জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মাওলানা আব্দুল হাই খান

মুহাম্মদ রহিম: ক্যামোথেরাপি দিতে দিতে দু‘চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। মাসদিন থেকে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পাননা। দেখতে পাননা আদরের কন্যা আফিফাকে। ঘরে ঢুকে সালাম দিতেই কন্ঠ শুনে চিনে ফেললেন। হাত বাড়ালেন আমার দিকে। হাতে ধরেই বললেন- আমি চলে যাবো ভাই, আমার জন্যে দোয়া করো। জানতে চাইলাম, আপনি কেমন আছেন, বললেন, আল-হামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। আমার দুচোখই একেবারে চলে গেছে। আমি পৃথিবীর আলো আর দেখতে পাইনা। আমি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করেছে। আমাকে আর ক্যামথেরাপি দিতে পারবে না। ব্রেইন ক্যান্সারের জন্যে আমার মাথায় প্রচন্ড ধরনের বেদনা অনুভব করি। বেদনার সর্বোচ্চ ওষুধ ‘মফিন‘ খেয়ে খেয়ে কোনো মতে বেঁচে আছি। আমি আল্লাহর এ সিদ্ধান্তে খুশি। আল্লাহ যেন আমার গোনাহ মাফ করে একজন বেহেশতি বান্দা হিসেবে মৃত্যু দান করেন।
মাওলানা আব্দুল হাই ভাইয়ের কথাগুলো শুনে, উনার কষ্ট দেখে নিজে কষ্ট অনুভব করলাম। আমার দুচোখে জল চলে এলো। গত সোমবার তাঁর স্ত্রী‘র সাথে ফোনে কথা বলে মঙ্গলবার তাঁকে দেখতে যাই। তিনি বললেন, গত ২২ জানুয়ারি মঙ্গলবার হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে কেয়ারহোম ‘হসপিসে‘ দিতে চেয়েছিল। তিনি কেয়ারহোমে না দিয়ে নিজ বাসায় নিয়ে এসেছেন। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তাঁকে ক্যামোথেরাপি বা অন্যকোনোও রকম চিকিৎসা দেয়া আর সম্ভব হবে না। তিনি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। বেদনা নিবারনের জন্যে শুধু মফিনই সেবন করতে হবে। তিনি সারাদিনই বিছানায় পড়ে থাকেন। কিছু খেতে চান না, জোর করে খাইয়ে দিতে হয়।
তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক আব্দুল হাই ভাই। বড় মেয়ের বয়স চৌদ্দ। ২০ পারা পর্যন্ত কুরআন হিফজ্ করেছে। দ্বিতীয় মেয়ের বয়স ১২, মাদ্রাসায় পড়ছে। ছেলের বয়স ৯ বছর, স্কুলে পড়ছে। আর ছোট্ট মেয়ের বয়স তিন বছর যে বাবার বিছানার পাশে বসে পুতুল নিয়ে খেলা করে আর বাবাকে সব সময় মাতিয়ে রাখে।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চোঁখের জল সামলাতে পারিনি। আমার মেয়ের বয়সী ছোট্ট যে নিষ্পাপ মেয়েটি বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বায়না ধরবে, সে মেয়ে আজ বাবার অন্তিম শয্যায় বসে আছে। তাঁকে দেখে আসার পর রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি । তাঁর ছোট্ট মেয়েটির কোমল হাসি আমার চোঁখের সামনে ভেসে উঠে। মনে হয়েছে যেনো এক জান্নাতী হোর আব্দুল হাই ভাইয়ের পাশে বসে আছে। মেয়েটির কথা যতই ভেবেছি ততই চোঁখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়েছে। কেমন জানি আমার ছোট্ট মেয়ের সাথে ওর একটা মিল আছে।
যাহোক, আব্দুল হাই ভাইয়ের সাথে আমাদের চ্যারেটি অরগানাইজেশন শাহবাজপুর ওয়েলফেয়ার এসোশিয়েশনের জন্যে একসাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল অনেকদিন। একজন জ্ঞানী, সজ্জন সর্বোপরি ভালো মানুষ হিসেবেই কমিউনিটিতে তাঁর পরিচয়। তিনি আমাদরে শাহবাজপুররে কৃতী সন্তান,বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, শাহবাজপুর ওয়লেফয়োর এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান পেট্রন । এছাড়াও বৃটেনের সর্বদলীয় উলামা সংগঠন- বাংলাদেশী মুসলমিস ইউকে’র সাধারণ সম্পাদক ও কুরতুবা ইন্সটিটিউটের পরিচালক, ইকরা বাংলা টিভি’র প্রেজেন্টার ও সেইভ রোহিঙ্গা ইউকে’র সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আঠারো বছর আগে ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে ভারতে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কয়েক মাস আগে মরণব্যাধি ক্যান্সার আবার ফিরে বসে ব্রেনে বাসা বাঁধে। তাঁর মনোবল এতোই শক্ত যে এ কঠিন পরস্থিতির মধ্যেও তাঁর বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছে বলে মনে হলোনা। ফিরে আসার সময় বললনে, আমার জন্যে সবাই দোয়া করবনে। আমি কোনো ভালো কাজ করতে পারনি। আল্লাহ যেন আমার আখেরাতকে সহজ করে দেন।
প্রতিটি মানুষের জীবনে কঠিন সময় আসে। তবে আব্দুল হাই ভাই কঠিন থেকে কঠিন সময়ে উপনীত হয়েছেন । তিনি এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এরকম কঠিন সময় আমার-আপনার যে কারো আসতে পারে। আমরা সবাই দোয়া করি মাওলানা আব্দুল হাই ভাইকে আল্লাহ মাফ করে তাঁর দুনিয়া ও আখেরাতকে সহজ করে দিন। আর আমাদেরকেও যেনো সুস্থ্য রাখেন। আয়ু শেষ হয়ে গেলে যেনো তাঁর প্রতি ঈমানের সাথেই আমাদের মৃত্যু হয়। আমিন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button