দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি যেভাবে বদলে দিচ্ছে সৌদি আরব
এশিয়ায় বিশেষ করে পাকিস্তান ও ভারতে বিলিয়ন-ডলারের সৌদি বিনিয়োগকে মনে হতে পারে বিনিয়োগের বাইরেও ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার বাস্তব বাস্তবায়ন। ওই পরিকল্পনার আলোকে সৌদিরা তাদের অর্থনীতির প্রকৃতিই বদলে ফেলছে। ২০১৫ সালের ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের (এমজিআই) ‘সৌদি অ্যারাবিয়ান বিয়ন্ড ওয়েল: দি ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড প্রডাক্টিভিটি ট্রান্সফরমেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ‘অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের’ কথা বলা হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটেই ভিশন ২০৩০ প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, এ ধরনের বিনিয়োগ এমন এক অঞ্চলে হচ্ছে যেখানে আন্তঃরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা নানামুখী, ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি ও উত্থান-পতন অনিবার্য। আর সৌদি আরবও এগুলোর ব্যাপারে বেখেয়াল নয়।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গোয়াদারসহ সৌদি আরবের সাথে বিলিয়ন-ডলারের অংশীদারিত্বের অর্থ হলো ইরানের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটা। বিষয়টি ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে। আগে যেখান সীমান্ত-নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল, এখন সেখানে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তেহরান এক গুচ্ছ অভিযোগ উত্থাপন করছে। বিপ্লবী গার্ডদের ওপর সাম্প্রতিক হামলায় ডজন দুয়েকের বেশির লোক হত্যার পর পাকিস্তান সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে ইরান অভিযোগ করেছে।
ইরানি সীমান্ত ও বন্দরের একেবারে কাছে সৌদি উপস্থিতির পর পাকিস্তানের সাথে কিভাবে সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে (এমনকি চীনা সহায়তা সত্ত্বেও) ইরান তা বুঝতে পারছে না। ইরানের কাছে পাকিস্তান সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিকভাবে ‘মিনি সৌদি’ হয়ে পড়ছে। বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির সাথে ইরানের সমালোচনা করতে করতে দেশটিকে ‘সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় মদতদাতা’ হিসেবে পর্যন্ত অভিহিত করেন।
এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়। তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে যে ঘোষণা এসেছে তাতে বুঝা যায় তেহরানের সঙ্গে সুষ্ঠু সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের বিকল্পকের মধ্যে টানাপড়েন রয়েছে। এটা শুধু দেশটি সৌদিদের সফরের অনুমতি ও ইরানকে মৌখিকভাবে আক্রমনের সুযোগ করে দেয়ার কারণে নয়, পাকিস্তান সৌদি বক্তব্যকে খণ্ডনও করেনি এবং বলেনি যে ইরানের ব্যাপারে তাদের আলাদা নীতি ও ভিশন রয়েছে।
অন্য দিকে সাম্প্রতিক হামলার সাথে পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব জড়িত বলে ইরান যে দাবি করেছে, তাতে ক্রমবর্ধমান সৌদি উপস্থিতিতে বদলে যাওয়া আঞ্চলিক পরিবেশ ও পাকিস্তান কত দৃঢ়ভাবে সৌদি শিবিরে যোগ দিচ্ছে তা নিয়ে দেশটির ভাবনা ফুটে ওঠেছে। ইরানি নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, সন্ত্রাসী হামলার সাথে এই অঞ্চলের (পাকিস্তান) ও এর বাইরের (সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশ রয়েছে।
ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ডস কোরের কমান্ডার মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জাফারি বলেন, পাকিস্তান এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব পালন না করলে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে হুমকি মোকাবিলা করা এবং আঞ্চলিক ও অঞ্চলের বাইরে থেকে আসা সন্ত্রাসীদের শাস্তি প্রদান করার অধিকার ইরানের রয়েছে। তবে ইরান যেমন বলছে, ইরানবিরোধী গ্রুপগুলোকে অর্থায়নই এই অঞ্চলে সৌদি আরবের একমাত্র রাজনীতি নয়। এর সাথে তেল বাজারে ইরানের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার বিষয়টিও জড়িয়ে আছে।
ভারতে বিশ্বের বৃহত্তম তেল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল প্লান্ট গড়ে তোলার জন্য সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মধ্যে তাদের তেল বাজার সম্প্রসারণ ও ইরানকে এই বাজার থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। পরিকল্পনা করা হয়েছে, এই শোধনাগারে যে তেল আসবে, তার অর্ধেকের বেশি আসবে সৌদি আরব থেকে।
আমিরাতের প্রতিমন্ত্রী ও অ্যাডনক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী সুলতান আহমদ আল জাবের বলেছেন, এই প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা অ্যাডনকের প্রধান একটি বাজার যেমন নিশ্চিত করেছি, একইভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ও দ্রুত বর্ধিষ্ণু বাজারে আমাদের প্রবেশ নিশ্চিত করছি।
সত্যিই, প্রকল্পটিতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অ্যাডনক ও আরামকো মিলে যে তেল সরবরাহ করবে, তা থেকে ভারতও লাভবান হবে। তারা স্থানীয় বাজার থেকেই তাদের ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত চাহিদা পূরণ করতে পারবে। এর অর্থ হলো, ভারতে ইরানকে হটিয়ে সৌদি আরব হবে প্রধান তেল সরবরাহকারী। আমেরিকার অবরোধের কারণে ইতোমধ্যেই ইরান থেকে ভারতের তেল আমদানি অনেক কমে গেছে।
গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভারতে ইরানি তেলের সরবরাহ ২১ ভাগ হ্রাস পেলেও সৌদি সরবরাহ বেড়েছে প্রায় ১০ ভাগ। আর যৌথ সৌদি-আমিরাত-ভারত শোধনাগারের ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হওয়ার পাশাপাশি ইরানকে আরো পেছনে ফেলে সৌদি তেল রফতানি বাড়তেই থাকবে।
তবে ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্কে এটা কেমন প্রভাব ফেলবে, তা এই পর্যায়ে অনুমান করা কঠিন। ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতির হলে চাহাবারে ভারতীয় উপস্থিতি কমলে চীন খুশি হতে পারে। আর তাতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) ইরান আরো বেশি একীভূত হয়ে যাবে।
আরো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, চীনে মোহাম্মদ বিন সালমানের সফরের ঠিক আগ দিয়ে চীনা নেতৃত্ব জোর দিয়ে জানায় যে ইরানের সাথে তাদের সম্পর্ক জোরদার করা ও সম্পর্ক গভীর করার আকাঙ্ক্ষা আগের মতোই থাকবে। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সম্পর্ক গভীর করার প্রধান উৎস হবে ইরানি তেল ও বিআরআই।