মোদিবিরোধী জোট ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’র যাত্রা শুরু

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে আজ শনিবার ব্রিগেড ময়দানে ঐতিহাসিক বিজেপি বিরোধী সমাবেশ হয়েছে। এতে সমগ্র ভারতের আঞ্চলিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন, ব্রিগেডের এই মঞ্চ থেকেই যাত্রা শুরু করল নতুন জোট ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া।’

সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘এখানে কোনও রাজনৈতিক পক্ষের রঙ নেই। বাম দক্ষিণে ভাগাভাগি নেই। এই জোটের একটাই মন্ত্র ঐক্যবদ্ধ ভারত।’ মমতার ব্রিগেড সমাবেশ উপলক্ষ্যে এদিন ভোর থেকে কলকাতা হয়ে ওঠে ব্রিগেডমুখী। জনজোয়ারে ভাসতে শুরু করে শহর কলকাতা। লাখে লাখে মানুষ শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে নেমে ব্রিগেডের পথে পায়ে পা মেলান। যে সমাবেশ থেকেই বিজেপির কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেওয়ার ঘোষণা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা বলেন, ‘ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা মোদি সরকারের এক্সপায়ারি ডেট শেষ হয়ে গিয়েছে। সবকিছুর যেমন এক্সপায়ারি ডেট থাকে তেমনি মোদি সরকারেরও এক্সপায়ারি ডেট শেষ। এবার আর ভারতের মানুষ মোদি সরকারকে ক্ষমতায় ফিরতে দেবে না।’

এদিন মোদি বিরোধী জোটের মঞ্চে স্বভাবতই মধ্যমণি হয়ে ছিলেন মমতা। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মোদি বিরোধী আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের পরেই ব্রিগেডের মঞ্চে বক্তব্য দিতে উঠে মমতা বলেন, ‘ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে পথ দেখিয়েছিলো বাংলা। ভারতের যখনই কোনো বিপদ এসেছে, তখনই বাংলা পথ দেখিয়েছে। এবারেও বাংলাই নেতৃত্ব দেবে। বিজেপিকে উৎখাত করতেই হবে।’ মমতা এদিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একটাই স্লোগান হবে, বদলে দাও। কেন্দ্রের মোদি সরকারকে বদলে দাও।’

মমতা বলেন, ‘মোদি অমিত শাহরা এতদিন যাদের ছাড়েননি, আজ কেন তারা মোদিকে ছাড়বেন। সবাই মিলে বদল করতেই হবে। ভারতের মানুষ যদি এরপরেও বিজেপিকে ভোট দেন, তাহলে কারো ব্যাংকে একটি টাকাও থাকবে না। সব টাকা বিজেপি লুট করে নিয়ে যাবে।’ মমতা অভিযোগ করেন, ‘লুটের টাকায় ভোট করছে বিজেপি। একের পর এক সরকারি প্রকল্পের নামে দুর্নীতি চলছে। যে প্রকল্পগুলিতে রাজ্য সরকার টাকা দিচ্ছে, সেগুলি নিজেদের ছবি দিয়ে প্রচার করছে কেন্দ্রীয় সরকার।’

মমতা বলেন, ‘মোদির বিরুদ্ধে যে কথা বলছে তাকেই চোর বলা হচ্ছে। নাগরিকপঞ্জি নিয়ে অসম রাজ্যের উত্তর পূর্বে মানুষ নিধন চলছে।’ এরকম রাজনীতি ভারতের মাটিতে এর আগে কখনও হয়নি বলেও দাবি করেন মমতা।

মমতার ডাকে মঞ্চে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জনতা দলের সভাপতি দেব গৌড়া বলেন, ‘ভারতের সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জোট বাঁধতে চাইছেন তা প্রশংসার দাবি রাখে। মমতার সঙ্গে আমরা আছি। আগামী দিনে ভারতে স্থায়ী সরকার তৈরি হবে। তবে ফেডারেল ফ্রন্টের তরফে আগামী দিনে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তাঁর উত্তরে দেবগৌড়া বলেন, আগে বিজেপিকে পরাজিত করতে হবে। তারপর ভাবা যাবে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন।’

ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির সভাপতি শারদ পাওয়ার বলেন, ‘বিজেপি জনবিরোধী। তাই জোট বেঁধে বিজেপির বিরুদ্ধে নামতে হবে।’

ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী গেগং আপাং বিজেপি থেকে ইস্তাফা দিয়ে সামিল হয়েছেন মমতার এই ব্রিগেডে। তিনি বলেন, ‘আলাদা দল করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিজেপিকে হঠানোর লড়াইয়ে নামব।’

