‘গুয়ানতানামো বে’ খ্যাত কারাগারে অ্যাসাঞ্জ

যুক্তরাজ্যের আদালতে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ‘জামিন শর্ত ভঙ্গ’র অভিযোগে। তবে তাকে রাখা হয়েছে এমন এক কুখ্যাত কারাগারে, যেটিকে কেউ কেউ ‘যুক্তরাজ্যের গুয়ানতানামো বে’ নামে ডেকে থাকেন। ৯/১১ এর হামলার পর প্রণীত এক বিতর্কিত সন্ত্রাসী আইনে অভিযুক্তদের বেলমার্শ নামক ওই কারাগারটিতে রাখা হতো। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ হাউস অব লর্ডস আইনটি পাসের সময় তাদের মতামতে বলেছিল: এটি মৌলিক মানবাধিকারবিরোধী আইন। টুইন টাওয়ার হামলা কিংবা আইএস-এর জঙ্গিবাদী কর্মকান্ডে জড়িত সন্ত্রাসীসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে অভিযুক্তরাই বেলমার্শ কারাগারে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কেবল সংবাদমাধ্যম আর মানবাধিকার সংস্থা নয়, খোদ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন নিজস্ব অনুসন্ধানেও কারাগারটির ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটে উঠেছে। শঙ্কা জোরালো হয়েছে অ্যাসাঞ্জের স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা নিয়ে।

বিকল্পধারার অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম কনসোর্টিয়াম নিউজ এর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সন্ত্রাসবিরোধী, অপরাধ ও নিরাপত্তা আইন ২০০১ এর আওতায় উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় নিরাপত্তাজনিত অভিযোগে আটককৃতদের অনির্দিষ্টকালের জন্য বেলমার্শ কারাগারে বন্দি রাখা হতো। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার ছয় সপ্তাহ পর আইনটি পাস করে যুক্তরাজ্য। তবে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ হাউস অব লর্ডস এর রুলে বলা আছে, এ আইনটি ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনকে লংঘন করে। উল্লেখ্য, পার্লামেন্টে এ ধরনের আইন পাসে নিম্নকক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। উচ্চকক্ষের কেবল মতামত দেয়ার সুযোগ থাকে।

বেলমার্শে অতীত ও বর্তমানে থাকা উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছে কুখ্যাত গ্যাংস্টার, সিরিয়াল কিলার ও মাদক চোরাচালানকারী। ১৯৬৩ সালে ট্রেন ডাকাতিতে অভিযুক্ত রনি বিগসকে সেখানে কারারুদ্ধ রাখা হয়েছিল। এম সিক্সটিন এর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রস্তাবিত বইয়ের সারমর্ম অস্ট্রেলীয় প্রকাশককে দেয়ার পর ১৯৯৭ সালে ছয় মাসের জন্য কারাবন্দি রাখা হয় রিচার্ড টমলিনসনকে। বন্দিদের একটা বড় অংশ অভিযুক্ত সন্ত্রাসী। মিসরীয় ধর্মগুরু আবু হামজা আল মাসরিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের আগে পর্যন্ত বেলমার্শে রাখা হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত ১১টি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- ভোগ করছেন তিনি। ২০০৫ সালে লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডে বোমা হামলার প্রচেষ্টার অভিযোগে র‌্যামস মোহাম্মদ, মুক্তার সাইদ ইব্রাহিম ও ইয়াসিন হাসান ওমরও ছিল সেখানে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এর হয়ে প্রচারণা চালানোর অভিযোগে বেলমার্শে সাজা শেষ করেছেন আনজু চৌধুরী। ইসলামী সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা পাওয়া মাইকেল আদেবোলাজো ও মাইকেল আদেবোয়ালেকে লন্ডনে ব্রিটিশ সেনা লী রিগবিকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

২০০৪ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বেলমার্শ কারাগার নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, বন্দিদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত কারাকক্ষে বন্দি থাকতে হয়। ২০০৬ সালে একই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনে ওই কারাগার নিয়ে নাগরিকদের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে টুইটারে পোস্টকৃত ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, পার্থক্য টানতে গিয়ে মানুষ ব্যাঙ্গ করে যে, বেলমার্শ কারাগারে গুয়ানতানামোর মতো থেরাপি আর কাউন্সেলিং গ্রুপের পাশাপাশি শিক্ষা, কর্মশালা, জিম আর লাইব্রেরিও আছে! মানবাধিকার সংগঠন কেজ মুক্তি পাওয়া এক বন্দিসূত্রে জানায়, সেখানকার কারাবিধিই বন্দিদেরকে যথাসম্ভব অপমান ও অপদস্থ করার কৌশলে প্রণীত। কেবল সংবাদমাধ্যম আর মানবাধিকার সংস্থা নয়, ২০০৯ সালে খোদ ব্রিটিশ কারা কর্তৃপক্ষের তদন্তে দেখা গিয়েছিল, কারাগারে বন্দিদের নিয়ন্ত্রণ করতে ‘অত্যন্ত বেশি’ রকমের শক্তি ব্যবহার করা হয়।

২০১৮ সালে পরিচালিত কারা কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধানেও ওই কারাগারের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছিল। শীর্ষ কারা পরিদর্শকের পরিদর্শন শেষে তিনি জানিয়েছিলেন ৯১ শতাংশ কয়েদি ওই কারাগার সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে যা অন্য কারাগারের ক্ষেত্রে হয় না। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিন বছর আগে পরিদর্শনের সময় ওই কারাগারে সংস্কার আনতে দেওয়া ৫৯টি সুপারিশের মধ্যে ৩৭টি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয় কারা কর্তৃপক্ষ। প্রতিবেদনে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ভয়ঙ্কর অপরাধীদের সঙ্গে সেখানে মাঝারি অপরাধে জড়িতদেরও রাখা হয়েছে। সেখানে এমন সব আক্রমণাত্বক বিদেশী অপরাধী রয়েছে, যাদের কাছ থেকে অন্য কয়েদীদের সুরক্ষা দরকার। কারাগারের অভ্যন্তরে থাকা ‘উচ্চ নিরাপত্তা ইউনিট’ নামের ‘বিশেষ কারাগার’ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, এই বিশেষ স্থানটির ভূমিকা অস্পষ্ট। বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘উচ্চ নিরাপত্তা ইউনিট’-এ থাকা বন্দিদেরকে তীব্র ও কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের কবলে পড়তে হয় যেখানে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ থাকে না। বেলমার্শ কারাগারে অ্যাসাঞ্জ কিভাবে দিন কাটাচ্ছেন তা নিয়ে তাই উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, অ্যাসাঞ্জ ওই কারাগারে যথাসময়ে চিকিৎসা সুবিধা পাবে না। এতে বলা হয়েছে, ‘বেলমার্শের অনেক বন্দি চিকিৎসক কিংবা নার্সের সহায়তা নিতে পারছেন না, অথচ কারাগারে এসব সেবা দেওয়ার কথা।’ -বিবিসি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button