রূপকথার বিয়ে
বিয়ন্স, ভাঙরা ও শত কোটি টাকার আয়োজন
এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ ধনীর মেয়ে ঈশা অম্বানি গতকাল বুধবার মুম্বাইয়ে তার শৈশব বন্ধুকে বিয়ে করলেন। সপ্তাহব্যাপী এই বিয়ের উদযাপন ছিল রাজকীয় মাত্রা থেকেও বেশি জমকালো। ভারতের বিয়ে এমনিতেও দীর্ঘ এবং জমকালো হলেও খরচের দিক থেকে এই বিয়ে ছিল অন্য মাত্রার, হয়তো অন্য গ্রহের। ভারতীয় বিবাহ দীর্ঘ এবং বিস্তৃত জন্য পরিচিত হয়। কিন্তু কোনও উপায়ে, সম্ভবত এশিয়ার ধনী ব্যক্তির মেয়ের ঈশা অম্বানির জন্য সপ্তাহব্যাপী উদযাপন, অন্য স্তরের-অথবা গ্রহ-অত্যধিকতার উপর।
২৭ বছর বয়সী অম্বানি কন্যার বিয়ে হচ্ছে শৈশব বন্ধু ৩৩ বছরের আনন্দ পিরামলের সঙ্গে। রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার ও ভারতের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে আনন্দ। তাদের বিয়ের সাপ্তাহব্যাপী আয়োজনে মূল অংশ ছিল পাঁচটি। বিলাসবহুল হোটেলের কক্ষ, ভাড়া করা বিমান, দামী খাবার এবং বিনোদন বাবদ খরচ নিয়ে হয়েছে নানা জল্পনা। সংবাদমাধ্যম ব্লমবার্গের হিসাবে খরচ প্রায় সাড়ে আটশ’ কোটি টাকা বলা হলেও, পরিবারটির নিকটবর্তী একজন ব্যক্তি বর্তমান বাজার দরের উপর ভিত্তি করে খরচ সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। যুক্তরাজ্যের প্রিন্স হ্যারির বিয়ের জন্য খরচ হয়েছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার, যেখানে শ্রম মূল্য অনেক বেশি।
তবে খরচ যাই হোক, এটি নববধূর বাবা ৪২ বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির মালিক মুকেশ ডি. অম্বানির জন্য কোন বিষয় নয়। ‘দ্য বিলিয়নিয়ার রাজ : এ জার্নি থ্রু ইন্ডিয়াস নিউ গিল্ডেড এজ’ এর লেখক জেমস ক্র্যাবট্রি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারতীয় বিয়ে নতুন ধনীদের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। অম্বানি ও তার স্ত্রী নিতা কর্তৃক আয়োজিত বিবাহ পূর্ব উৎসব শনিবার উত্তর ভারতের বিখ্যাত উদয়পুর দূর্গে আয়োজন কার হয়েছিল যেখানে, বিশ্বের অনেক সেলিব্রিটি অংশগ্রহণ করে।
তালিকার প্রথম শ্রেণীর অতিথিদের মধ্যে ছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং জন কেরি, যারা ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলের বিখ্যাত নাচ ভাঙরায় অংশগ্রহণ করে নেচেছিলেন। সেখানে, ৪৫ মিনিটের ব্যক্তিগত কনসার্টে গান গেয়েছিলেন বিখ্যাত মার্কিন গায়িকা বিয়োন্স। সেখানে কিছু সময়ের জন্য বলিউড তারকা সালমান খানও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
শনিবারের অনুষ্ঠান উপলক্ষে উদয়পুর লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়, কারণ অম্বানিদের অতিথিতে শহরের সব হোটেলগুলো ভরে যায় এবং সেখানকার ছোট বিমানবন্দরে জটলার সৃষ্টি হয়। এমনকি মুম্বাইয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও শনিবার ট্রাফিকের জন্য নতুন রেকর্ড হয়, কারণ এক ডজনেরও বেশি বেসরকারি চার্টার্ড ফ্লাইট সেদিন সেখান থেকে যাত্রা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিয়ের এক অতিথি বলেন, বিয়ের আমন্ত্রণপত্র এসেছিল বিখ্যাত ব্র্যান্ড ডলসে এন্ড গ্যাবানার বাক্সে, এটি গোলাপী ও সোনার লেইসে আটকানো ছিল। এর সাথে ছিল স্বর্ণের চেইন যা গয়না হিসাবেও পরা যায়।
তিনি আরো বলেন, উদয়পুরের অনুষ্ঠান প্রায় ২০০০ জন অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, বলিউড নর্তকীদের সাথে নববধূর মা নিতা অম্বানি ও তার দুই ছেলে আকাশ ও অনন্তের নাচ। মুকেশ আম্বানির বাবা ধীরুভাই অম্বানি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষকের ছেলে, যিনি ভারতে এমন সময়ে তার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন যখন বেশিরভাগ বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। তার প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ভারতের শিল্প রেনেসাঁর শুরু হিসাবে দেখা হয়।
ধীরুভাই অম্বানির মৃত্যুতে তার পুত্র মুকেশ ও অনিল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে লড়াই করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মুকেশ পেট্রোলিয়াম এবং প্লাস্টিকের ব্যবসা নিয়েছিলেন এবং অনিলকে টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক সেবা প্রদান ব্যবসা দিয়েছিলেন। মুকেশ রিলায়েন্সের তার অংশ কাজে লাগিয়েছিলেন নতুন মোবাইল ফোন কোম্পানি রিলায়েন্স জিও তৈরির জন্য, যেটি মাত্র ২ ডলারে মাসব্যাপী সীমাহীন কল এবং প্রচুর ডেটা দেয়ার সুযোগ দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেয় যার ফলে অনিলের টেলিকম কোম্পানি লোকসানে বন্ধ হয়ে যায়।
তবে, তাদের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূরে রেখে দুই ভাই উদয়পুরের যৌথভাবে অতিথিদের স্বাগত জানায়। বুধবার মুকেশ আম্বানির দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ২৭তলা বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়, যেখানে ছয় স্তরের পার্কিং গ্যারেজ এবং তিনটি হেলিপ্যাড রয়েছে। (ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মিসেস ক্লিনটন গত মার্চে একটি কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য ভারতে আসলে এই টাওয়ারে অম্বানির আপ্যায়নে এসেছিলেন।) এই সপ্তাহের আয়োজনের মধ্যে মুম্বাইয়ে পিরামলের বাবার বাড়িতেও একটি অনুষ্ঠান উদযাপন করা হবে এবং অম্বানির মালিকানাধীন মুম্বাইয়ের একটি ইভেন্ট স্থান জিও গার্ডেনে বিয়ের রিসিপশন অনুষ্ঠিত হবে। তবে, ভারতে সবাই এই অনুষ্ঠান ভালোভাবে নিচ্ছেন না। কিছু সমালোচক সামাজিক মিডিয়াতে বলেছেন যে, অতি দারিদ্র্য পীড়িত একটি দেশে এ ধরণের অপব্যায় খুব দৃষ্টিকটূ।
প্যারিসভিত্তিক বিশ্ব বৈষম্য ল্যাবের গত মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০১২ সালে ভারতের ৬৩ শতাংশ সম্পদের মালিক ছিল ধনী ১০ শতাংশ ব্যক্তি। যেখানে, ১৯৮১ সালে ১০ শতাংশ ব্যাক্তির মালিকানায় ছিল দেশের ৪৫ শতাংশ সম্পদ।