একজন রোল মডেল আলেমের বিদায়
মনজুরে মওলা: একটু তাড়াহুড়ো করেই যেন চলে গেলেন আমাদের উস্তাদ ও উসওয়াহ সিলেট জামিয়া কাসেমুল উলূমের প্রিন্সিপাল মুফতী আবুল কালাম জাকারিয়া! কল্পনাতেও এমন সংবাদ শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। ছিলো না সিলেটের কেউই।
বিগত চল্লিশ বছর ধরে সিলেটের বিখ্যাত দরগা মাদরাসায় ইলমের স্বাদ, গুন ও মানে যিনি ছিলেন দৃষ্টান্ত, তিনি আবুল কালাম জাকারিয়া। তাঁর যিন্দেগীর সৌন্দর্য্য সম্পর্কে শুধু তারাই বলতে পারবেন, যারা সরাসরি তাঁর সান্নিধ্য ও সুহবত লাভের সুযোগ পেয়েছেন।
ছাত্রদের ভয়, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা একসাথে তিনটিই নিবেদিত থাকতো সর্বদা তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি। আশির দশকে সিলেটের ইলমী মারকায ছিলো দরগা মাদরাসা। এই ইলমের গোডাউন ছিলো তিন তালার বিশাল কুতুবখানা (লাইব্রেরী)। দেশের বিরল ও দুর্লভ কিতাবের সমাহার এখানে। সুনামগঞ্জী হুজুরের ঠিকানা ছিলো ঐ কুতুবখানাই। কুতুবখানার চারপাশে লেগে থাকতো রাজ্যের নিরবতা। এটা কি কুতুবখানার মর্যাদার কারণে, নাকি সেখানে সুনামগঞ্জী হুজুর আছেন সে জন্যে আমরা তা ঠিক বুঝতে পারতাম না।
১৯৮৮ সাল। আমরা দরগা মাদরাসার শিক্ষার্থী। নিরবতা বজায় রেখে চুপি চুপি যেতাম কুতুবখানায়। কখনো প্রয়োজনে, কখনো বা কৌতুহলে । প্রবেশ করেই দেখতাম ঢাউস আকৃতির কোন কিতাব খুলে পাশে ওটার বাচ্চা সাইজের আরো দু একটি কিতাব মেলে নিবিড় দৃষ্টিতে ছত্রসমুহের মাঝখানে ডুবে আছেন আমাদের উস্তাদ। ঘুম আর খাওয়ার সময় ব্যতিত তাঁর কক্ষে তাঁকে পাওয়া যেতো না। তিনি যখন কুতুবখানা বন্ধ করে মসজিদে যেতেন, আমরা পেছনে পেছনে দেখতাম আরেকটি চলমান কুতুবখানাই যেন হেটে চলেছে। অনেক বরনীয় উস্তাদ ছিলেন দরগা মাদরাসায়। তাঁদের অনেকে অনেক ভাবে সনামধন্য। তাঁর পরিচয় ছিলো গোপন। তবু তিনি সবার কাছে তিনি ছিলেন ইলমের ভারি সিন্দুক।
দরগা মাদরাসার ছাত্রজীবনে তাঁর নাগরানীতে ছিলাম দীর্ঘ দিন। একটি বারও তাঁর ধমক খাওয়ার স্মৃতি মনে করতে পারছি না। অথচ ভয় পেতাম খুব, সদা সতর্ক থাকতাম। আমাদের ভয়টা ছিলো শাস্তির নয়; ছিলো এই লজ্জাবোধের যে, তাঁর চোখ আমাদের কোনো ভুল দেখে ফেলে কি না। আমি জানি না, কোন শিক্ষককে তাঁর ছাত্ররা ভয়, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার পেয়ালা একই সাথে সমান ভাবে পূর্ণ করে পরিবেশন করতে পারে কিংবা পেরেছে কি না? তবে তা দেখেছি এই জায়গায়। জ্ঞান।সাধক আমাদের উস্তাদ কথা বলতেন কম। কোন কৃত্রিমতা ছিলো না তার আচরণে। কথা বলার সময় ঠোটের কোণে লেগে থাকতো একটি ছোট্ট মুচকি হাসি।
