ফেনসিডিল, ইয়াবা ও ভারতীয় টিভি চ্যানেল

Yabaতুষার আবদুল্লাহ:
ভারতীয় চ্যানেল দেখার সময় সংঘবদ্ধ দর্শক গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আটক। এরকম খবর কবে গণমাধ্যমে দেখা যাবে? অপেক্ষায় আছি এ ধরনের খবর প্রচারের। যেভাবে ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রেতাকে আটক করা হয়, কিংবা এই দুই মাদকে আক্রান্তদের যেভাবে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠানো হয়, ঠিক সেই আচরণ ভারতীয় চ্যানেলে আসক্ত দর্শকদের সঙ্গে কবে থেকে শুরু করা হবে, অপেক্ষায় আছি সেই দিনটিরও।
আমরা ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা ফেনসিডিলের কথা জানি। নব্বইর দশকের গোড়া থেকে সারাদেশ ফেনসিডিলে সয়লাব হয়ে যেতে শুরু করে। তরুণ-তরুণীরা ফেনসিডিলে দলে দলে আসক্ত হতে থাকে। অফুরান চাহিদা সামাল দিতে বাংলাদেশ সীমান্তের নিকটবর্তী ভারতের এলাকাগুলোতে ফেনসিডিলের কারখানা চালু হবার খবর আছে। ফেনসিডিল বিক্রি করতে ও চোরাইপথে তা আনতে যতো উদ্যোগই নেয়া হোক, এর বিপণনকারীরা নতুন নতুন ফন্দি বের করেছে এর সরবরাহে।
কাঁঠালের ভেতর, মাছের ভেতর, চালের বস্তায় নানা ফন্দি-ফিকিরে ফেনসিডিল বিপণন চলছেই। এর সঙ্গে গত পাঁচ বছরে বেড়েছে ইয়াবার সরবরাহ।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইয়াবা সেবনের মাত্রা বেড়েছে। ইয়াবা বিক্রি’র সংগে যুক্ত হয়ে পড়েছে বিনোদন জগতের মানুষ ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা। মাল্টিলেভেল ব্যবসার অনুকরণে চলছে ইয়াবার ব্যবসা। আসক্তে’র সংখ্যাও বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। তবে গণিত-জ্যামিতির সব হিসাব ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশের দর্শকদের ভারতীয় চ্যানেলে আসক্তি।
ভারতীয় চ্যানেলে যতো বাংলাদেশি দর্শক আসক্ত, এতোটা আসক্তি কোনো মাদকের প্রতিও নেই। সমস্যা হলো এই নেশায় বুঁদ হয়ে আছে আড়াই বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত।
ধারণা জরিপ বলে- ভারতীয় চ্যানেলে মেয়েরাই বেশি নেশাতুর হয়ে আছে। ছেলেরা যে খুব পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না স্টার প্লাস, সনি, কালারস, স্টার গোল্ড, লাইফ ওকে, স্যাটম্যাক্স, এম টিউন, বি ফর ইউ, চ্যানেল এক্স, জি মিউজিক, এস সংগীত, মুভিস ওকে, স্টার জলসা, জলসা মুভি, জিবাংলা, ইটিভি বাংলা, সনি আট, জিবাংলা মুভিজ, তারা মিউজিক গোগ্রাসে হজম করছে পরিবারের সবাই মিলমিশ করেই।
মাদকের নেশা’র যেমন সামাজিক ও শারীরিক ক্ষতি হয়, তেমনি ভারতীয় চ্যানেলের নেশা’তেও সামাজিক ও শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। পরিবারের কোন সদস্যের মাদকে আসক্তি একটি পরিবারকে কিভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে বা দিচ্ছে তার উদাহরণ এখন আশপাশে তাকালেই পাওয়া যায়। কারো পরিবার, কারো শিক্ষা জীবন এবং অনেক প্রতিভাই অংকুরে পচে গেছে মাদকের নীল ছোবলে।
