বিদায় মনোয়ার বদরুদ্দোজা: হাসপাতালে যেমন কেটেছিলো শেষ দিনগুলো

তাইসির মাহমুদ: মনোয়ার হোসাইন বদরুদ্দোজা। সংগঠক, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী। বয়স পঞ্চাশের কোটা ছাড়লেও সবসময় ছিলেন তারুণ্যদীপ্ত। কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ জানলাম তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। বেঁচে থাকা প্রায় অনিশ্চিত। বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্খীরা দলেদলে তাঁকে দেখতে যাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিদিনই সচিত্র স্ট্যাটাস আসছে। ভাবছিলাম শীঘ্রই দেখতে যাবো। কিন্তু যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয়ে ওঠছিলোনা। এরই মধ্যে জানতে পারলাম তিনি হাসপাতালে চলে গেছেন। চিকিৎসা চলছে। কিন্তু গত সপ্তাহে হঠাৎ আরো একটি স্ট্যাটাস দেখে আতকে উঠলাম। তাঁর এক শুভাকাঙ্খী লিখেছেন, মনোয়ার হোসাইন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে গেছেন। ডাক্তার তাঁর আয়ূসীমা বেঁধে দিয়েছেন। বড়জোর সপ্তাহ-দশদিন বাঁচতে পারেন।

ভাবলাম আর দেরি করা চলবে না। যেকোনো সময় তিনি চলে যেতে পারেন। আর চলে গেলে দেখতে না যাওয়ার বেদনা আজীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। তাই আজই যাবো। এরই মধ্যে ফোনে ফোনে আরো দুজন সঙ্গীও পেয়ে গেলাম। একজন নিউহ্যাম কাউন্সিলের ডেপুটি স্পীকার ব্যারিস্টার নাজির আহমদ। অন্যজন সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী। অলডগইট থেকে পঁচিশ নম্বর বাসে চড়লাম। যাবো সেইন্ট বার্থ হাসপাতালে। সেন্ট পলস আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনের পাশেই। বাসে মিনিট পনেরোর পথ। রাস্তায় ট্রাফিক কম থাকায় সময়মতোই বাসটি গিয়ে পৌঁছলো হাসপাতালের সম্মুখে। হাসপাতালের প্রবেশ পথে দেখা হলো সাংবাদিক আব্দুস সাত্তার মিশু ও তৌহিদুল করিম মোজাহিদ এর সঙ্গে। তাঁদের গন্তব্যও হাসপাতাল। একসঙ্গে নির্ধারিত কেবিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলাম।

সাধারণত হাসপাতালে রোগী দেখতে গেলে রিসেপশনে গিয়ে নাম বলতে হয়। কর্তব্যরত কর্মকর্তা রোগীর কেবিন দেখিয়ে দেন। কিন্তু আমরা ভেতরে যাওয়ার পর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না। একজন নার্স আমাদেরকে মনোয়ার হোসাইনের কেবিনের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গেলেন। বুঝতে পারলাম, চেহারার মধ্যে বাঙালিয়ানার ছাপ দৃশ্যমান থাকায় নার্স বুঝতে পেরেছেন আমরা মনোয়ার হোসাইনকেই দেখতে এসেছি। তাই তিনি আমাদেরকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই এগিয়ে নিয়ে গেলেন।

ভেতরে ঢোকে দেখলাম কমিউনিটির পরিচিত অনেকেই রয়েছেন। একজন তাঁর শিয়রের কাছে বসে কপালের ওপর এক টুকরো ভেজা কাপড় চেপে ধরে রেখেছেন। তিনি বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। শ্বাস নিচ্ছেন জোরে জোরে। ফ্যাকাশে মুখ। মাথার চুলগুলো প্রায় ঝরে গেছে। উসকো খুশকো দাড়ি। নাভি পর্যন্ত চাঁদরে ঢাকা। বুকের উপরে জামা নেই। শরীর শুকিয়ে পাজরের হাঁড়গুলো বেরিয়ে গেছে। দূর থেকেও হাঁড়গুলো গোনা যাচ্ছে। কংকালের মতো হয়ে আছে পুরো দেহ। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি তিনি চোখ খুললে আমাদের দেখবেন, চিনবেন। আমরা তাঁর সাথে কথা বলবো। এরই মধ্যে কেবিনে ঢুকলেন সাবেক কাউন্সিলার মোহাম্মদ মোস্তাকিম, মাওলানা রফিক আহমদ রফিক, ইস্ট লন্ডন মসজিদের ট্রাস্টি মুহিব রহমানীসহ আরো বেশ ক’জন। কেবিনটি মানুষের উপস্থিতিতে পরিপুর্ণ হয়ে গেলো।