তেলেগু দেশম পার্টির সভাপতি (টিডিপি) ও অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু বলেন, ‘আজকের দিনটা ভারতীয় রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিজেপি দেশের বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির অপব্যাবহার করেছে। সেই কারণে সমস্ত বিরোধী দলগুলি দেশের স্বার্থে এক হয়েছে।’

ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা ফারুক আবদুল্লাহ বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিরোধীরা একজোট হয়েছেন। ভারতকে মজবুত করার বার্তা দেওয়া হচ্ছে আজকের ব্রিগেড মঞ্চ থেকে। বিজেপি ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করার যে চেষ্টা চালাচ্ছে তার বিরোধিতা করতে হবে। আমরা ভারতের সংবিধানকে রক্ষা করতে চাই। সারা ভারতে আগুন লেগে গেছে। সেই আগুনকে নেভানোর জন্য এমন কাউকে চাই, যে বিরোধীদের একজোট করতে পারে। এজন্য বিরোধীরা সবাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একজোট হয়েছে।’

দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগম (ডিএমকে) সভাপতি এম কে স্টালিন বলেন, ‘আগামী মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম হতে চলেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিষ ছড়িয়ে বিজেপি সরকার যে বিভাজনের রাজনীতি তৈরি করেছে তা আমরা রুখবই।’

কংগ্রেসের মুখপাত্র ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত রাজ্যসভার সদস্য ড. অভিষেক মনু সিংভি বলেন, ‘রংধনুর সাত রঙের মতোই আজ সব রঙ একসঙ্গে। রামধনুর মতোই সবার এক জোট। আর নয় মোদি সরকার। এই সরকারের মধ্যে প্রবল প্রতিশোধস্পৃহা। ভোট ভাগাভাগি বন্ধ করলেই বিজেপির পরাজয়।’

ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা বলেন, ‘আমরা সকলে একত্রিত হয়েছি একজনকে সরানোর জন্য। গত ৫৬ মাসে ভারতের গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের আর্থিক অবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত।’

বিজেপির এই সাবেক জ্যেষ্ঠ নেতা আরো বলেন, ‘এই সরকারকে দেশকে বিভক্ত করতে চায়। তাই এই সরকারের পতন দরকার।’

ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার সভাপতি ও ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন বলেন, ‘এক সময় একতার প্রতীক ছিল ভারত। আজ তা ধাক্কা খাচ্ছে। বিজেপি যেভাবে দেশ চালাতে চাইছে তা আমার মনে হয় ক্ষতিকর। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিচ্ছে। একমঞ্চে জোট বেঁধেই এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার।’

গুজরাটের বাদগাম থেকে নির্বাচিত বিধানসভা সদস্য তরুণ রাজনীতিবিদ জিগনেশ মেবানি বলেন, ‘আমাদের সংবিধান ও গণনতন্ত্রের উপর হামলা হচ্ছে। এই সরকারকে অবিলম্বে সরানো দরকার।’

সর্বভারতীয় বহুজন সমাজ পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও উত্তর প্রদেশের রাজ্যসভা সদস্য সতীশ মিশ্র বলেন, ‘কেন্দ্রে অসফল মোদি সরকার। এই সরকারকে উপড়ে ফেলাই ভালো।’

সমাবেশে দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেন, ‘মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোদি ভোটে জিতেছেন। ভারতের সর্বনাশ করছেন মোদি। গণতন্ত্রের উপর বারবার হামলা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে। সংবিধানকে খর্ব করার চেষ্টা চলছে। এই গুন্ডাদের দেশ থেকে ভাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি আসলে হিটলারের মতো। হিটলার জার্মানিতে যা করেছিলেন, মোদি এবং অমিত শাহের জুটি ভারতে সেটাই করার চেষ্টা করছে।’

উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ যাদব বলেন, ‘বাংলা থেকে যা শুরু হয়েছে তা গোটা ভারত দেখবে। দেশবাসী মোদিকে হঠাতে তৈরি। ভারতে নতুন প্রধানমন্ত্রী আসবেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী ঠিক করবেন মানুষ।’

অখিলেশ যাদব আরো বলেন, ‘মমতা দিদির ডাকে সাড়া না দিয়ে পারলাম না। সমস্ত আঞ্চলিক দলের নেতারা ব্রিগেডে আসছেন। আগামী দিনে বিজেপির বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ লড়াই হবে।’

কর্নাটক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমার স্বামী বলেন, ‘মমতা দেশের রোল মডেল। বিরোধীদের মিলিয়েছেন মমতাদি। অসাংবিধানিক সরকার চলছে ভারতে। দেশে অগণতন্ত্রের সরকার চলছে। এই সরকারকে দেশবাসী আর চায় না।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button