ইউরোপের কি অবসান ঘটছে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এক বৈশ্বিক উদারতাবাদের সূচনা ঘটে যা ইতিহাসে যে কোনো সময়ের চেয়ে বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এর ভিত্তি ছিল দুটি স্তম্ভ : আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় জাতিসংঘ যা এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নামে পরিচিত।

মুক্তবাজার, মুক্ত মানুষ ও মুক্ত মতবাদের এ দুটি কেন্দ্র আজ গ্রামীণ ও শহরতলির বাইরের বিদ্রোহীদের ধাক্কায় প্রকম্পিত হচ্ছে যারা প্রধানত সাদা খেটে খাওয়া দরিদ্ররা ও উদ্বিগ্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তারা সাধারণত বিশ্বায়ন, অভিবাসন ও প্রযুক্তির জোয়ারের সুফল পায়নি যা লন্ডন, প্যারিস ও সানফ্রান্সিসকোর মত সুপারস্টার সিটি এবং তাদের বহুবিচিত্র সংস্কৃতির জনসংখ্যার উন্নয়ন ঘটিয়েছে।

ব্রিটেন ইইউ ত্যাগ করে অর্থনৈতিক আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে কীভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইইউ-র শুভকামনার চেয়ে আসলে তার ভায়নেই উল্লসিত এটা দেখার পর ইইউ-র এক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ইতালি রোমে কয়েকদিন আগে বলে বসে যে, তারা বোধগম্য ভাবেই তাদের নয়া বিচিত্র চরম বাম ও চরম ডানপন্থী জোটের সরকারের অধীনে একদিন ইইউ ও ইউরোকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। তারপর বড়দিনের কিছু আগে ফ্রান্সের কিছু ইয়েলো ভেস্ট বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভে উদ্বিগ্ন প্যারিসবাসীদের দেখে আমার মনে হয়েছে আমরা ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছি।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর মূল চ্যালেঞ্জ কিন্তু একই : প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের এই দ্রুত গতিশীলতা তাদের সমাজের প্রত্যন্ত প্রান্তগুলোতে আরো বেশি সংখ্যক অভিবাসীকে নিয়ে এসেছে। প্যারিসের সরকারি আবাসনগুলো অভিবাসীদের প্রাধান্যমন্ডিত। পাশাপাশি এর ফলে প্রচুর সামাজিক পরিবর্তন সাধিত হচেছ, যেমন সমকামী বিবাহ ও হিজড়াদের অধিকার এবং আর যা হচ্ছে তা হল গড় কাজ আর গড় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনধারা টিকিয়ে রাখার মত গড় মজুরির যোগান দিচ্ছে না।

যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশ শতকে ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর শক্তির উৎস তারা গড়ে উঠেছিল উচ্চ মজুরি, মাঝারি দক্ষতার চাকুরির উপর। কিন্তু রোবোটিকস ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও আউটসোর্সিং এবং চীনা আমদানি পণ্য বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপযোগী নিয়মবাঁধা হোয়াইট-কলার ও ব্ল-কলার কাজকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

এখন উচ্চ মজুরি, উচ্চ দক্ষতার চাকুরি আছে এবং নিম্ন বেতন, নিম্ন দক্ষতার চাকুরি আছে। কিন্তু উচ্চ মজুরি, মাঝারি দক্ষতার চাকুরি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সীমিত আয়ের অধিকারী হচ্ছে। তাদের অসন্তোষ গিয়ে পড়ছে বিশ^ায়নকৃত নগরের বিলাসীদের উপর যাদের তারা মনে করে যে তাদেরকে অবহেলার চোখে দেখে এবং একালের সকল উচ্চ মজুরির কাজের জন্য ননরুটিন দক্ষতাকে কুক্ষিগত করেছে।

মানুষের যা কিনা ভরসা সেসব বিষয়কে আপনি যখন একসাথে চ্যালেঞ্জ করবেন, তাদের বাসস্থান, চাকুরির নিরাপত্তা, তাদের উন্নতির সম্ভাবনা ও সামাজিক আচরণ তা খারাপ বা ভালো যাই হোক, তাদের জীবন নির্ধারণ করে, তারপর তা সকল সামাজিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করে, আপনি তা থেকে আসলেই একটি প্রচন্ড হিংস্র পাল্টা আঘাত পেতে পারেন যা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার দেশজুড়ে দেখছেন।

ফ্রান্সের আজ একজন নেতা আছে যার কোনো অনুসারী নেই আর বিরোধী দল আছে, কোনো নেতা নেই। যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানি হচ্ছে সব সময় দুই প্রাপ্তবয়স্ক যাদের ইইউ বাজেট ও মানের অংশীদারিত্ব ও আনুগত্য সেই শক্তভিত্তি যা গোটা ইইউ খুঁটিকে একত্রে ধরে রেখেছে।