পিনপতন নীরবতায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা। তাঁকে দেখছি আর ভাবছি তিনি কি একটিবারের জন্য চোখ খুলবেন। শেষবারের মতো দুটো কথা বলে যেতে পারবো তাঁর সাথে। মিনিট দশেক অপেক্ষার পর হঠাৎ চোখ খুললেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে শরীরের সকল শক্তি খাটিয়ে ওঠে বসতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ইশারায় বুঝালেন, কপালের উপর রাখা কাপড়টি যেনো আবারও ভিজিয়ে এনে স্বস্থানে রাখা হয়। সঙ্গে সঙ্গে নতুন আরো এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে এনে কপালে রাখা হলো। মনে হলো তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন। এবার থেমে থেমে ভাঙ্গা কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করলেন। প্রথম কথা- তাইসির ভাই, নাজির ভাই, মতি ভাই আপনারা সকলে আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমার জীবনে অনেক ভুল করেছি। আপনাদেরকে কষ্ট দিয়েছি। নাজির ভাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শক্ত করে ধরে বললেন, আমাকে কি মাফ করে দিয়েছেন? আল্লাহ’র ওয়াস্তে আমাকে মাফ করে দিয়েন ভাই। আপনি মাফ না করলে আমার রক্ষা নাই। এরপর আবারও নিস্তেজ হয়ে পড়লেন।

মনোয়ার হোসাইনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দুটো কারণে মন ভরে ওঠলো। এক. তাঁর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। দুই. হাসপাতালে আন্তরিক চিকিৎসাসেবা। লন্ডনের হাসপাতালে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর প্রতি ডাক্তারদের আন্তরিক চিকিৎসাসেবা দেখে মনে পড়লো আমার বাবার মৃত্যুর কথা।

কিছুক্ষণ পর কেবিনে ঢুকলেন একজন নার্স। তিনি মৃদুস্বরে কানে কানে জানতে চাইলেন, তাঁকে কি একটি প্যারাসিটামল দিবেন। মনোয়ার হোসাইন খানিক মাথা নাড়লেন। ক্ষীণকণ্ঠে বললেন- ইয়েস, শিউর। আবার দুই আঙুল মোচড় দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, প্যারাসিটামল ট্যাবলেটটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে যেনো তাঁর মুখে দেয়া হয়। তিনি পানি দিয়ে গিলে নেবেন। এরপর খানিক ওঠে বসলেন। ট্যাবলেটটি মুখে দেয়া হলো। গিলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু গলায় আটকে গেলো। কাশতে থাকলেন। দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করলেন ট্যাবলেট টুকরোগুলো গিলে নিতে, কিন্তু কিছুতেই ভেতরে যাচ্ছিলো না। অনেক কষ্টের পর অবশেষে গিলতে সক্ষম হলেন। এরপর বললেন তাঁর প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। এতো পানির পিপাসা পেয়েছে যে, মনে হচ্ছে সারা দুনিয়ার পানি খেয়ে ফেললেও তৃষ্ণা মিটবেনা।

আমাদের সঙ্গে তাঁর একই কথা, আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি অনেক ভুল করেছি। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বললেন, ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকেই আমি আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছি। রোগ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই অসুখ দিয়েছেন। তিনি ভালো মনে করলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। নতুনবা নিয়ে যাবেন। এখানে আমার করার কিছুই নেই।

আমরা আরো কিছুক্ষণ বসলাম। একদলের পর আরেকদল মানুষ আসছেন, যাচ্ছেন। তিনি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছেন। শুধু একই কথা বলছেন, আমাকে মাফ করে দিয়েন। এভাবে ঘণ্টা দেড়েক বসার পর একসময় বিদায় নিয়ে ওঠে দাড়ালাম। বললাম আবারও দেখতে আসবো মনোয়ার ভাই।

কিন্তু দ্বিতীয়বার আর দেখতে যাওয়ার সুযোগ হলোনা। এর আগেই তিনি স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিয়ে পাড়ি জমালেন অনন্ত জীবনের উদ্দেশে। ডাক্তারের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন। হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার মাত্র চারদিনের মাথায় এগারো ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ছয়টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

জানিনা, এই চারটি দিন তাঁর কেমন কেটেছে। তবে ৮ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় যে দেড় ঘণ্টা সময়ের জন্য তাঁর পাশে ছিলাম, দেখেছি একটি দিন যেনো তাঁর জন্য একটি বছরের সমান। তাঁর কষ্ট দেখে আমরা ছটফট করছিলাম। মনে হয়েছিলো আমাদের শরীরে কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। মৃত্যু যন্ত্রনাদায়ক। আমরা তা জানি, বিশ্বাসও করি। কিন্তু উপলব্ধি হয় কম। তবে মনোয়ার বদরুদ্দোজার পাশে বসে উপলব্ধি করতে পারলাম মৃত্যু যন্ত্রনা কত কষ্টের। তাঁর জন্য একান্ত প্রার্থনা। আল্লাহ তায়ালা যেনো তাঁর মৃত্যুকালীন কষ্টকে পুণ্যে রূপান্তরিত করে দেন। জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে সমাসীন করেন। আমিন।

