বিবিসির গোপন ক্যামেরায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস

garmentsএখন মাঝরাত। ঢাকার রাস্তায় একটি ভ্যানের ওপর শুয়ে আছি। পোশাক প্রস্তুতকারী একটি কারখানার বাইরে আমি। ভিতরে অনেক শ্রমিক। সকাল ৭টা থেকে তারা এখানে আছে।
আমরা আগেই জেনেছিলাম- হা মীম স্পোর্টসওয়্যার নামের এই কারখানায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় কাজ হয়। এর প্রমাণ পেতে আমরা কারখানার দিকে নজর রাখছিলাম।
কারখানার সামনে একজন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। তিনি আমাদের টের পাননি।
রাত সোয়া ১টা-শ্রমিকরা এখনো ভিতরে ব্যস্ত- তিনি প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে চলে গেলেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে এখানেই আগুন লেগেছিল এবং এটা শিল্প এলাকার মধ্যে অবস্থিত। আজ রাতে খারাপ কোনো কিছু ঘটলে শ্রমিকরা ভিতরে আটকা পড়বে।
অবশেষে রাত আড়াইটায় কারখানা বন্ধ হয়। এরইমধ্যে কাজের সময় সাড়ে ১৯ ঘণ্টা পার হয়েছে।
একজন শ্রমিক কথা বলতে রাজি হলেন। এই বেলা কাজ করে তিনি প্রায় আড়াইশ’ টাকা আয় করেছেন। তিনি বিষাদগ্রস্ত । সকাল ৭টায় তাকে আবারো কাজে যোগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, “আমার খারাপ লাগছে। শরীরটাও ভালো লাগছে না। গত দুই সপ্তাহে প্রায় আট রাত এরকম খাটুনি গেছে।”
দুইদিন পর আমি আবার হা মীম স্পোর্টসওয়্যারে যাই। একটি ভুয়া ব্রিটিশ কোম্পানির হয়ে ক্রেতা সেজে আমি গিয়েছিলাম।
শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা নিয়ে মালিকপক্ষ কী বলে আমি তা জানতে চাই।
আমাদের কারখানা ঘুরে দেখানো হলো। কারখানাটি পুরনো এবং খোলামেলা নয়। একজন নারী একটি টেবিলের নিচে কাজ করছিল।
যেসব অর্ডারের ভিত্তিতে কাজ চলছিল সেগুলো ব্যবস্থাপকরা আমাদের দেখালেন। ছাড়ে পণ্য বিক্রেতা লিডল সুপারমার্কেটের জন্য দেড় লাখ জোড়া জিন্স ও ডাংরি বানাচ্ছিলেন তারা।
কর্মঘণ্টা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আমাকে আশ্বস্ত করা হলো যে, সাড়ে ৫টায় কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
ফটক কখনো বন্ধ হয় কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, ফটক সব সময় খোলা থাকে।
এটা স্পষ্ট, ক্রেতা যা জানতে চায় তাকে সব বিষয়ে উত্তর দেয়া হয়।
এমনকি আমি যে রাতে ওই কারখানার ওপর নজর রেখেছিলাম সেই রাতের কাজের সময়ের তালিকাও আমাকে দিয়েছিল। তারা বলেন, ওই শিফট সাড়ে ৫টায় শেষ হয়েছিল।
কাগজপত্রও ছিল সন্তোষজনক। আমি যদি নিজের চোখে না দেখতাম তাহলে কখনো জানতে পারতাম না যে, শ্রমিকদের জোর করে এতো সময় কাজ করানো হয়।
হা মীম স্পোর্টসওয়ারই একমাত্র পোশাক প্রস্তুতকারী নয়, যারা এই চালাকি করে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির কল্পনা আক্তার বলেন, অনেক কারখানা পশ্চিমা ক্রেতাদের কাছে কর্মঘণ্টা নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেয়।
“কারখানা মালিকরা দুটো আলাদা বই রাখে। একটি তারা ক্রেতাদের এবং অন্যটি শ্রমিকদের দেখায়। ক্রেতাদের তথাকথিত অডিট বাস্তবে কোনো কাজে আসে না।”
এ বিষয়ে হা মীম গ্রুপের উপ মহাব্যবস্থাপক স্বপন কুমার মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হা মীম গ্রুপের কোনো কারখানায় ১৯ ঘণ্টা কাজ করানোর নিয়ম নেই। সাধারণ কর্মঘণ্টার পাশাপাশি নিয়ম অনুযায়ী অতিরিক্ত সময় কাজ করানো হয়। জোর করে শ্রমিকদের কাজ করানোর ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
“বিবিসির প্রতিবেদনে ১৯ ঘণ্টা কাজ করানোর যে দাবি করা হয়েছে তা মিথ্যা ‍ও ভিত্তিহীন।”
‘উদ্বেগের বিষয়’
দুটি পৃথক হাজিরা বই থাকলে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা তদারকির কোনো সুযোগ থাকছে না। ফলে কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়নে পশ্চিমা ক্রেতারা আইন মেনে চলার যে দাবি তুলেছে তা অর্থহীন।
