কোরআনের আলোকে হজের বিধান ও তার অন্তর্নিহিত তাত্পর্য
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হজের জন্য রয়েছে সুবিদিত কয়েকটি মাস। তারপর যে কেউ এর মাঝে হজ স্থির করে নেয়, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীর সঙ্গে আবরণহীন হওয়া গুনাহ আর কলহ-বিবাদ করা জায়েজ নয়। তোমরা যা কিছু উত্তম কাজ কর, তা আল্লাহ তায়ালা জানেন। আর তোমরা পাথেয় সঙ্গে নিও, বস্তুত পাথেয়র শ্রেষ্ঠ উপকারিতা হলো হাতপাতা থেকে বেঁচে থাকা। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ! তোমরা আমাকেই ভয় কর।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)
আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিরাজি ও কালে বিশেষ কিছু মৌসুম রয়েছে। সেগুলো এমন মৌসুম বা ঋতু, যাতে হৃদয় ও আত্মার বসন্ত, ইমান ও আখলাকের বসন্ত আগমন করে। তাতে সূক্ষ্ম ও পরিচ্ছন্ন, মসৃণ ও উন্নত, শক্তিশালী ও জীবন্ত, প্রেরণাদায়ক ও অভিলাষিত হয়ে। রহমতের মৃদু বায়ু ও ভালোবাসার সুবাস বিচ্ছুরিত হয়।
আত্মিক মৌসুম ও ইমানি আধ্যাত্মিক উত্সব-পর্বণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে : ১. রোজার মাস রমজান, ২. হজের মাসগুলো, বিশেষ করে জিলহজ মাস। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় পবিত্রগ্রন্থে এগুলো একের পর এক উল্লেখ করেছেন। এগুলোর উচ্চ প্রশংসা করেছেন এবং বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
হজ ও রোজার মাঝে অন্তর্নিহিত সাদৃশ্য : এ কয়েকটির মধ্যে (বিশেষ করে হজ ও রোজা) একটি যোগসংযোগ, মিল পাওয়া যায়। যেমন আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য, প্রেম-ভালোবাসা, কাল ও স্থানের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সাদৃশ্য এতে সমন্বিত হয়েছে। তাই আত্মসমপর্ণ ও আনুগত্য ছাড়া রোজা হতে পারে না। তদ্রূপ প্রেম-ভালোবাসা ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টিকে প্রবৃত্তির চাহিদার বিপক্ষে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া রোজা হতে পারে না। এভাবে আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার এবং প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া হজ হয় না।
মানুষ রমজানে পানাহার ও প্রবৃত্তিচর্চা বর্জন করে রোজা পালন ও আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট ও আত্মার বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য। তেমনি হজে মানুষ তার আপন দেশ, বাসস্থান, পরিবার ও ভোগ-সামগ্রিকে বর্জন করে হজ পালন, প্রভুকে সন্তুষ্ট ও আত্মার বিরুদ্ধাচারণ করার জন্য।
রমজান মাসে রোজা পালন সবচেয়ে উত্তম সময় বলে স্বীকৃত। একই ভাবে পবিত্র হারামাইনে হজ পালন হয় সর্বোত্কৃষ্ট স্থান ও সর্বোত্কৃষ্ট সময়ে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে রোজা ও হজের মাঝে অন্তঃমিল পাওয়া যায়। হজ রোজার সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। কেননা উভয়টিতেই আত্মত্যাগ ও তপসা চর্চা, চরম ধৈর্য ধারণ, নিঃস্বার্থ ও ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে। রোজাদার রোজা রেখে পানাহার বর্জন ও দিন শেষে রোজা ভাঙার জন্য দৌড়াতে থাকে। সে আপন প্রভুর গৃহের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। তেমনি হাজীও সাফা-মারওয়ায় দৌড়ায়, মিনা আরাফায় দৌড়ায় এবং আপন প্রভুর গৃহের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। এগুলো সবই একটি উত্সব, একটি উত্সর্গ ও একটি অভিবাদন।
আল্লাহ তায়ালা রমজানে রোজা পালন অবস্থায় বিশেষ ভাবে গিবত, পরচর্চা, মিথ্যা কথা, ঝগড়া-বিবাদ থেকে নিষেধ করেছেন এবং এই কদর্য বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কর্ম বর্জন করতে পারল না; আল্লাহ তায়ালার কোনো প্রয়োজন নেই যে, সে পানাহার বর্জন করবে।