ক্লাশ আর কুতুবখানায়ই আটকে ছিলো তাঁর জীবনঘড়ি। ছাত্রদের বাইরে তাঁর পরিচিতি দূরে থাক, তাঁকে তেমন দেখাও পেতো না কেউ। কিন্তু তার গোপনীয়তার দেয়াল উঠিয়ে দিয়ে অনতিবিলম্বেই আল্লাহ বিখ্যাত করে দিলেন তাঁকে। অচিরেই তাঁকে চিনে ফেললো সমাজ। একদিন হলেন তিনি দরগা মাদরাসার মুহতামিম। শাহজালাল দরগা মসজিদের খতীব। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা ককরতেন। তবু তিনি হয়ে গেলেন বড়দেরও বড়। সিলেটের ও দেশের সেরা মুফতি। সমগ্র সিলেটবাসীর শ্রদ্ধেয়-বরিত। দেশের ইলমী সমস্যার নির্ভরযোগ্য প-িত ও ডাক্তার। হলেন ইলম আর হিলমের হিমালয়।
আফসোস! তাঁর কাছ থেকে আমার এবং আমাদের আরো অনেক কিছুই নেয়ার ছিলো। কিন্তু কেন যে নিলাম না গতকাল পর্যন্তও। গাফিলতি ছিলো অনেক। কিন্তু শুধুই কি গাফিলতি? আমরা কি ঘুণাক্ষরেও জানতাম ১১ মার্চের পর তাঁকে আর কোথাও পাবো না। দশ দিনও অতিক্রম হয়নি! এই সেদিন সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে আমাদের এক অনুষ্ঠানে আসলেন। দিলভরা, আপন করা কথা বললেন। ঐক্যের আকুতি জানালেন। অন্য প্রোগ্রাম থাকায় তাঁর বক্তব্যের পরই বিনীতভাবে বিদায় নিলেন।
আহা!
যদি জানতাম! এমন ভাবে কোন অনুষ্ঠানে আর দেখবো না। তা হলে তাঁর চলে যাবার কালে অনুষ্ঠানের বাইরে গিয়ে পথ আগলিয়ে দাঁড়াতাম। সারা জীবন কিতাব হাতড়ানো ঐ পবিত্র হাতটি শেষ বার মাথায় বুলিয়ে নিতাম। একটি আখেরী নসীহত চেয়ে নিয়ে ডায়েরিতে লিখে রাখতাম!
কালের ব্যবধানে আমার মতো না-লায়েকের নামও আজ শিক্ষকের তালিকায়। কিন্তু আমি যে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আমার উস্তাদের মহান উচ্চতা আর আমার অযোগ্যতার দীনতম নীচতা। কোথায় আকাশ! আর কোথায় পাতাল? অথচ আমার নামের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক। এই পার্থক্য ও অজ্ঞানতা দূর করার প্রয়োজনে আবার ছাত্র হয়ে প্রিয় উস্তাদের দরবারে যাবার যে সুযেগ ছিলো গতকাল (সোমবার)। আজ থেকে যে চির বন্ধ হয়ে গেলো সেই আলোময় দরোজা!
হে প্রিয় উস্তাদ! আমরা তোমার উচ্চতা, সম্মান ও মহত্ব অনুধাবন করতে পারিনি। কোনো খেদমত করতে পারিনি। যদিও খেদমত চাইতেনও না কখনো। সিলেটবাসী আপনাকে আরো ভালোভাবে বরণ করতে, সম্মান জানাতে প্রস্তুত হচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই তো আপনি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। আপনি তো মহান। আল্লাহ যে আপনার। আপনার তো কাউকে প্রয়োজন নেই। সিলেটবাসীর আরো কিছু দিন দরকার ছিলো আপনার। আরো দরকার ছিলো তোমার ন্যূনতম কদরদানীর। কিন্তু সে সময়টা যে আপনি একেবারেই দিলেন না।
হে প্রাণ প্রিয় উস্তাদ! সারা জীবন সাধনার পর এবার বিশ্রাম নিন। ক্ষমা করুন মোদের। ক্ষমা করুন সিলেটবাসীকে। ময়দানে মাহশারে যেন আপনার সান্নিধ্য পাই একটি বারের জন্য।
–লেখক: আলেম ও গবেষক