বন্দী শিবিরে মোবাইলে লেখা বই
হোসেন মাহমুদ: কলমে নয়, মোবাইলে বই লেখা। আর মোবাইলে জীবনস্মৃতি মূলক বই লিখে অস্ট্রেলিয়ার সেরা সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার এক বন্দী শিবিরে পাঁচ বছর ধরে আটক থাকা এক ইরানী লেখক বেহরুজ বুচানি। নতুন বছরের শুরুর মাসটির শেষ রাত। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নগরীর কুইন ভিক্টোরিয়া গার্ডেনস-এর এমপি প্যাভিলিয়ন। আয়োজন করা হয়েছে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের। ঘোষণা করা হবে ২০১৯-এর অস্ট্রেলিয়া ও বিশে^র অন্যতম মর্যাদাজনক ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ার’স লিটারারি অ্যাওয়ার্ড। এটি অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান। তারপর ঘোষিত হল বিজয়ীর নাম। ‘নো ফ্রেন্ড বাট দি মাউন্টেন্স’ নামক নন-ফিকশন বইয়ের জন্য পুরস্কার পেলেন বন্দী শিবিরে আটক ইরানী উদ্বাস্তু লেখক-সাংবাদিক বেহরুজ বুশানি। সাথে সাথে বিস্ময়ের সুনামিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে অস্ট্রেলিয়াসহ সারা বিশে^। তার রেশ চলছে এখনো। যে মানুষটিকে দেশে ঢুকতেই দেয়নি অস্ট্রেলিয়া, ‘আটক’ করে রেখেছে দূরবর্তী দ্বীপের বন্দীশালায়, সেই দেশই তাকে দিল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের পুরস্কার! পুরস্কার পেল সেই সাহিত্য যার জন্ম ওই বন্দী শিবিরেই।
বেহরুজ বুশানি এক কুর্দি-ইরানী। ১৯৮৩ সালে পশ্চিম ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। ঐ সময় ইরান-ইরাক রক্তক্ষয়ী লড়াই চলছিল। নিজেকে তাই ‘যুদ্ধকালীন শিশু’ বলে পরিচয় দেন তিনি। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনৈতিক ভূগোল ও ভূরাজনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। তিনি একজন লেখক, সাংবাদিক ও ছবি নির্মাতা। তিনি কুর্দি ভাষার সাময়িকী ‘উয়েরিয়া’র নিয়মিত লেখক ছিলেন। বুশানি পিইএন ইন্টারন্যাশনাল-এর অবৈতনিক সদস্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়া ২০১৭ অ্যাওয়ার্ড, ডায়াসপোরা সিম্পোজিয়াম সোশ্যাল জাস্টিস অ্যাওয়ার্ড, দি লিবার্টি ভিক্টোরিয়া ২০১৮ এম্পটি চেয়ার অ্যাওয়ার্ড এবং দি আন্না পলিটকোভস্কায়া অ্যওয়ার্ড ফর জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এবং সিডনি বিশ^বিদ্যালয়ের সিডনি এশিয়া প্যাসিফিক মাইগ্রেশন সেন্টার-এর ভিজিটিং স্কলার। বন্দী শিবিেির থেকেই তিনি মোবাইলে বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। তিনি গার্ডিয়ান-এ নিয়মিত লেখেন। স্যাটারডে পেপার, হাফিংটন পোস্ট, নিউ ম্যাটিল্ডা, দি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায়ও তার লেখা প্রকাশিত হয়ে থাকে।
৩১ জানুয়ারি রাতে ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ার’স লিটারারি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে বেহরুজ বুচানি দুটি পুরস্কারে ভূষিত হন। একটি হচ্ছে ভিক্টোরিয়ান প্রিমিয়ার’স লিটারারি প্রাইজ ফর নন ফিকশন, এটির অর্থ পুরস্কারের পরিমাণ ২৫ হাজার অস্ট্রেলীয় ডলার। অন্যটি হচ্ছে সার্বিক ভিক্টোরিয়ান প্রাইজ ফর লিটারেচার। এর অর্থ পুরস্কারের পরিমাণ ১ লাখ অস্ট্রেলীয় ডলার (৭২ হাজার ৩শ’ মার্কিন ডলার)। এটি অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ অর্থমূল্যের সাহিত্য পুরস্কার।