২৪ নভেম্বর দি গার্ডিয়ান প্যারিসে ইয়েলোভেস্ট বিক্ষোভকারীদের জোরালো কন্ঠস্বরের একটি সংগ্রহ প্রকাশ করে যা তাদের কথা বলে। তাদের একজন ৫৫ বছর বয়স্কা ফ্লোরেন্স। তিনি প্যারিসের বাইরে একটি এয়ার ফ্রেইট কোম্পানিতে কাজ করতেন। তিনি ম্যাক্রোঁ সম্পর্কে বলেন, তিনি যখন টেলিভিশনে হাজির হন তখন আমাদের এই অনুভ‚তি হয় যে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য স্বস্তিকর নন, মনে হয় আমাদের তিনি এক ধরনের অবজ্ঞা করেন।

আরেক বিক্ষোভকারী, লিয়নের এক অবসরপ্রাপ্ত কার্পেন্টার ৬২ বছর বয়স্ক ব্রুনো বিনেলি জলবাযু পরিবর্তন মোকাবেলায় ডিজেলের উপর ম্যাক্রোঁর কর বৃদ্ধিতে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ জ্বালানি তেলের করবৃদ্ধি বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষদের কাছে জোর আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ, কোথাও যেতে হলে শুধু গাড়িই তাদের সম্বল। তিনি বলেন, আমার একটি ছোট ডিজেল চালিত ভ্যান আছে। আমার নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই। কারণ আমি অবসর নিতে যাচ্ছি। আমরা মনে করি যে আমাদের গ্রামের লোকের কথা কেউ মনে রাখে না।

আরেকজন হলেন প্রভিনসের ৬২ বছর বয়স্কা স্কুল শিক্ষিকা মেরি লিমোয়াঁ। তিনি বলেন, তিনি না বাম না ডান। এর ব্যাখ্যা এই যে আমি এখানে এসেছি আমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির জন্য। ম্যাক্রোঁ হচ্ছেন আমাদের ষোড়শ লুই, আর আমরা তার পরিণতির কথা জানি। গিলোটিনে তার জীবনাবসান ঘটে। এই দুরবস্থা মোকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ই.ইউ-র উপর অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করে এগিয়ে আসার দায়িত্ব বর্তায়।

এক্ষেত্রে প্রয়োজন তাদের ব্যাপারে যত্মশীল হওয়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও পুনঃবিতরণের মধ্যে ভারসাম্য আনা, যারা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বোঝা হিসেবে ফেলে রাখা হয়েছে তাদের ব্যাপারে যত্মশীল হওয়া, নতুন মেধা ও ধারণা আকর্ষণের জন্য অবাধ সীমান্ত এবং লোকজনকে তাদের নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া রোধ করা।

কিন্তু সে ধরনের নেতৃত্ব অনুপস্থিত। আমি বুঝতে পেরেছি কেন ব্রিটেনের সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিল- যেন তা তাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল, তারা যা পছন্দ করে না তারা তা রোধ করতে পারবে যেমন ২২ লাখ বিদেশী ইইউ শ্রমিক এবং তারা যা পছন্দ করে তা রাখতে পারবে, যেমন প্রধানত ইইউ বাজারে কিছুই না দিয়ে ব্রিটেনের অবাধ প্রবেশ। কিন্তু এ সবই মিথ্যা।

এখন বরিস জনসনের নেতৃত্বে মিথ্যা ছড়িয়ে দেয়া কনজারভেটিভ পার্টির অবস্থাটা দেখুন যারা দাবি অব্যাহত রেখেছে যে তাদের প্রধানমন্ত্রী ব্রেক্সিট ফ্যান্টাসির কথা বলেছেন বাস্তব প্রেক্ষিতে যা অসম্ভব এবং দ্বিতীয় সেরা পথের সম্মুখীন হওয়া যত খারাপ হোক তা হচ্ছে একদা বিবেকি রাষ্ট্রটি কীভাবে অযৌক্তিক মুহূর্তে একটি সুইসাইড নোট লেখে এবং ফাঁসি নিয়ে, বিষপানে না মাথায় গুলি করে তা বাস্তবায়ন করবে সে বিষয়ে কীভাবে বিরামহীন যুক্তি দেয় তা দেখা। তারা পুনর্বিবেচনা করার ভার পেয়েছে। সংযুক্ত বিশ্বে একটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বাদামের মত।

এর বিপরীতে ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সের প্রবৃদ্ধি বাধামুক্ত করতে ঠিক জিনিসটি করতে সাহস প্রদর্শন করেছেন। এক ফরাসি অর্থনীতিবিদ লুদোভিক সুবরান আমাকে বলেন, কিন্ত তিনি সঠিক হওয়া ও সঠিকভাবে করার মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না। তিনি এটাও বুঝতে পারেন না যে তার নীতিগুাে কীভাবে বিয়ার পানকারী ও ওয়ানি পানকারীর মধ্যে পৃথক প্রভাব ফেলে।