লেখার ইতি টানতে চাই। তবে শেষ করার আগে একটি ভালো লাগা ও খারাফ লাগা ঘটনার স্মৃতিচারণ করে ইতি টানবো। মনোয়ার হোসাইনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে দুটো কারণে মন ভরে ওঠলো। এক. তাঁর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। দুই. হাসপাতালে আন্তরিক চিকিৎসাসেবা। লন্ডনের হাসপাতালে একজন মৃত্যুপথযাত্রীর প্রতি ডাক্তারদের আন্তরিক চিকিৎসাসেবা দেখে মনে পড়লো আমার বাবার মৃত্যুর কথা। ২০১৫ সালের এপ্রিলে বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্থানীয় ডাক্তারের পরামর্শে নিয়ে যাওয়া হলো সিলেট শহরের নয়াসড়স্থ একটি নামিদামী ক্লিনিকে। চিকিৎসা শুরু হলো। বাবাকে দেখতে আমার ৮ বছরের ছেলে জিবরিল মাহমুদ ও ছোট ভাই মোহাম্মদ রহিমকে সঙ্গে নিয়ে বিমানে করে বাংলাদেশে রওয়ানা দিলাম। ওসমানী বিমানবন্দর পৌঁছে শুনলাম বাবার অবস্থা খুবই খারাপ। এয়ারপোর্ট থেকে দ্রুত ক্লিনিকে পৌঁছলাম। লিফটে মানুষের ভীড় ঠেলে উপরতলায় পৌঁছে যখন আইসিসিউতে ঢুকতে চাইলাম তখন কর্তব্যরত এক নার্স গতিরোধ করলেন। বললেন, সাধারণ মানুষ আইসিসিউতে প্রবেশ নিষেধ। বললাম, লন্ডন থেকে বাবাকে দেখতে এসেছি। তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় আছেন। আমাকে তাঁর কাছে যেতেই হবে। এরপর অনেকটা ধাক্কাধাক্কি করে আমি ও ছোট ভাই ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু আমার ছেলেকে তাঁরা ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। বৃটেনে জন্ম নেয়া ছেলেটি এই প্রথম দেশে গিয়েছিলো তার দাদাকে দেখতে। কিন্তু জীবিতাবস্থায় সে তাঁর দাদাকে দেখতে পারেনি। তাই সে আফাসোস করে বলেছিলো ‘ওরা আমার দাদাকে দেখতে দেয়নি’। বাবাকে নিয়ে যখন স্মৃতিচারণ করি তখন সে একই কথা বলে। তাঁর এই কথাটি শুনলেই আমার ভীষন কষ্ট হয়। মনে হয় সেদিন ওই ক্লিনিকের নার্সটি কেন এতটা অমানবিক ছিলেন। ছেলেটি জীবনে কখনো তাঁর দাদাকে দেখেনি। আর ইহজগতে কোনোদিনও দেখবেনা।

লন্ডনে মানুষের মৃত্যুর সময় তাঁর কেবিনটি স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রোগীর সাথে সাক্ষাতের সময়সূচি শিথিল করে দেয়া হয়। আত্মীয়-স্বজনকে বলা হয় রোগীর পাশে থাকুন। বেশি করে সময় দিন। এই সময়টাতে রোগী তাঁর স্বজনকে পাশে দেখতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশে রোগীকে আইসিসিউতে বন্দি করে রাখা হয়। আপনজনকেও ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়না। আইসিসিউ নামক টাকা তৈরির কারখানায় তীব্র মরণযন্ত্রণায় হাপাতে হাপাতে যখন মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যায়, তখনই স্বজনকে লাশ বুঝিয়ে দেয়া হয়। আর গুনে নেয়া হয় আইসিসিউর বড় অংকের বিল। বিল দিতে দেরী হলে লাশ বুঝিয়ে দিতেও দেরী হয়। হায় বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা। আমরা এ ধরনের অমানবিক চিকিৎসা সেবা থেকে কবে মুক্তি পাবো?

উল্লেখ্য, মানবাধিকারকর্মী মনোয়ার হোসাইন বদরুদ্দোজার দেশের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বায়মপুর গ্রামে। তাঁর মরহুম পিতা মকদ্দস আলী ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার খ্যাতনামা মুহাদ্দিস। তাঁর বাবার অনেক ছাত্র দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। মনোয়ার হোসাইন নব্বইর দশকে বৃটেনে পাড়ি জমান। তিনি ছিলেন চ্যারিটি সংস্থা ইক্বরা ইন্টারন্যাশাল এর ফাউন্ডার চেয়ারম্যান। ছিলেন আরো বিভিন্ন সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত। লন্ডনে তাঁর একুশ বছরের এক ছেলে ও উনিশ বছরের এক কন্যা সন্তান রয়েছেন। তিনি জানতেন, মৃত্যু তাঁর খুব কাছাকাছি। তাই ওসিয়ত করেছেন দাফন-কাপনের ব্যাপারেও। মৃত্যুর পর লাশ যাবে গ্রামের বাড়িতে। বায়মপুর গ্রামের গোরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশেই শায়িত হবেন তিনি।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক দেশ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button