তিনি আরও বলেন, তোমাদের কেউ রোজা রাখলে সে যেন অশ্লীল কথা, হৈচৈ ও হট্টগোল ইত্যাদি বর্জন করে। যদি কেউ তাকে গাল দেয়, তাহলে সে বলবে আমি রোজাদার।
অন্যত্র বলেন, অনেক রোজাদার তার রোজা থেকে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই পায় না।
একই ভাবে আল্লাহ তায়ালা হজ পালনকালীন সময়েও অশ্লীলতা, পাপাচার ও অন্যায় কাজে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘হজের জন্য রয়েছে সুবিদিত কয়েকটি মাস। তারপর যে কেউ এর মাঝে হজ স্থির করে নেয়, তার জন্য হজের সময়ে স্ত্রীর সঙ্গে আবরণহীন হওয়া গুনাহ আর কলহ-বিবাদ করা জায়েজ নয়।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)
এসব আয়াত ও এমনসব দৃষ্টিভঙ্গিতে কোরআন নাজিল ও শরয়ি বিধান প্রবর্তনে বিস্ময় ও অলৌকিকতা প্রকাশ পায়। কেননা রোজা প্রবৃত্তির ওপর কঠিন হওয়ার কারণে রোজাদার তার প্রিয় জিনিস থেকে দূরে থাকার কারণে, আপন স্বভাবকে বর্জনের ফলে গিবতের সম্ভাবনাময় স্থানে উপনীত হয়। যেখানে (গোনাহ বর্জন করে) নিজের আত্মাকে রক্ষা করা অথবা (গিবত শেকায়েত করে) নিজের সময়কে নষ্ট করা উভয় সম্ভাবনাই বিদ্যমান থাকে। তদ্রূপ (রোজা পালনকালে) হৃদয়ের রূঢ়তা ও সামান্য কারণে রাগান্বিত হয়ে ঝগড়া-বিবাদ, একগুঁয়েমিতে পতিত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। তাই এসব থেকে তাকে নিষেধ করা হয়েছে।
এভাবে হাজীও আপন পরিবার থেকে দূরে চলে যাওয়া, দীর্ঘ সফর, বিভিন্ন ক্ষেত্র কষ্ট-ক্লেশের সম্মুখীন হওয়া ও বিভিন্ন দেশের অপরিচিত মানুষজনের সঙ্গে সংমিশ্রণের কারণে অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই হজ এসব সম্ভাবনাময় স্থান। এজন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর গৃহের দিকে সফরকারী হাজীকে এসব থেকে বিরত থাকতে ভীতিপ্রদর্শন করেছেন। আর এই গূঢ় রহস্য সেই সত্তা ছাড়া আর কেউ জানে না, যার জ্ঞান সব বিষয়কে পরিব্যাপ্ত করেছে। যিনি মানুষের স্বভাব, তার দুর্বলতা ও পদস্খলনের স্থান সম্পর্কে সম্যক অবগত।
যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না, তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত? (সুরা মুলক : ১৪)
রোজা ও হজ পালনে আনুগত্য ও ইবাদতের এমন কিছু পদ্ধতি নিহিত রয়েছে, যা মূলত রোজা ও হজের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। যেমন, আল্লাহ তায়ালার রাহে ব্যয় করা, সহমর্মিতা, রহমত, মানবসেবা, সত্কর্ম, সাদাকা, রাত্রি জাগরণ ও তাসবিহ-তাহলিল পাঠ, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি। এগুলো মূলত রোজা ও হজকে শক্তিশালী করে এবং তার সওয়াব ও ফজিলতকে বর্ধিত করে। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘তোমরা যা কিছু উত্তম কাজ কর, তা আল্লাহ তায়ালা জানেন।’
আল্লাহ তায়ালা হজ পালনের জন্য সুস্থতা ও পবিত্রতার সঙ্গে পাথেয় গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তদ্রূপ কল্যাণকর্ম ও ইবাদত বেশি বেশি করে পরকালের প্রস্তুতি নিতে উত্সাহিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর তোমরা পাথেয় সঙ্গে নিও, বস্তুত পাথেয়ের শ্রেষ্ঠ উপকারিতা হলো হাতপাতা থেকে বেঁচে থাকা। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ! তোমরা আমাকেই ভয় কর।’ (সুরা বাকারা : ১৯৭)
একই ভাবে রোজাদারকে রোজার পাথেয় গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেই পাথেয় হচ্ছে, সেহরি গ্রহণ, যা রোজা পালনে সবল ও সহায়তা করে। অন্যদিকে বাইতুল্লাহর মুসাফির হাজী পাথেয় ও বাহন গ্রহণ করে। তাই এখানে রোজা ও হজের মধ্যে এক অপূর্ব সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। (তায়াম্মুলাত ফিল কোরআনিল কারিম থেকে অনূদিত)
লেখক : মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী (রহ.)
অনুবাদ : মুশাহিদ দেওয়ান; তরুণ আলিম, প্রাবন্ধিক