বুচানি গত পাঁচ বছর ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র পাপুয়া নিউগিনির মানুস নামের এক এক প্রত্যন্ত দ্বীপের উদ্বাস্তু শিবিরে বন্দী রয়েছেন। এটা নামেই শিবির, আসলে তা অস্ট্রেলিয়া সরকারের পরিচালিত জেল। বুচানি সেই জেলে বসেই বই লিখেছেন। তবে কলম দিয়ে নয়, এ বই লেখা হয়েছে মোবাইলে। পুরো বইটি ফারসি ভাষায় লেখা। যে অস্ট্রেলীয় অনুবাদক ফারসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তার বইটি তিনি ওমিড টফিগিয়ান। বেহরুজ এক একটা অধ্যায় লিখে হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দিতেন তার কাছে। সেগুলো জোড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে এ বই।
পুরস্কার নিতে বুচানি উপস্থিত হতে পারেননি। কারণ, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার অনুমতি নেই তার মত বন্দীদের। তাই ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কার গ্রহণ করতে মেলবোর্নে যাওয়ার সুযোগ পাননি বুচানি। তার পক্ষে পুরস্কার গ্রহণ করেন ওমিড টফিগিয়ান। পাঁচ বছর ধরে বেহরুজের জন্য কাজ করছেন তিনি।
বেহরুজ বুচানি সাংবাদিকতা করতেন। জানা গেছে, ২০১৩ সালের ফেব্রয়ারিতে ‘উয়েরা’ অফিসে ইরানী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী হানা দেয়। কর্তৃপক্ষের হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে মে মাসে ইরান থেকে পালিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় যান তিনি। ইন্দোনেশিয়া থেকে নৌকায় দু’বার অস্ট্র্রেলিয়ায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। প্রথমবারের চেষ্টার সময় নৌকা ডুবে যায়। ভাগ্যক্রমে ইন্দোনেশিয়ার জেলেরা বুচানিকে উদ্ধার করে। এরপর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে আবারও নৌকায় যাত্রা শুরু করেন বুচানি। ওই নৌকায় ছিল ৭৫ জন অভিবাসন প্রত্যাশী। অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনী নৌকাটিকে বাধা দেয়। অন্য অভিবাসন প্রত্যাশীদের সাথে বুচানিকে আটক করে মানুস দ্বীপে আটক কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়। আর বেরোতে দেয়া হয়নি তাদের কাউকে। অস্ট্রেলিয়ার কঠোর নীতি তারা আশ্রয় দেবে না কোনো উদ্বাস্তুকে। তখন থেকে মানুস দ্বীপেই আছেন তিনি। সেখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই তার। আটক কেন্দ্রে বসে বসে ফারসি ভাষায় একটি বই লিখে ফেলেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন নীতির তীব্র সমালোচক তিনি। তিনি বলেন,‘ আশ্রয়প্রার্থীদের অস্ট্রেলিয়ায় পা ফেলার আগে সমুদ্রেই আটকে দেওয়া হয়। তার পর ‘প্রসেসিং’য়ের জন্য নিয়ে আসা হয় ক্যাম্পগুলিতে।’ তিনি বলেন, ‘এটা অস্ট্রেলিয়ার সরকারের জন্য দারুণ লজ্জার। তাদের নীতির কারণেই আজ আমার এ দুর্দশা।’