একইভাবে ভারতীয় চ্যানেলের প্রভাবে দেখা দেয়া সামাজিক ক্ষতগুলো এখন রূপ নিয়েছে কর্কট রোগে। প্রথমত, শিশু থেকে কিশোর বয়সীরা ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষাকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে। চলন-বলনে এবং পোশাকে তারা ভারতীয় চ্যানেলের পাত্রপাত্রীদের অনুকরণ করে। তাদের বাবা-মা এবং অভিভাবকরা আরেক ধাপ এগিয়ে পোশাক-অলংকার এবং সামাজিকতায় ভারতীয় আদল নিয়ে এসেছে। এর সংগে যোগ হচ্ছে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে কূটচাল,পরকীয়া, সহিংসতা’র মতো বিষয়গুলো শিক্ষা নেয়া। এই শিক্ষণগুলোর চর্চা এখন পুরোদমে চলছে পরিবার ও সমাজে। কিন্তু যে নেশা একবার পান করা হয়ে গেছে তা কি ছাড়া সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া’র উদাহরণগুলো দেখার পরও নেশার ডোজ দিনকে দিন বাড়ছে, কমছে না এক মিনিটও। কারণ এ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা এদেশের দর্শকদের যেনো নেশা না কাটে, সেজন্য ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো নতুন নতুন উপকরণের নিয়মিত যোগান দিয়েই যাচ্ছে।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর নিত্যনতুন উপকরণের যোগানের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। পারছে না এর একটি সঙ্গত কারণ হলো বহুভাষা ও রাজ্যের ওই দেশটিতে কলাকুশলী অফুরন্ত। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের সেই সংখ্যক কলাকুশলী যোগান দেয়ার সাধ্য নেই। সেই সংগে ভারতের জনসংখ্যা অনুপাতে পণ্য ও বিজ্ঞাপনের বাজারের কাছে বাংলাদেশের দু’টি বাজারই খড়কুটো তুল্য।
ফলে ভারতের চ্যানেলের সংগে পাল্লা দেয়ার কোন দিক থেকেই সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। তবে স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতে টেলিভিশন চ্যানেলের বিস্ফোরণ ঘটার আগে, বাংলাদেশের বিটিভি’র অনুষ্ঠান কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় ছিল। বিটিভির অনেক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল, যেগুলো এখন ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে জমকালো করে উপস্থাপিত হয়। বলা যেতে পারে রিয়ালিটি শো’র কথাই। বিটিভিই নতুন কুঁড়ি শুরু করেছিল। এখন আমরা ইন্ডিয়ান আইডলে মাত হচ্ছি। তার কুঁড়ি কিন্তু নতুন কুঁড়ি থেকেই। বাংলাদেশে এখন শত শত নাটক তৈরি হচ্ছে। টেলিফিল্ম তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই আয়োজন গুলো দেখছে কে? লঞ্চঘাট থেকে প্রাসাদ্যম ফ্ল্যাট সর্বত্রই সকাল থেকে রাত রিমোর্ট খুঁজে ফেরে ভারতীয় টিভি চ্যানেল।
আমি যে অবস্থান থেকে লিখছি, তাতে আমি সুবিধাজনক অবস্থানেই আছি। কারণ আমি নিউজ চ্যানেলে কাজ করছি। ভারতের টিভি চ্যানেলের সংগে আমার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। ঈদে-পার্বণে যখন বিশেষ কোন অনুষ্ঠান তৈরি করি, তখন ভাবনায় পড়ি এই অনুষ্ঠানটি কি দর্শকরা দেখবেন? তবে দু:শ্চিন্তায় থাকি প্রতিদিনই কোন খবরটি বা টক শোটি যে দর্শকরা দেখছেন।
