আফ্রিকা: স্নায়ুযুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র
আহমেদ বায়েজীদ: আফ্রিকা; আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ। তবে অর্থনৈতিক দিক থেকে অঞ্চলটি বিশ্বে সবার চেয়ে পিছিয়ে। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হওয়ার পরও মহাদেশটির জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দরিদ্র। রাজনৈতিক অস্থিরতাই মূলত দারিদ্র্যতার প্রধান কারণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- উভয় কারণেই এ মহাদেশটিতে ক্রমেই প্রভাব বাড়ছে পরাশক্তিগুলোর। এশিয়া, ইউরোপ কিংবা আমেরিকার দেশগুলো আফ্রিকায় নিজ নিজ প্রভাব জোরদার করতে নানাবিধ চেষ্টা চালাচ্ছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনসহ অনেক দেশের মধ্যে চলছে নীরব প্রতিযোগিতা। আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বিস্তারের এ প্রতিযোগিতাই বলে দিচ্ছে- মহাদেশটিই হয়ে উঠতে যাচ্ছে বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র।
আরো অনেক অঞ্চলের মতোই আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্য অবস্থান করছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। গত বছরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রায় সাড়ে সাত হাজার মার্কিন সৈন্য বর্তমানে অবস্থান করছে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে। যাদের মধ্যে আবার হাজারখানেক সামরিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভাড়াটে সৈন্য। ৫৪টি দেশ রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে- যার মধ্যে ৫৩টি দেশেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি। আলজেরিয়া, বুরুন্ডি, শাদ, কঙ্গো, জিবুতি, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, দক্ষিণ সুদান, তিউনিসিয়া, উগান্ডায় সরাসরি মোতায়েন রয়েছে মার্কিন সেনা।
আফ্রিকম নামের মার্কিন সামরিক কমান্ডের অধীনে নেভি সিল, গ্রিন বেরেটস ও আরো কয়েকটি বিশেষ বাহিনীর সৈন্য মোতায়েন রয়েছে আফ্রিকায়- যারা আফ্রিকার ২০টি দেশে প্রায় এক শ’টি মিশন পরিচালনা করছে। এই বাহিনীগুলো এমনভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে যাতে স্বল্প সময়ের নোটিশে তারা যেকোনো দেশে ছোট পরিসরে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। সামরিক ম্যাগাজিন ভাইস জানিয়েছে, আফ্রিকায় প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার মহড়া কিংবা অন্যান্য সামরিক তৎপরতা চালায় মার্কিন সেনারা। মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক নিক টার্সের মতে, ছোট বড় মিলিয়ে আফ্রিকা মহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি প্রায় ৫০টি।
এসব ঘাঁটি থেকে ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি, এক দেশ থেকে অন্যদেশে ছোটখাটো অভিযান ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজ করা হয়। এত গেল সরাসরি সামরিক উপস্থিতির কথা। এর বাইরে বিভিন্ন দাতা ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রচুর মিশনারি তৎপরতা চলে আফ্রিকাজুড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত বিশাল সামরিক উপস্থিতি নেই; কিন্তু আরেক পরাশক্তি চীন আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে অর্থনীতিকে। দারিদ্র্যপীড়িত মহাদেশটিতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে চীন, যার ফলে অঞ্চলটির অনেক দেশ ক্রমশ ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠছে বেইজিংয়ের। সরাসরি অর্থ সাহায্য ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারিপর্যায়ে প্রচুর বিনিয়োগ করছে আফ্রিকার দেশগুলোতে। চীন তার হাজার কোটি ডলারের ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ প্রকল্পেও যুক্ত করতে চাইছে আফ্রিকাকে। মোট কথা, আফ্রিকা অঞ্চলে চীনের একক অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এখনই। চীনের এই কার্যক্রম কতটা জোরালো তা প্রমাণ হয় এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের উদ্বেগ দেখে। বোল্টন আফ্রিকায় চীনের কার্যক্রমের সমালোচনা করে বলেছেন, আফ্রিকার দেশগুলো চীনের নতুন ঔপনিবেশিকতার শিকার হয়ে পড়ছে। চীনারা ঘুষ, বৈআইনি চুক্তি ও প্রচুর ঋণ দিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোকে বেইজিংয়ের ইচ্ছেমতো পরিচালিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
