বয়কটের মাধ্যমে সার্কের স্যাবোটাজ
১৯৮৫ সালে ঢাকায় সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর রিজিওনাল কোঅপারেশান (সার্ক) গঠিত হওয়ার সময় থেকেই এটাকে কখনও পছন্দ করেনি ভারতের ক্ষমতাসীনরা। মাঝে মাঝেই নয়াদিল্লীর ক্ষমতাসীনদের কর্মকাণ্ডে পঙ্গু হয়ে গেছে সংস্থাটি, তা সেখানে ক্ষমতায় যারাই থাক না কেন। আর সংস্থাটির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সম্মেলন বয়কটের বিষয়টি যেভাবেই হোক নয়াদিল্লীর প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাবেক বাংলাদেশী প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যাকে সাউথ ব্লক কখনই ভারতের বন্ধু হিসেবে দেখেনি। মজার ব্যাপার হলো যখনই সম্মেলন ভণ্ডুলের প্রচেষ্টা নেয়, তখনই তারা সার্কের সনদটাকে ব্যবহার করে আবার সেটাকেই লঙ্ঘন করে।
সনদে বলা হয়েছে যে, সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিটি সদস্য দেশের সরকার প্রধানকে নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নিতে হবে। নয়াদিল্লী এই ধারাটাকে ব্যবহার করে এবং সম্মেলন থেকে দূরে থাকে। সম্মেলন এমনিতেই ভণ্ডুল হয়ে যায়। সনদে আরও বলা হয়েছে যে, সম্মিলিত স্বার্থের দিকে মনোযোগ দেয়ার জন্য সম্মেলনে কোন সদস্য দ্বিপাক্ষিক ইস্যু এবং দ্বণ্দ্বের বিষয় উপস্থাপন করা যাবে না। কিন্তু যখনই সম্মেলন বাতিল করতে চায় ভারত, এটাকে তারা নির্লজ্জভাবে লঙ্ঘন করে। এ পর্যন্ত যে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক ইস্যু সার্ক সম্মেলনকে পণ্ড করেছে, সেগুলোর অধিকাংশ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট।
ভারত-পাকিস্তান বিবাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সার্ক, আর এর মূলে আছে কাশ্মির এবং সেখানকার অন্তহীন সহিংসতা, কাশ্মিরিদের আজাদি আন্দোলনে পাকিস্তানের ভূমিকা এবং পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তৎপরতা। এর ফলাফল হলো সার্ক সনদ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং সংস্থাটি একটা চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। এমনকি নিচের পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকজনের অর্থপূর্ণ প্রচেষ্টাও ফলাফল আনতে ব্যর্থ হচ্ছে কারণ সরকার পর্যায়ে নেতাদের মধ্যে বিভক্তি রয়ে গেছে।
ইসলামাবাদ সম্মেলন বয়কটের হুমকি
অতি স¤প্রতি, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সার্কের প্রতি একটা আঘাত ছুড়েছেন। সুনির্দিষ্টভাবে তিনি বলেছেন যে, ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সংস্থার সম্মেলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে পাকিস্তানের আমন্ত্রণ ভারত গ্রহণ করবে না।
ভারত অংশগ্রহণ না করলে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে না, কারণ সার্কের সনদ অনুযায়ী সম্মেলন হতে হলে সবগুলো দেশের সরকারপ্রধানদের এতে অংশগ্রহণ করতে হবে।
সম্মেলন বয়কটের কারণ হিসেবে ভারত সীমান্ত পথে পরিচালিত সন্ত্রাস এবং পাকিস্তান-ভিত্তিক সংগঠন কর্তৃক অমৃৎসরের নিরানকারি মাজারে বোমা হামলার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। স্বরাজ সম্প্রতি বলেছেন, “সন্ত্রাসবাদ আর আলোচনা একসাথে চলতে পারে না”।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সম্মেলন বয়কটের ঘোষণা দেয়ার ঠিক আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষ থেকে খুবই আশাব্যঞ্জক বিবৃতি এসেছে। ভারত ও পাকিস্তানে অবস্থিত শিখদের দুটো পবিত্র জায়গার মাঝখানে করিডোর নির্মাণ উপলক্ষে তারা ওই বক্তব্য দিয়েছিলেন।
মোদি বলেন যে, বার্লিন দেয়ালের পতনের মাধ্যমে যেভাবে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যে দূরত্ব ঘুঁচে গিয়েছিল সেভাবে এই রোড লিঙ্ক ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভেদকে দূর করে দেবে। আর ইমরান খান বলেছেন যে, ভারত যদি শান্তি ও বোঝাপড়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে আসে, তাহলে পাকিস্তান দুই ধাপ এগিয়ে যাবে।
রাজনৈতিক বলয়গুলো মনে করছে যে, করিডোর নির্মাণ মোদির বিজেপিকে পাঞ্জাবের শিখদের সমর্থন পেতে সাহায্য করবে যেটা তারা ২০১৭ সালে হারিয়েছে। আর পাকিস্তান-বিরোধী অবস্থান এবং সার্ক সম্মেলন বয়কট করে তারা হিন্দু ভোটগুলোকেও ধরে রাখতে চায়। ২০১৯ সালে মে মাসে ভারতে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং প্রতিটি পদক্ষেপেরই এখানে রাজনৈতিক দিক রয়েছে।
রাজনীতি আরও সার্কের ক্ষতি করলো। প্রতিবেশী দেশগুলোতে শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন আনতে তাদের মধ্যে সংলাপ ও অর্থপূর্ণ সহযোগিতা এড়ানোর মাধ্যমে পঙ্গু সার্ক আরও পঙ্গু হয়ে গেলো।