বুচানির জীবনস্মৃতি মূলক বইটির পুরো নাম ‘নো ফ্রেন্ড বাট দি মাউন্টেন্সঃ রাইটিং ফ্রম মানুস প্রিজন।’ পুরস্কার পাওয়ার পর বুচানি বলেন, ‘এই ক্যাম্পগুলোতে আমার আশেপাশে যেভাবে নির্দোষেরা দিনের পর দিন কষ্ট পাচ্ছেন, তা দেখার পরে আমি এই সাফল্য উদযাপনের কোনো কারণ দেখি না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি। শুধু অভিবাসন চেয়েছি। আমাদের মুক্তি দিন।’
বুচানিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- কেমন ছিল লেখার সময়টা? তিনি বলেন, ‘ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। যদি ক্যাম্পের রক্ষীরা মোবাইল ফোনটা কেড়ে নেয়! তিনি বলেন, এক অফিসারকে বলেছিলাম, আমি একজন লেখক। তিনি হেসে উঠেছিলেন। অর্ধনগ্ন অবস্থায় ক্যাম্পের বেড়ার ধারে যখন কাজ করতে হত, তখন সেই ছবিগুলো মনে ভাসত। দ্বীপান্তরে বন্দী এক লেখককে দেখতে পেতাম। ’
এক ভিডিও বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘ শব্দের এখনও ক্ষমতা আছে অমানবিক ব্যবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার। সাহিত্যের ক্ষমতা আছে আমাদের মুক্তি এনে দেওয়ার। আজ সাহিত্যেরই জয়ের দিন।’ অস্ট্রেলিয়ার জুরিদের কাছে তার বইটি মান্যতা পেয়েছে। তাঁদের অনুরোধেই নাগরিকত্ব না থাকা সত্ত্বেও বেহরুজ বুচানির বই সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে। সৃষ্টির যে কোনো স্থান কাল হয় না, তাদের বিচারের রায়ে সে কথাই প্রমাণিত হয়েছে।
‘নো ফ্রেন্ড বাট দি মাউন্টেন্স’-এর অংশ বিশেষ:
‘আমি মানুসে বন্দী শিবিরে আসার পর একমাস কেটে গেছে। আমাকে যেন এক টুকরো মাংসের মত একটি অজানা জায়গায় নোংরা ও গরম এক কারাগারে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। আমি এক জনসমুদ্রের মধ্যে বাস করি যাদের চেহারায় ক্রোধের চিহ্ন ফুটে আছে, দেখেই মনে হয় শত্রু। প্রতি সপ্তাহে একটি বা দুটি বিমান নামে দ্বীপের বিমানক্ষেত্রটিতে আর পেট থেকে উগরে দেয় একগাদা মানুষ। কয়েক ঘন্টা পর ভেড়াকে জবাইখানায় নেয়ার মত করে এনে তাদের ঢোকানো হয় আরো অসংখ্য হতভাগ্য মানুষের সাথে কারাগার নামক দোযখে।
নবাগতদের উপস্থিতিতে কারাগারে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে । পুরনোরা নতুনদের এমনভাবে দেখে যেন হামলাকারীরা ঢুকেছে। তাদের বেশিরভাগকেই ফক্স কারাগারে নেয়া হয়। কারণ, এ কারাগারটি বড় ও তার বিচ্ছিন্ন প্রান্তগুলোতে নবাগতদের জন্য তাঁবু খাটানোর জায়গা আছে। এর পশ্চিম অংশে ডেল্টা ও অস্কার নামে দুটি বন্দীশালা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ানো। তবে ফক্স কারাগার থেকে শুধু ডেল্টা কারাগারটিই দেখা যায়। কারাগারটি দেখতে একটি খাঁচার মত, ঠিক যেন মৌমাছির বাসা। দুটি পরস্পর সংলগ্ন কারাগারের মধ্যে চলাফেরার জন্য একটুকরো জায়গাও রাখা হয়নি। কারাগারগুলোতে মানুষের এত ভিড় যে দেহে দেহে ঠোকাঠুকি হয়, না কথাটা ঠিক হল না বোধ হয়, আসলে ঠোকাঠুকি হয় মানুষের মাংসে মাংসে। তাদের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে সংঘর্ষ ঘটে। শুধু মৃত্যুপথের অভিযাত্রায়ই এমনটি হয়। ফক্স কারাগারে একটি ফুটবল মাঠের সমান জায়গায় প্রায় চারশ’ মানুষকে রাখা হয়েছে। ঘরগুলো ও বারান্দার মধ্যে জায়গা এত অল্প যে সেখান দিয়ে আসা – যাওয়া করা মানুষগুলোর স্রোত বইতে থাকে।’