শুধু যে বেসামরিক পন্থায় চীন অগ্রসর হচ্ছে তাই নয়। গত বছর দেশের বাইরে চীন তার প্রথম সামরিক ঘাঁটি চালু করেছে পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে। জিবুতিতে ঘাঁটি গড়ার ফলে এডেন উপসাগর ও আরব সাগরে চীনা সামরিক উপস্থিতি স্পষ্টতই বাড়বে। এ ছাড়া, আফ্রিকার আরো অনেক দেশের সাথে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে চীন। গত বছরই দেশটি এই ঘোষণা দিয়েছে।
লিবিয়ায় ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সের গোপন উপস্থিতির কথা অনেক আগেই ফাঁস হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। আর গাদ্দাফি সরকারের বিরুদ্ধে লিবিয়ায় সামরিক অভিযানে ফ্রান্সের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই যে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ছিল সে কথাও সবার জানা। তাই ব্রিটেন-ফ্রান্সসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের সামরিক ও বেসামরিক তৎপরতা রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে সেটি আর গোপন কিছু নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে তুরস্ক। আর সবার মতো তুর্কিরাও আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তুরস্কের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে গত কয়েক বছরে। তুরস্কের কার্যক্রম চলছে তিনটি সেক্টরে- শিক্ষা ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতে সহযোগিতা, এনজিওর মাধ্যমে দাতব্য কার্যক্রম এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ। গত বছর জুলাইয়ে ব্রিকস সম্মেলনের সময় দক্ষিণ আফ্রিকা ও জাম্বিয়া সফর করেছেন প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। দক্ষিণ আফ্রিকায় বৈঠক করেছেন টেগো ও অ্যাঙ্গোলার রাষ্ট্রনেতাদের সাথে। এসবের প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি আর বাণিজ্য সম্প্রসারণসংক্রান্ত।
জিবুতিতে তুর্কি অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পূর্ব আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মসজিদ। বন্যা থেকে সুরক্ষায় লোহিত সাগর উপকূলে নির্মিত হচ্ছে বিশাল বাঁধ। এজন্য দুই কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছে তুরস্ক। সুদানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে তুর্কি অর্থায়নে। দেশটির কৃষি খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করছে তুর্কি কৃষি দফতর। লোহিত সাগরে সুদানের একটি দ্বীপ লিজ নিয়েছে তুরস্ক। এসব উদাহরণ মাত্র। আফ্রিকার ২০টিরও বেশি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করছে তুর্কি সরকার কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
পিছিয়ে নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও। কিছু দিন ধরেই সৌদি আরব চেষ্টা করছে লোহিত সাগর ও পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদারের। নতুন বছরের শুরুতে লোহিত সাগরে সোমালিয়া, মিসর, সুদান, জিবুতি ও ইয়েমেনকে নিয়ে একটি সামরিক মহড়া করেছে সৌদি আরব। কম যাচ্ছে না সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানও। হাউছিদের মাধ্যমে ইয়েমেনে কর্তৃত্ব বৃদ্ধি করছে ইরান। এ ছাড়া আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সামাজিক কর্মকাণ্ড ও অর্থ সহায়তার মাধ্যমে প্রভাব বৃদ্ধি করছে তেহরান। আল আরাবিয়ার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আফ্রিকার অন্তত ১২টি দেশে চিকিৎসাকার্যক্রম চলছে ইরানি অর্থায়নে।
এই যে বিশাল কর্মতৎপরতার কথা উল্লেখ করা হলো, এসবের নেপথ্যে রয়েছে একটি উদ্দেশ্যে- সেটি হলো আফ্রিকা মহাদেশে প্রভাব বৃদ্ধি করা। প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ মহাদেশটি ভৌগলিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। তা ছাড়া বিশাল এই মহাদেশটিতে নেই কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্র। যে কারণে বাইরের শক্তিগুলো উঠেপড়ে লেগেছে আফ্রিকাকে নিজেদের অধীনে নিতে। এই প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে- তাই সেটি রূপ নিতে পারে আরেক স্নায়ুযুদ্ধে। তেমনটি হলে বিশ্ব শক্তিগুলোর এই প্রতিযোগিতা আফ্রিকা মহাদেশকে করে তুলতে পারে আরো অশান্ত ও অস্থিতিশীল।