাজা কম হবে। তাদের দেয়া তথ্য গুরুত্বপূর্ণ কোনও ক্লু পাওয়া গেলে পুরো শাস্তি মাফ করে দেয়া হবে জানানো হয় নোটিশে।
গত আগস্টে জাতিসংঘ জানিয়েছিল, গণ-বন্দীশিবিরে ১০ লাখ বা তার বেশি সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমকে গোপনে আটকে রাখা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত রিপোর্ট পাওয়া গেছে। চীন দাবী করছে, তারা কাউকে জোর করে রাখেনি। তবে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না বা বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার মত কোন উপাদানও পাওয়া যাচ্ছে না।
বস্তুত, গণহারে বন্দীশিবিরে আটকে রাখা ছাড়াও চীনের সরকার মানুষের প্রাত্যহিক ধর্মীয় আচরণকে সীমিত রাখার বিধিনিষেধও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা। সংবদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গতমাসে ওই এলাকার রাজধানী উরুমকিতে বিভিন্ন হালাল খাদ্য ও টুথপেস্টের মতো বিভিন্ন পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা হয়। এসব পণ্যের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনে ইসলামি আইনের অনুপ্রবেশ ঘটবে বলে মনে করে চীনা কর্তৃপক্ষ।
এত কিছুর পরেও উইঘুর মুসলমানেরা স্বপ্ন দেখে জিনজিয়াং প্রদেশে তারা একদিন একটি স্বাধীন ভূখন্ড প্রতিষ্ঠা করবে। হারানো স্বাধীকার আবারও ফিরিয়ে আনবে। যেখানে তারা নিজেদের ধর্ম ও জীবনাচার নিজেদের স্বাধীনতা মতো পালন করতে পারবে। সেই সোনালী দিনের প্রত্যাশায় উইঘুর মুসলমানরা লক্ষ্যে ও সংগ্রামে অবিচল; আপসহীন।