ব্রিটেনে ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশী শতাধিক অর্থ প্রেরক এজেন্সি
গোলাম মোস্তফা ফারুক: ব্রিটেনের বিখ্যাত বার্কলেজ ব্যাংক সে দেশ থেকে অর্থ পাঠানোর কাজ করে এমন এজেন্সিগুলোর মানি সার্ভিসেস বিজনেস অ্যাকাউন্ট (এমএসবি অ্যাকাউন্ট) ২৬ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেবে। এর ফলে ঝুঁকির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশী শতাধিক অর্থ প্রেরক এজেন্সি।
এর আগে ব্রিটেনের এইচএসবিসি (হংকং-সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশন) ‘সন্দেহজনক লেনদেন করছে’ তালিকায় নাম থাকা ৪০টি দেশের দূতাবাস ও মিশনের অ্যাকাউন্ট ১২ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেয়। এ পর্যায়ে তারা লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ হাইকমিশন ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংকে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলেছে।
জরিমানার কারণে : অর্থ প্রেরক এজেন্সিরা মানি লন্ডারিং করায় ক্লিয়ারিং ব্যাংকগুলো প্রায়ই বিপুল অর্থ জরিমানা দেয়। তাই সাবধানতা অবলম্বন হিসেবে বার্কলেজ ব্যাংক এমএসবি অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিচ্ছে।
‘মানি সার্ভিসেস বিজনেস অ্যাকাউন্ট’ ১০ জুলাই বন্ধ করার কথা থাকলেও রমজান ও ঈদের কারণে আরও এক মাস সময় বৃদ্ধি করা হয়। ১০ আগস্ট শেষ সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। পরে তা বাড়িয়ে ১০ সেপ্টেম্বর করা হয়। এজেন্সিগুলো আপত্তি জানালে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিলে প্রবাসীদের বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর সুবিধা সংকুচিত হবে, ফলে আবার অবৈধ হুন্ডি ব্যবসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এর প্রভাব পড়ার আশংকা দেখা দেবে। এজেন্সিগুলো তাদের অ্যাকাউন্ট চালু রাখার দাবিতে সোচ্চার। তারা প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও অর্থমন্ত্রীসহ বেশ কয়েক জায়গায় স্মারকলিপি দিয়েছেন। বুধবার প্রায় ২৫ হাজার স্বাক্ষর সংবলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে পেশ করেন।
বার্কলেজ ব্যাংকের মতো ক্লিয়ারিং ব্যাংকগুলোর অভিযোগ : যে পরিমাণ টাকা অর্থ প্রেরণকারী এজেন্সিগুলো পাঠায় কোনো অনিয়ম হলে তার চেয়ে বেশি অর্থ জরিমানা গুনতে হয় বলে এমন ঝুঁকি ব্যবসা তারা করতে রাজি নন। তাছাড়া কে কোন উদ্দেশ্যে অর্থ প্রেরণ করছে, কোন বিশাল অংকের অর্থ কোথায় কাজে লাগছে, কার কাছে তা যাচ্ছে এবং যিনি প্রেরণ করছেন তার আয়ের উৎস- এসব মনিটরিং করা সব সময় তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ব্যতিক্রম ঘটলে জরিমানা এবং ব্যাংকের সুনাম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এসব বিবেচনা করে তারা অর্থ প্রেরণকারী এজেন্সির সঙ্গে এমএসএ একাউন্ট রাখতে চান না।
অর্থ প্রেরণকারীদের একাউন্ট সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বন্ধ করে দিলে বৈধভাবে অর্থ প্রেরণের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়বে। ব্রিটেনে বাংলাদেশী মানি ট্রান্সফার এজেন্সির সংখ্যা দুই শতাধিক। দেশটির ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অথরিটি- এফএসএর নিয়ম অনুযায়ী বিদেশে অর্থ আদান-প্রদানের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে একটি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক ব্যাংকে এমএসবি একাউন্ট খুলতে হয়। ব্রিটেনের প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থ প্রেরণকারী এজেন্সির এমএসবি একাউন্ট স্থানীয় বার্কলেজ ব্যাংকের সঙ্গে।
বাংলাদেশের প্রায় ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা রয়েছে ব্রিটেনে। তারা দেশে অন্যান্য অর্থ প্রেরণকারী এজেন্সির মতোই টাকা পাঠিয়ে থাকেন। এসব এজেন্সি শুধু অর্থ প্রেরণ করে। তাদের মাধ্যমে কোন অর্থ ব্রিটেনে আনা যায় না। এসব এজেন্সির অধিকাংশই নগদ অর্থ গ্রহণ করে থাকে, ফলে টাকার উৎস নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। এ কারণেই ক্লিয়ারিং ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে অপারগতা প্রকাশ করে।
একাউন্ট বন্ধের খবরে এজেন্সিগুলোর কর্মকর্তারা বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। বার্কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তাদের বৈঠক হয়েছে। কোনো কিছুতেই বার্কলেজ ব্যাংক অর্থ প্রেরণকারীদের সঙ্গে তাদের এমএসবি হিসাব চালু রাখতে রাজি নয়। বিষয়টি গুরুতর দৃষ্টিতে দেখছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী। তিনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রেমিটেন্সের গুরুত্ব তুলে ধরে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ে বৈঠক করেছেন। মানি ট্রান্সফার ব্যবসা বাঁচাতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ৪৬ এমপির একটি সুপারিশনামা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রদান করেছেন। গত ২ জুলাই হাউস অব কমন্সে এ বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায় বৈঠক হয়। তারই অংশ হিসেবে ৪৬ এমপির চিঠি দেয়া হয় বার্কলেজ ব্যাংকে। চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী রেমিটেন্সের প্রবাহ ছিল ৫৩০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু ব্রিটেন থেকে রেমিটেন্স প্রেরিত হয়েছে ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যা ব্রিটিশ সরকারের বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্দের পাশাপাশি আরেকটি গর্বের বিষয়। তাছাড়া প্রতিবছর বিশ্বে দারিদ্র্য বিমোচনসহ নানা কারণে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্য বিলি হয়, তার চেয়ে রেমিটেন্সের এই পরিমাণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এর ভূমিকা অনেক গুণ বেশি। তারা বলেন, ব্যবসায়িক ঝুঁকি মোকাবেলায় যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। কিন্তু কোনো পরামর্শ ছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রেখে বাকি একাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার কারণ তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তারা একাউন্টগুলো আরও ৬ মাস চালু রাখার দাবি জানান।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৮ শতাংশ যায় ব্রিটেন থেকে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ব্রিটেন থেকে রেমিটেন্সের প্রবাহ ছিল ৭৮৮.৮৫ মিলিয়ন ডলার। ২০১১-১২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৯৮৭.৪৬ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। বৈধপথে রেমিটেন্স পাঠানো সহজ হওয়ার কারণে এ প্রবাহ দিন দিন বাড়ছে।