বছর ঘুরে আবার এলো ভাষা আন্দোলনের মাস
বাংলাসহ বিশ্বভাষার মিশ্র গতিপ্রকৃতির মধ্যেই বছর ঘুরে আবার এলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এ মাস ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ১৯৫২ সালে এ ভূখন্ডের মানুষ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) তাদের মুখের ভাষা, মাতৃভাষা বাংলাকে আপন করে পাওয়ার জন্য যে আন্দোলন করেছে, রক্ত দিয়েছে দুনিয়াজোড়া তার জুড়ি মেলা ভার। একুশ শতকের বৈশ্বিক-গ্রামে তাই ভাষা আন্দোলন তথা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মর্যাদা। জাতিসংঘসহ দেশে দেশে দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে।
ভাষাপ্রেমের দারুণ এক ঊষ্ণতা ছড়িয়েই দুয়ারে হাজির হয়েছে ফেব্রুয়ারি। আজ শুক্রবার পহেলা ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্মৃতিবাহী মাস এটি। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গভীরে আত্ম-অনুসন্ধানের মাসও বটে। ফেব্রুয়ারির প্রতিটি সূর্যোদয় নবোদ্দীপক, দ্যোতনাময় ও নবজাগরণের হাতছানি দেয়। ১৯৫২ সাল থেকে ২০১৭ ঈসায়ী সাল। ১৩৫৮ থেকে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। সভ্যতার অনেক উত্থান-পতনের এই সময়ে পদ্মা- মেঘনার পানি অনেক গড়িয়েছে। তবুও জনজীবনে সালাম-রফিকদের রক্তস্নাত মাসটির প্রভাব, আবেগ ও কৌতূহলে ভাটা পড়েনি। এতটুকু মলিন হয়নি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’।
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। জাতীয়তাবাদের এক প্রতিবাদী চেতনায় স্ফূরণ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির সত্তাকে যেমন শাণিত করেছে তেমনি রুখে দাঁড়াবার শক্তি দিয়েছে সকল অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনা, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশীদের সমগ্র সত্তাকে ছুঁয়ে, আবেগ-অনুভূতিকে স্পর্শ করে এক প্রবল চেতনাদীপ্ত অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগেই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত। এর ব্যাপ্তিকাল ছিলো ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত।
অনেক গবেষক বলে থাকেন, পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার বিভিন্নমুখী অর্থনৈতিক খাতগুলোতে উপর্যুপরি বৈষম্যমূলক বরাদ্দ, উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার আওতা থেকে পূর্ব বাংলাকে বাদ দেয়া, পূর্ব বাংলার সম্পদ ও সঞ্চয়ে পশ্চিম অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করা, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সম্পদ পাচার, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার বেদনা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশাভুক্ত জনসাধারণের মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বৃটিশ শাসনামলের পুঞ্জীভূত শোষণ-বঞ্চনা এ ক্ষোভের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রবল প্রবণতা পূর্ব বাংলার জনসাধারণের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের পূর্বে অবিভক্ত ভারতের বাংলা ভাষার পক্ষে সাহিত্য সম্মেলন, পত্র-পত্রিকা থেকে মতামত গঠন পরবর্তীতে পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে আরো জোরদার করে। এ দাবির প্রতি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর দম্ভোক্তি ও বিরোধিতার পাল্টা জবাব হিসেবে গড়ে ওঠে ‘তমদ্দুন মজলিস’, ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’, সর্বদলীয় কর্মপরিষদ’-এর মতো সংগঠন-প্রতিষ্ঠান। এ সকল প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ লালন করে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলা ভাষাবিরোধী পাক-শাসকগোষ্ঠীকে সমুচিত জবাব দেয়। ছাত্র, পেশাজীবী বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রমিক, সাংবাদিকসহ সাধারণ জনতাই এসব সংগঠনের মূল নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উজ্জীবিত পূর্ব বাংলার জনগণ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রুখে দাঁড়ায় পাক-শাসকগোষ্ঠীর মুখোমুখি। শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর গুলীতে ঝরে পড়ে অজস্র তরুণ প্রাণ। এই অগণিত মৃত্যুই অর্থনৈতিক মুক্তির সন্ধানের প্রথম সোপান ‘বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
উইকিপিডিয়ায় বর্ণিত বাংলা ভাষা আন্দোলনের কালপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তমদ্দুন মজলিস “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? বাংলা নাকি উর্দু?” নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যেখানে সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবি করা হয়। সেই সময়ে সরকারি কাজকর্ম ছাড়াও সকল ডাকটিকিট, পোস্টকার্ড, ট্রেন টিকিটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজিতে লেখা থাকতো। তমদ্দুন মজলিসের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন অধ্যাপক (পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল) আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত সে ব্যাপারে একটি সভা আহবান করেন। সেই সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই বছরের নবেম্বরে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত ‘পাকিস্তান এডুকেশনাল কনফারেন্সে’ পূর্ব-পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবি জানান।
১৯৪৭ সালের ৭ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয় এবং ১৭ নবেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণা দেয়ার জন্য শত শত নাগরিকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বাঙালি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পার্লামেন্টে প্রথমবারের মত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য একটি বিল আনেন। মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ বাঙালি পার্লামেন্ট সদস্যদের একাংশ এর পক্ষে সমর্থন দিলেও মুসলিম লীগ সমর্থিত এমপিরা এর বিপক্ষে অবস্থান নেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন এই বিরোধিতার শীর্ষে এবং তার সক্রিয় সমর্থনে এই বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটি বাতিল করা হয়। ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে অবশেষে কিভাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হলো তা বিশ্বের অন্যতম বিরল ঘটনা।