এটাই প্রথম নয়
বয়কটের কারণে সার্ক সম্মেলন না হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। পাকিস্তানী পণ্ডিত ড. মানজুর আহমেদ তার ‘সার্ক সামিটস ১৯৮৫-২০১৬: দ্য ক্যানসেলেশান ফেনোমেনন’ শীর্ষক নিবন্ধে সার্ক সম্মেলন নিয়ে বেশ কিছু মজার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।
সার্কের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ১৯৮৫ সালে (৭-৮ ডিসেম্বর), যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক যাত্রা শুরু করে। এর পর থেকে মাত্র ১৮ বার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে: প্রথম ১৫ বছরে (১৯৮৬-২০০০) ১০ বার এবং পরের ১৫ বছরে (২০০১-২০১৬) আটবার।
তিনি আরও জানান, সম্মেলন বাতিল হয়েছে ১৯৮৯, ১৯৯২, ১৯৯৪, ১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১, ২০০৩, ২০০৬, ২০০৯, ২০১২, ২০১৩, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে।
প্রথম দশক
প্রথম দশকে (১৯৮৬-১৯৯৫), মাত্র সাতটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৮৯, ১৯৯২ এবং ১৯৯৪ সালে সম্মেলন হতে পারেনি। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে সম্মেলনের ভেন্যু বদল করতে হয়েছে।
ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনা
বাংলাদেশ (১৯৯২) এবং ভারতের (১৯৯৪) সম্মেলন ১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালে পিছিয়ে নিতে হয়েছিল। ১৯৯২ সালের ঢাকা সম্মেলন স্থগিত করা হয় যখন তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাও এতে অংশ নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে বাংলাদেশে মুসলিমরা বিক্ষোভ করছে এবং সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবস্থা ভালো নয়। এটাই প্রথমবার সম্মেলনে অংশ নিতে অস্বীকার করে ভারত।
ভারত-পাকিস্তান বিবাদ
ভারত-পাকিস্তান বিবাদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে সার্ক, আর এর মূলে আছে কাশ্মির এবং সেখানকার অন্তহীন সহিংসতা, কাশ্মিরিদের আজাদি আন্দোলনে পাকিস্তানের ভূমিকা এবং পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর তৎপরতা। এর ফলাফল হলো সার্ক সনদ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এবং সংস্থাটি একটা চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিপতিত হয়েছে।
অষ্টম সম্মেলন ১৯৯৪ সালে পাকিস্তানে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্ব›েদ্বর কারণে এটা বাতিল করা হয়। পাকিস্তান কাশ্মীরের মুসলিমদের দমনের পেছনে ভারতকে অভিযুক্ত করে এবং কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে অংশ নিতে চায়। কিন্তু ভারত বলে যে, কাশ্মীরের সহিংসতা পাকিস্তান এবং তাদের অর্থায়নে পরিচালিত সন্ত্রাসীদের কাজ। নয়াদিল্লী এটাও জোর দিয়ে বলে যে, ভারতের সাথে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করার কোন সুযোগ নেই।
ভারত ও পাকিস্তান ১৯৯০ সালে সংলাপ শুরু করেছিল। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সেটা বন্ধ ছিল। তবে, ১৯৯৫ সালে দিল্লীতে একটি সম্মেলন হয় এবং পাকিস্তান সেখানে অংশগ্রহণও করেছিল।
দ্বিতীয় দশক
দ্বিতীয় দশকে (১৯৯৬-২০০৫) মাত্র পাঁচটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০১ এবং ২০০৩ সালে সম্মেলন হতে পারেনি। এখানেও কারণ ছিল ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা।
তৃতীয় দশক
তৃতীয় দশকেও (২০০৬-২০১৫) সার্ক সম্মেলন আয়োজনে দীর্ঘ বিলম্ব হয়েছে। এ সময়ে মাত্র পাঁচটি সম্মেলন হয়েছে। ২০০৬, ২০০৯, ২০১২, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে কোন সম্মেলন হয়নি।
চতুর্থ দশক
চতুর্থ দশকে (২০১৬-) একটি সম্মেলন বাতিলের ঘটনা রয়েছে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভারতের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি দেশ সেটা বয়কট করায় সম্মেলন বাতিল করা হয়।
কাশ্মীরের উরিতে একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলার জন্য পাকিস্তান তাদের এজেন্ট ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ করে ভারত। অন্য দেশগুলোকে নিজেদের কারণ দেখিয়ে সম্মেলন বয়কটের জন্য প্ররোচিত করা হয়। বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে (অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথিত হস্তক্ষেপের) ইস্যু রয়েছে কিন্তু শ্রীলংকা ও ভুটানও ভূ-রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ভারতের পক্ষে থাকাকেই বেছে নেয়। -সাউথ এশিয়ান মনিটর