গৌরবময় বিজয় দিবস

প্রফেসর মো: আবু নসর: ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তার প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। তবে স্বাধীনতার যুদ্ধ নিছক একটি ভূখণ্ড প্রাপ্তি, জাতীয় সঙ্গীত বা পতাকা পরিবর্তনের জন্য ছিল না, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও লক্ষ্য এই যুদ্ধের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়েছিল। এ কারণে ’৭১-এর এই যুদ্ধকে শুধু ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ না বলে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, তার ভিত্তি হচ্ছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এর চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূর্ত হয়েছে ’৭২-এর সংবিধানে।

প্রত্যেক মানুষই একটি অপার সম্ভাবনার নাম। প্রত্যেকের হৃদয়ের মধ্যে আছে এক অন্তহীন জগৎ। এই জগৎ হলো সততা, নৈতিকতা ও সর্বোপরি, দেশপ্রেমের জগৎ। এতে উদ্বুদ্ধ হয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে নির্ভীক মুক্তিসেনারা দুঃশাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাঙালিরা মনের বল ও দেশপ্রেমের অদম্য তাগিদে বৈরী শক্তির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদঞ্চলের নেতৃস্থানীয় সাহসী ব্যক্তিরা জনসাধারণকে সাথে নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। ইতিহাসে ঈশা খাঁ থেকে শরীয়তুল্লাহ, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, তিতুমীর, সূর্যসেন তার জ্বলন্ত প্রতীক। জাতীয় চেতনায় তাই ‘বাঙলি’ হিসেবে গর্ব করার যথেষ্ট কারণ আছে। সংগ্রামমুখর ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ সাল এরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ও প্রমাণ।

সুদীর্ঘ দুঃশাসন, শোষণ ও নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে মহান স্বাধীনতা ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক ভাষণ সর্বপ্রণিধানযোগ্য। ‘ঐতিহাসিক’ এ অর্থে যে, এ ভাষণের মধ্যে স্বাধীনতা ঘোষণার একটা উইলফোর্স, গাইডলাইন ও স্পিরিট ছিল। ৭ মার্চ ও বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই ইতিহাস দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অবস্মিরণীয় দিন। ৭ মার্চের সে ভাষণই স্বাধীনতার অভ্যুদয়ের প্রামাণ্য দলিল ও ঘোষণাপত্র, যার প্রতিটি শব্দ মুক্তিসংগ্রাম আর স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত। বঙ্গবন্ধুর সাহসী ও আপসহীন নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়েই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ জাতি।

বাঙালি জাতির তদানীন্তন অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে বিশ্ব ইতিহাসের প্রচণ্ডতম রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনে বিশ্বের মানচিত্রে নতুন এক স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে, তথা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে এবং ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মানবসভ্যতা ও স্বাধীনতা অর্জনের নিরেখে অমূল্য । মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রেরণার অনন্য একটি উৎস। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ চরম ত্যাগের অমরগাথা এবং জাতির গৌরবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আনন্দ-বেদনায় মিশ্রিত এক মুক্তিযুদ্ধ। প্রকৃত নেতা তৈরি করেন ইতিহাস। ইতিহাস তৈরি করে মানুষ। ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হয়ে আছে এক সাগর রক্তের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিকথা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বীরত্বগাথা এবং বিজয়গাথা। একাত্তরের এই যুদ্ধ ছিল এক জীবন-মরণ জনযুদ্ধ।

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে আমাদের প্রতিশ্রুতি হবে অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সুবিচারপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল রাষ্ট্র গঠন করা। মহান বিজয় দিবস জাতির জীবনে স্মরণীয় ও অতীব তাৎপর্যপূর্ণ দিন। অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে দীপ্ত শপথ গ্রহণের দিবস।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে পরাজিত, পর্যুদস্ত, আশাহীন, দিশাহীন একটি জাতির সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের আবির্ভাব ছিল আলোকবর্তিকার মতো। যখন পরনির্ভরতা ও পরদাসত্বের বন্ধনে আটকা পড়েছিল বাংলাদেশ, এমন এক দুঃসময়ে সহজাত সাহস এবং অপরাজেয় সঙ্কল্পের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন অসাধারণ দৃঢ় চরিত্রের নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। তিনি জীবনের বছরগুলো ব্যয় করেছিলেন ঘুমন্ত জাতির জাগরণের পেছনে। আত্মশক্তিতে শক্তিশালী করে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার দিকে। মুজিবের মতো নেতাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই বাংলাদেশ। তিনি জাতিকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। অকুতোভয় জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের তার জীবন নিবেদিত ও উৎসর্গকৃত ছিল। তিনি নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চার মধ্য দিয়ে তার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সম্ভব।

বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতার ফল হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন। স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘একসাগর’ রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তাই জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে আমাদের প্রতিশ্রুতি হবে অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, সুবিচারপূর্ণ, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও সৃজনশীল রাষ্ট্র গঠন করা। মহান বিজয় দিবস জাতির জীবনে স্মরণীয় ও অতীব তাৎপর্যপূর্ণ দিন। অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্তে দীপ্ত শপথ গ্রহণের দিবস।

মুক্তিযোদ্ধারা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে অভিহিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হাজার বছরের সংগ্রামের পরিণতি। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী বাঙালি হৃদয়ে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে। তাদের আত্মত্যাগের ফসল নষ্ট হয়নি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধসহ স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব বীর শহীদের বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রকৃত চেতনাকে আজ আমরা হারাতে বসেছি, ভুলতে বসেছি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই ইতিহাস বিস্মৃত হতে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরসমুন্নত রাখা ও নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক চিত্র তুলে ধরা অপরিহার্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিজয়ের আনন্দ পৌঁছে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্থান সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক এটাই সবার কাম্য। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের অধিকার, মর্যাদা নিশ্চিত করা জাতীয় কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অত্যন্ত প্রশংসনীয় নয়।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button