অনেকের কাছ থেকে এ কথা শুনতে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি-উফ নিউজটি বা টকশোটি দেখা হয়নি, কারণ বাসায় স্ত্রী বা মেয়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল দেখছিল। কোনো  কোনো দিন বেশ গর্ব করেই কেউ কেউ বলে বসেন-তার মেয়ে বা ছেলেটি ভারতীয় চ্যানেলের কোনো না কোন অনুষ্ঠান দেখছিল। আবার অনেকের ঢং’এ ভরা অনুযোগ-অভিযোগও শুনতে পাই- বাসায় তাকে কোন একটা কিছু কিনে দিতে হয়েছে, যে আবদারটি এসেছে ভারতীয় চ্যানেল দেখে।
এই যখন অবস্থা তখন আমাদের তৈরি খবর কয়জনা দেখছে তা নিয়ে দু:শ্চিন্তায় না পড়ে উপায় আছে? তবে সান্ত্বনা খুঁজি অনুষ্ঠান নির্ভর চ্যানেলগুলোর কথা ভেবে। তাদের উদ্যোগের প্রায় ষোল আনাই তো মিছে হয়ে যায় ভারতীয় টিভি চ্যানেলের প্লাবনে। বাংলাদেশে যখন পিক আওয়ার তখন সবাই তার সেরা অনুষ্ঠানটিই দেখান। কিন্তু ওদিকে সীমানার ওপাড়ে তখন সেখানকার পিক আওয়ারের অনুষ্ঠানগুলোও শুরু হয়ে গেছে। কোন দর্শক হয়তো করুনা করে নিজের দেশের টেলিভিশনে কিছুক্ষণ যাত্রা বিরতি দেন। তাতেই ধন্য হতে হয়। তার উপর নির্ভর করেই কোন কোন অনুষ্ঠানের ঠাঁই হয় টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি)তে।
টিআরপি’র প্রায় ৬০ শতাংশ যখন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের দখলে তখন বিজ্ঞাপণদাতারা দেশী চ্যানেলকে ফেলে এখন ভারতীয় চ্যানেলমুখি হতে শুরু করেছে। ফলে বিজ্ঞাপনের বাজারে দেখা দিয়েছে মন্দা। ব্যয় অনুযায়ী বিজ্ঞাপণ থেকে আয় করতে পারছে না চ্যানেলগুলো। এরই মধ্যে কোন কোন চ্যানেলে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। কোন কোন চ্যানেল হয়ে পড়ছে রুগ্ন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো’র রুগ্ন হবার কারণ একটাই, সেটা হলো এদেশের দর্শকদের ভারতীয় চ্যানেলের নেশায় আসক্ত হয়ে থাকা। এই আসক্তিরোধে সরকারে হস্তক্ষেপ চাওয়া হচ্ছে।
বলা হচ্ছে সিরিয়াল, ছবি এবং গান প্রচার হয় ২৪ ঘণ্টা এমন ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের উদ্যোগ নিতে। দু’একবার এই উদ্যোগ নিয়েও সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। কিন্তু একথা সরকারকে মানতেই হবে সেদিন খুব দূরে নেই যেদিন তাদের ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল কোথায় দেখা হচ্ছে, তার খোঁজে অভিযান চালাতে হবে। ইয়াবা এবং ফেনসিডিলের আদলেই।
ফুটনোট: মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে আমি এমন বাঁধনের পক্ষপাতি নই। তাই ভারতীয় অন্যান্য শিক্ষামূলক, খেলা ও সংবাদভিত্তিক চ্যানেল মুক্ত রাখার পক্ষে। যেহেতু আলোচ্য চ্যানেলগুলো আমাদের পরিবার,সমাজ ও অর্থনীতির উপর নীল ছায়া ফেলেছে, তাই এই চ্যানেলগুলোর বাংলাদেশে সম্প্রচার বন্ধের পক্ষে। এতে ফায়দা সুনিশ্চিত। যেমনটি ডোরিমনের সম্প্রচার বন্ধের পর পাওয়া গেছে।
তুষার আবদুল্লাহ : বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button