প্রেসিডেন্ট মুরসির ১০ ভুল

Mursiআবদুস সালাম আজাদী:
ড. মুহাম্মদ মুরসি মিসরের ক্ষমতায় গিয়ে ১০টি মারাত্মক ভুল করেছেন, যার কারণে সেনা সদস্য দিয়ে তাকে শেষ করার শুধু চেষ্টাই চালানো হয়নি, ইখওয়ান যেন দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তার চেষ্টা প্রাণান্ত চলছে আজ সারা মিসরে। এই চেষ্টায় হাত লাল করেছে সেনাবাহিনী, মিসরের সেকুলার শক্তি, টাকা দিয়েছে আমেরিকার বন্ধুবান্ধব এবং বুদ্ধি ও প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করেছে আন্তর্জাতিক জায়োনিস্ট গ্রুপ।
মুরসির ১০টি ভুলের মধ্যে রয়েছে
এক. ক্ষমতায় এসেই মুরসি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ওই দেশগুলো মিসরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। তিনি চীন দিয়ে শুরু করেছিলেন, এর পরে যান রাশিয়ায়। তৃতীয়বারে যান ব্রাজিল। তারপর পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা। গেলেন সৌদি, কাতার, আরব আমিরাত। কিন্তু ভুলেও তিনি আমেরিকার দিকে তাকাননি, আমেরিকায় যাওয়ার নিয়তও বাঁধেননি। এমনকি যে আমেরিকার টাকা মিসরের সেনাবাহিনীকে আনোয়ার সাদাত থেকে শুরু করে পেট মোটা করতে সাহায্য করল, সেই আমেরিকার প্রতি খুব উঁচু নজরেও কয়েকবার তাকিয়েছেন তিনি। কত বড় ভুল এটা!
দুই. নভেম্বর ২০১২ সালে গাজায় ইসরাইল কর্তৃপক্ষ জোর করে অভিবাসনের চেষ্টা করে। ফিলিস্তিনের আন্দোলনকারী যোদ্ধারা হামাসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে এবং এক অসম যুদ্ধ শুরু হয়। এর নাম ছিল ‘হিজারাতুস সিজ্জিল’। যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ইসরাইলের উৎকণ্ঠা শুরু হয় মুরসির জন্য। হুঙ্কার ছাড়েন মুরসি, ‘মনে রেখো ফিলাস্তিনিরা একা নয়।’ তিনি দ্রুততার সাথে তেল আবিব থেকে মিসরীয় দূতাবাস প্রত্যাহার করে নেন। তার প্রধানমন্ত্রী কিনদিলকে গাজায় পাঠান সাহায্যের চিহ্নস্বরূপ। তিনি হামাসের সাথে প্রতিরোধযুদ্ধে পরিপূর্ণ ঐকমত্য ঘোষণা করে আসেন। খুলে দেন রাফাহ সুড়ঙ্গ এবং দ্রুত যুদ্ধ বিরতিতে বাধ্য করেন ইসরাইলকে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি আরব বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতার মর্যাদায় উন্নীত হলেন, আর অন্য নেতাদের মনে ঢেলে দিলেন হিংসার আগুন। আমেরিকার কয়েকটি জার্নালে তখন মুরসিকে আরবের একমাত্র ইসলামি নেতা হিসেবে উল্লেখ করে, টাইমস তাকে পৃথিবীর প্রথম ১০০ নেতার মর্যাদায় ভূষিত করে।
তিন. সুয়েজ খালের উন্নয়নের জন্য তিনি বিরাট অঙ্কের বাজেট নির্ধারণ করেন। এতে অর্থনীতিবিদেরা মনে করল, আগামী ২০২২ সালের মধ্যেই এখান থেকে মিসরের আয় ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তাই যদি হয়, মিসর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কাতারে দাঁড়িয়ে যাবে। আর এটা হলে আরব দেশগুলোতে আমেরিকার খবরদারিতে আসবে মারাত্মক বাধা। এ ছাড়া ইসরাইলের সিনাই পরিকল্পনা ও ব্যর্থ হবে। আমেরিকার খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এক সেমিনারে বলেন, মুরসির সুয়েজ খাল উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে আরব আমিরাতের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে দুবাইয়ে মারাত্মক ধস নেমে আসবে। কারণ দুবাই ও আবুধাবির সি পোর্টগুলো তখন মূল্য হারিয়ে ফেলবে। ফলে আমেরিকার অর্থনীতিতে দুবাই থেকে আসা সুবিধা লুপ্ত হবে। টানাটানিতে পড়বে সবাই। কী মারাত্মক পরিকল্পনা ছিল মুরসির!!