প্রভাবশালী ফরাসি পত্রিকা লা মঁদের লেখক অ্যালেইন ফ্রাশোঁ আমার কাছে মন্তব্য করেন যে ম্যক্রোঁ সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্সি প্রতিষ্ঠা করেছেন, চারপাশে ক্ষুদ্র একটি দল তৈরি করেছেন, তারা হচ্ছে একটি কমান্ডো ইউনিটের মত। ম্যাক্রোঁ ৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোগত খুঁটি স্থাপন করেছেন যা প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন যোগাচ্ছে, বিনিয়োগ অনুকূল কর সংস্কার, স্ফীতকায় রেলওয়ে ইউনিয়নের জন্য পেনশন হ্রাস, শ্রমিক বরখাস্ত ও ভাড়াটে শ্রমিক আনা সহজ করতে শ্রম আইন সংস্কার এবং সর্বাপেক্ষা সুবিধাহীনদের জন্য দক্ষতা ও শিক্ষার জন্য বিরাট নতুন সরকারী বিনিয়োগ।

ম্যাক্রোঁ প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দি¦তা করার আগে তার দলের অস্তিত্ব না থাকার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের সাথে যুক্ত করার মত বা তাদের নাড়ি বোঝার মত কোনো মেয়র ছিল না। তাই যখন তিনি সম্পদশালীদের ও কর্পোরেশনের পক্ষে কর কর্তন করলেন এবং ডিজেল জ্বালানি ও পেনশনের উপর কর আরোপ করে কিছু অংশ পরিশোধ করতে চাইলেন, এক্ষেত্রে গ্রামীণ কর্মজীবী শ্রেণিকে রেয়াত করলেন না যাদের কোনো গণপরিবহন সুবিধা নেই ও কোথাও যেতে হলে গাড়ি চালিয়ে যেতে হয়- তখন তার সরকারের সমর্থক লোকেরা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবাই প্রবল পাল্টা জবাব দিল। নিজেদের অপমানিত বোধ করে তারা ইয়েলো ভেস্ট পরল, গাড়ি চালিয়ে প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছল এবং চিৎকার করে বলল, আপনারা কি এখন আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছেন?

ফ্রাশোঁ বলেন, ম্যাক্রোঁ ভেবেছিলেন তিনি সিঙ্গাপুর শাসন করছেন, বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স নয়। তিনি প্রতিটি রাজনৈতিক ভুল করেছেন, কিছুই বাদ দেননি।
প্রেসিডেন্টের গদি রক্ষা করতে ধাক্কা খাওয়া ম্যাক্রোঁ বাজেট হ্রাস করলেন এবং জ্বালানি কর বৃদ্ধি বাতিল, মাসিক মজুরি ন্যূনতম ১শ’ ইউরো বৃদ্ধি এবং প্রতিমাসে ২ হাজার ইউরোর নিম্নের পেনসনের উপর পরিকল্পিত কর বাতিল করলেন। কিন্তু যেহেতু ইয়েলো ভেস্টের কোনো নেতা নেই তাই পরে কী হল তা কেউ জানতে পারেনি।

মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ মাইকেল ম্যান্ডেলবাম বলেন, ফ্রান্সের আজ একজন নেতা আছে যার কোনো অনুসারী নেই আর বিরোধী দল আছে, কোনো নেতা নেই। যেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানি হচ্ছে সব সময় দুই প্রাপ্তবয়স্ক যাদের ইইউ বাজেট ও মানের অংশীদারিত্ব ও আনুগত্য সেই শক্তভিত্তি যা গোটা ইইউ খুঁটিকে একত্রে ধরে রেখেছে।

এ বিশ্বে উচ্চ কেন্দ্রীভ‚ত দেশগুলো অকেন্দ্রীভূত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি মূল্য দেবে। এটাই সেই মূল পরিবর্তন যা ফ্রান্সকে করতে হবে। যদি সে তা করতে না পারে তাহলে খুঁটিগুলো পতন হবে।
ফ্রান্সের অন্যতম শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক আমার কাছে তা এভাবে উপস্থাপন করেনঃ একই সময়, আমেরিকা যখন প্রাচ্যের হুমকির বিরুদ্ধে সর্বদা ইউরোপীয় ইউনিয়নের জীবন বীমা নীতি ছিল এবং ছিল গণতন্ত্রের বিশ্ব দিশারী, সে বিশ্ব থেকে নিজের প্রত্যাহার শুরু করে যখন রাশিয়া প্রতিশোধেচ্ছা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করল, যখন জার্মানি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দৃষ্টি দিল এবং ইতালি ইইউ-র বিরদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে স্বৈরাচারী রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হল, যখন বহু পথ বেইজিংয়ের দিকে অগ্রসর হল এবং যখন যুক্তরাজ্য আত্মহত্যা করতে নাছোড়বান্দা, অকস্মাৎ ফ্রান্সে যা ঘটল তা প্রান্সকে ছাড়িয়ে গেল। ইউরোপীয় আদর্শ রক্ষাকারী আমরাই সর্বশেষ প্রতিরোধ দেয়াল। যদি ম্যাক্রোঁ ব্যর্থ হন, তা ইউরোপের অবসান বয়ে আনতে পারে।
-লেখক টমাস এল, ফ্রিডম্যান নিউইয়র্ক টাইমসের অপিনিয়ন কলামিস্ট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button