জীবনের প্রতিচ্ছবি ‘এই ঘর এই মন’
১.তুমি কিতা ঘুমাই গেছনি?
-না
-ওহ।
-শাহানা তোমার লগে আমার কিছু মাত আছে।
-কিছু কেনে, বেশি করি মাতো…
-বিয়ার বাদে মেয়েরার স্বামীর সংসারের কিছু দায়দায়িত্ব নেওয়া লাগে। আমরার সংসারে বড় ভাবিয়ে সবতা চালাইয়া যাইরা, মেজো ভাবিয়েও কররা… তুমিও সংসারের বায়দি একজরা মনোযোগ দেও, সংসারের কাজে সাদ দেও। শাহানা শাহেদের কথা মন দিয়ে শুনে…।
বইটি যখন পড়ছিলাম হঠাৎ এসে থমকে যাই লাইনগুলো পড়ে। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা বইটি পড়তে ব্যতিক্রম লাগছিলো।
২.শাহানা ভীষণ খুশি। চোখে মুখে আনন্দের ছাপ। শাহেদ কথা না বাড়িয়ে কার চালিয়ে বেরিয়ে যায়। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে মেজোবউ শাহানা শাহেদের চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখেন। হিংসায় মুখ রং পাল্টে যায় মেজো বউ মিনুর।
৩.মনে ভেতরে লুকিয়ে থাকা কোন কষ্টকে কেউ যখন মনে করিয়ে দেয়। তখন শুধু হৃদয়ে বৃষ্টি ঝড়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না। সেই বেদনা অনুভব করার মত হৃদয় থাকতে হয়। একমাত্র মেয়ে সুমি জন্মের পর থেকে বাবাকে কখনো দেখেনি। বিদেশ থেকে বাবা কল করলেই আদরমাখা কন্ঠে বলে- আব্বু তুমি আওনা কেনে। কোনদিন আইবা। স্কুলে আমার সব ফেন্ডরা আব্বুরা যাইন। আমার কিছু লাগত না। তুমি আইও।
৪.জীবনের প্রয়োজনে, প্রিয়জনদের একটু সুখের জন্য প্রবাসে থাকতে হচ্ছে সুমির বাবাকে। অবুঝ মনে সুমি তার বাবাকে দেশে আসার আকুতি জানায়। গ্রিনকার্ড হাতে এলেই সুমিকে নিয়ে বড় বউ প্রবাসে পারি দেবেন প্রিয় মানুষটির কাছে। আমেরিকা যাওয়ার সেই অপেক্ষা প্রহরগুলো যেন কাটতেই চায় না। দিন শেষে রাত আর মাস বছর যেন বড্ড বেদনাদায়ক। তবুও আশা বুক বেধে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে স্বামী সংসারে শক্ত হাতে হাল ধরে রাখে বড় বউ রুবিনা। শাশুড়িও বড় বউ উপরে পূর্ণ আস্থা আর ভরসা করে নিশিন্তে থাকেন সংসার নিয়ে। তবে ভরসা আর নিশ্চিতে থাকা মধ্যে একদিন রাশেদা বেগমের সাজানো গুছানো সংসারে কালবৈশাখী ঝড় ওঠে।
৫.সুমির স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বড় বউ। হঠাৎ মধ্যবয়সী স্যুট-টাই পরা এক ব্যক্তি গাড়ি থেকে নামতেই বড়বউ হাসি দিয়ে কথা বলেন লোকটির সাথে। একটি কাগজে ঠিকানা লিখে দেয় বড় বউ লোকটিকে। এদিক দিয়েই রিকশা নিয়ে যাচ্ছে মেজো বউ। অপরিচিত লোকটির সাথে বড় বউকে কথা বলতে দেখে রিকশা থামিয়ে তাদের দুজনকে সন্দেহ চোখে ভালো করে দেখে নেয় মেজো বউ আর বলতে থাকে-অতদিন বাদে কেইস ধরছি, অউ বুধপাইলাম, রাইত বারোটার সময় তাইন কার লগে মাতইন। আম্মারে বিষয়টা জানাইতে অইব, নিমরা বিলাই হর খাইবার যম। ইবার খেলা জমবো…।
তারপর থেকে সন্দেহ আর ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে উপন্যাসটি চলতে থাকে।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে কোন কিছু যাছাই বাছাই না করে ভুল বুঝা। যে ভুলের কারনে শুধু মাত্র একটি সংসার নয়, পুরো একটি জীবন ধ্বংশ হয়ে যায়। বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় যদি বিনা অপরাধে কেউ ভুল বুঝে। একমাত্র তারাই বুঝতে পারেন যাদের জীবনে এরকম ঘটেছে। মনে হয় পৃথিবীতে এর চেয়ে কঠিন কষ্ট আর কিছুই নেই। যেমনটি ঘটেছিলো ‘এই ঘর এই মন’ গ্রন্থের বড় বউ রুবিনার জীবনে।
৬.রাশেদা বেগম চৌধুরী খুব মনোযোগ দিয়ে টিভিতে ইসলামি অনুষ্ঠান দেখছেন। মেজো বউ দুই বার ড্রইং রুমে এসে শাশুড়িকে টিভির সামনে দেখে ফিরে গেছেন। তখন ভারতীয় ধারাবাহিক নাটক স্টার জলসায় চলছে। মেজো বউ ভীষণ বিরক্ত। শাশুড়িকে কিছু বলতে পারছে না আবার সইতেও পারছে না। নাটকের আকর্ষনীয় পর্বটা চলে যাচ্ছে।
উপন্যাস পড়া মুহুর্তেই চোখে সামনে ভেসে ওঠবে সিরিয়েল নাটক দেখার দৃশ্য। এখন অনেক পরিবারেই দেখা যায় সিরিয়েল নাটক, খবর দেখা আর কার্টুন দেখা নিয়ে ছোট খাটো একটা ঝগড়া লেগেই থাকে। এই বাস্তবচিত্রকে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক মুহিত চৌধুরী।
৭. যৌথ পরিবারের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দাদা দাদী, বাবা মা, চাচা-চাচী, চাচাতো ভাইবোন আর চিৎকার-চেচামেচি, হই-উল্লর। সারাক্ষণ যেনো একটি উৎসব উৎসব ভাব লেখেই থাকা। যেখানে সবাই মিলে এক সাথে দীর্ঘসময় পার করতে হয়। যৌথ পরিবারে সেই মধুর মুহুর্ত গুলো আর চোখে পড়ে না। একটা সময় ছিলো পরিবারে এক পাতিলে রান্না করা, এক টেবিলে খাওয়াই ছিলো পরিবারের একটি আনন্দের বিষয়। জীবনের তাগিদেই যেনো আজ তা হারাতে চলেছে। উপন্যাসে অনেক কথা এসেছে। যে কথা কম সময়ে বলতে পারলে পাঠকের মনে দাগ কাটতো বলে আমার মনে হয়।
৮. সুন্দর ও পরিপাটি ভাবে যৌথ পরিবারকে কেন্দ্র করে আমাদের বাঙালি জীবনের সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রবাসে বহমান কবিতার প্রতিচ্ছবি মালেক ইমতিয়াজকে। বই ‘এই ঘর এই মন’ লেখক মুহিত চৌধুরী। প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ঘাস প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন মুমিনুল মুহিব। ৬৪টি পৃষ্টার বইটির মূল্য-২০০ টাকা। -তাসলিমা খানম বীথি