চার. তিনি ক্ষমতায় যেতে না যেতেই সিনাইয়ে উন্নয়ন কাজ শুরু করে দেন। সিনাইয়ে আছে মিসরের ৩১ শতাংশ ভূমি। এর কোনো উন্নয়ন এতদিন হয়নি। এই ভূখণ্ড উন্নত হলে মিসরের আয় চলে যাবে দ্বিগুণে। চাকরির সুযোগ পাবে হাজার হাজার বেকার। ফলে তিনি ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বাজেট করেন ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। মিসরের সেনাবাহিনীকেও এ এলাকার উন্নয়নে শরিক রাখতে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বাজেটের ঘোষণা দেন। ‘ফাইরুজ মিলিয়ন সিটি’ নামে এখানে বসবাসের সব সুযোগসহ উন্নত ও বিশাল শহর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। সিনাইয়ের উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ইউনিভার্সিটি তৈরি করার জন্য অফিসিয়াল কাজও শুরু করেন তিনি। ঘোষণা দেন ছাত্র ভর্তির জন্য আকর্ষণীয় স্কলারশিপের। এটা ছিল ইসরাইলের সিনাই দখল পরিকল্পনার বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা। এর মতো অপরাধ আজ পর্যন্ত কেউ মিসরে করার সাহস দেখাতে পারেনি।
পাঁচ. মুরসির চিন্তা ছিল মিসরের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া। কাজেই ক্ষমতায় গিয়ে দেরি না করেই নতুন খাদ্যগুদাম বানানো শুরু করেন তিনি। তিনি কৃষকদের চাষকাজে উৎসাহিত করতে বহুরকম সহযোগিতা ও ঋণদান কর্মসূচি গ্রহণ করেন। মনে রাখা দরকার মিসর আরব বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাদ্য আমদানি করা রাষ্ট্র। ২০০৯ সাল থেকে মিসর শিকাগো থেকে ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম আমদানি করে। খাদ্য আমদানির সাড়ে চুয়াল্লিশ ভাগ আমেরিকা থেকে, ২২ দশমিক ৭ ভাগ অস্ট্রেলিয়া থেকে, ১২ দশমিক সাত ভাগ ইউরোপ থেকে, ৩ দশমিক ৬ ভাগ কানাডা থেকে এসে থাকে। এই দেশগুলো একসাথেই আইএমএফকে মিসরে কোনো ধরনের অর্থ দিতে নিষেধ করে। সব আরব রাষ্ট্রকেও নির্দেশ দেয়া হয় মিসরকে যেন এক পয়সাও ঋণ সাহায্য না দেয়া হয়। মুরসির এতবড় ভুল তারা সহ্য করতে পারেনি।
ছয়. শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাবার জন্য তিনি প্রাথমিক, সেকেন্ডারি এবং হায়ার সেকেন্ডারি লেভেলগুলোতে পুরণো সিলেবাস বাতিল করার পদক্ষেপ নেন। পাশ্চাত্যের মানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার নির্দেশ দেন তিনি। যাতে মিসরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রাধান্য থাকে। এটা বাস্তবায়ন করলে ওখানে নিয়োজিত হাজারো আমেরিকান ও পশ্চিমা শিক্ষক ও উপদেষ্টাদের ছাঁটাই করতে হতো। এরচেয়ে মারাত্মক ভুল আর কী হতে পারে। বাইরের লোকদের কাছে না পড়লে পড়াশোনা হয়?