লিডল বলছে, আমরা যে তথ্য পেয়েছি তা খুবই ‘উদ্বেগের’ এবং বাংলাদেশে পোশাক কারখানার পরিবেশের উন্নয়ন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ এতে তার প্রমাণ মিলেছে।
“অবশ্য পরিবর্তনের জন্য সময় লাগবে এবং তা শুধু লিডলের জন্য নয় রিটেইল ইন্ডাস্ট্রির সব সক্রিয় কোম্পানির জন্যই তা চ্যালেঞ্জের।”
এই সুপারমার্কেট বলছে, বাংলাদেশে কারখানায় কর্মপরিবেশের উন্নয়নে তারা ৬০ লাখ পাউন্ডের বেশি বিনিয়োগ করেছে।
শ্রমিকদের ১৯ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা বা তাদের ভিতরে রেখে বাইরে থেকে তালা দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে হা মীম স্পোর্টসওয়ার। তারা বলেছে, কারখানায় অন্য একটি ফটক রয়েছে যেটা খোলা ছিল এবং সেখানে অগ্নিকাণ্ডের কোনো ঘটনা ঘটেনি, শুধু ‘ধোঁয়ার’ সৃষ্টি হয়েছিল।
তারা বলেছে, হাজিরা খাতা নিয়ে আমাদের অভিযোগ ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’। তারা আইন মেনে কাজ করে এবং শ্রমিকদের অধিকার লংঘন করে না।
আমি অন্যান্য কারখানায়ও গিয়েছিলাম, যেখানে ব্রিটিশ রিটেইলারদের সমালোচনা করা হয়।
ঢাকার উপকণ্ঠে ছিল তাজরিন ফ্যাশনস। এটা আগুনে পুড়েছিল। জানালার গ্রিলগুলো এখনো দুমড়ে-মুচড়ে আছে। গত নভেম্বরে এই কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক মানুষ নিহত হয়। তখন আগুনে গলে যায় গ্রিলগুলো।
ওই ঘটনায় স্ত্রী ও শ্যালিকাকে হারানো মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের সঙ্গে আমার কথা হয়। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
“ওই দুপুরেও ওর সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম। অনেক কথা বলেছিলাম। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর আমি যখন ফিরে আসলাম তখন দেখলাম ও আর নেই। আমি নিজের চোখে দেখছিলাম সব কিছু পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওরে বাঁচানোর কোনো উপায় ছিল না।”
যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গত নভেম্বরে অগ্নিকাণ্ডের পর তাজরিন ফ্যশনসের ভিতর থেকে এডিনবার্গ উলেন মিলের পোশাকের বাক্সের ছবি আমাদের দেখানো হয়েছিল।
অথচ এই কোম্পানি বলছে, তাদের অনুমতি ছাড়াই বাতিল পোশাক তাজরিনে রাখা হয়েছিল। তাই আমরা এ বিষয়ে আরো অনুসন্ধান চালাই। আমরা এমন তথ্য দেখিয়েছিলাম যাতে তাজরিনে এডিনবার্গ উলেন মিলের পোশাক বানানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। সেগুলোতে নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট কোড অনুসরণেরও প্রমাণ মেলে। এ থেকে বোঝা যায়, এডিনবার্গ উলেন মিলের টি-শার্ট ও পোলো শার্ট এখানে তৈরি হচ্ছিল এবং কারখানার ভিতরে সেগুলো যাচাই-বাছাই হয়েছিল।
এই কোম্পানির দোকানে বর্তমানে যে সব পোশাক বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর প্রোডাক্ট কোড এবং ওই তথ্যের প্রোডাক্ট কোড একই।
তাজরিনের কর্মীদের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছিলাম। তারা বলেছিল, অগ্নিকাণ্ডের কয়েক মাস আগে এডিনবার্গ উলেন মিলের জন্য সেখানে পোশাক তৈরি করা হয়।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এই ব্রিটিশ কোম্পানি বলেছে, ওই সব কাগজপত্র ‘অসত্য ও বানানো’।
বাংলাদেশে এই শিল্প অর্থের সংস্থান এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করছে।
বেশিরভাগ কারখানাই নিরাপদ ও আধুনিক। তবে লাখ লাখ মানুষ এখনো ওয়েস্টার্ন হাই স্ট্রিটে পোশাকের যোগান দিতে বিপজ্জনক ও নিম্ন মানের পরিবেশে কাজ করছে।
বিবিসির রিচার্ড বিলটনের প্রতিবেদনটি ভাষান্তরিত

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button