সাত. সিরিয়ার ব্যাপারে মুরসি করে ফেলেন এক মারাত্মক ভুল। তিনি মিসরে প্রবেশ করতে সিরীয়দের ওপর থেকে ভিসা ফি উঠিয়ে নেন। তিনি ঘোষণা করেন সিরিয়ান ছাত্ররা মিসরীয় ছাত্রদের মতোই সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে। তিনি সিরিয়ার সাথে সব কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে দামেস্ক থেকে মিসরীয় দূতাবাস সরিয়ে নেন। বন্ধ করে দেন কায়রোর সিরিয়ান দূতাবাসের সব কার্যক্রম। আরো মারাত্মক কাজ করেন যে, সিরিয়ার ব্যাপারে আমেরিকার কোনো পরামর্শই তিনি শুনতে চাননি। বরং উলটো ‘মু’তামার আলউম্মাহ আলমিসরিয়্যাহ লিদা’মি আলসাওরাহ আলসুরিয়্যাহ’ নামে সারা বিশ্বের নাম করা ওলামা, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের নিয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এতে এক দিকে যেমন তার মাথা মুসলিম বিশ্বের ওপর উঁচু হয়ে যায়, অপর দিকে সিরিয়ার সমস্যা সমাধানে মুসলিম বিশ্বের হস্তক্ষেপ আসন্ন হয়ে পড়ে। ফলে আমেরিকা ও ইসরাইলের আরেকটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে বসে। যেটা ছিল মুরসির খুব বড় ভুল।
আট. তিনি এরদোগানের সাথে মিলে মুসলিম বিশ্বের ‘জি-এইট’কে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালান। এরই ফলে তুরস্কের সাথে এক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এতে করে মিসরের বাজার তুরস্কের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং তুরস্কের সাথে মালয়েশিয়ার বড় বড় বিনিয়োগের দরজা খুলে যেতে থাকে। মিসরকে উন্নত পর্যায়ে নিতে তার এই পদপেক্ষকে ভুল না বলার অবকাশ আছে?
নয়. তিনি মিসরে বেশ কিছু পরিবর্তন খুব দ্রুততার সাথে করতে চেয়েছিলেন। সেনাবাহিনীতে তিনি ছাঁটাই শুরু করেছিলেন। বিচার বিভাগের প্রতি নজর রেখেছিলেন। পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি তিনি রাতারাতি শেষ করতে উদ্যোগী হয়ে পড়েন। মিডিয়ার প্রতি ছিল তার বিমেষ দৃষ্টি। এসব বিষয়ে তিনি এত সচেষ্ট হন যে, সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ না করলে দেশটি অন্য কিছুতে পরিণত হতে যাচ্ছিল। এই অপরাধ ক্ষমা করার মতো মন কারোই ছিল না।
দশ. মিসরে চলে আসতে ছিল কিবতিদের রাজা ফেরাউনের শাসন। এই শাসন শুরু হয় জামাল নাসের থেকে। ষাট-সত্তর বছরের এই শাসনকে তিনি প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই পরিবর্তন করে নতুন এক সংবিধান প্রণয়ন করেন এবং একে ‘শারইয়্যাহ’ নাম দিয়ে জনগণের ভোটে পাস করিয়ে নেন। সংবিধানটা পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবে তাতে ছিল ‘কুরআন ও সুন্নাহ’-এর সরাসরি প্রতিফলন। সত্যি বলতে কি, এই অপরাধ মিসরের ফেরাউনি শাসক, সেনাবাহিনী, পুলিশ, মিডিয়া বা বিচার বিভাগÑ কেউই মেনে নিতে পারেনি। আরো রূঢ় সত্য হলো, তার এই ভুলগুলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কোনো রাজা-মহারাজা কিংবা বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিহীন মেনে নিতে পারেনি। আর পারেনি বলেই ইখওয়ানকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সরিয়ে দিতে সৌদি ঢেলেছে তেল, দুবাই ঢেলেছে সোনা, আর সারা দুনিয়ার বড় বড় মোড়লেরা ধ্বনি দিয়ে জেনারেল ছি… ছি… কে করেছে নানাবিধ সাহায্য।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button