একটি খসেপড়া তারকার গল্প
আল্লামা শফিকুল হক আমকুনীর চিরবিদায়: হারিয়ে গেলো সিলেটের বিচক্ষণতার তারা
মনজুরে মাওলা: এক মন ইলমের সাথে থাকতে হয় নয় মন আকল ! কিন্তু শফিকুল হক আমকুনীর ছিলো নয় মন ইলমের সাথে আঠারো মন আকল। তাঁর বিচক্ষণতাই তাকে দিয়েছিলো অনন্যতা। হয়েছিলেন অনেক নতুনের নির্মাতা। তিনি ছিলেন অজস্র আলেমের মাঝে ইউনিক। ছিলেন একাধারে যোগ্য আলেম, সংগঠক, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, উদ্যোক্তা, আবিদ ও যাহিদ।
সত্তরের দশক। যখন দেশে ইসলামী রাজনীতি আঁতুড় ঘরে। ঐ বন্ধ্যাত্বের সময়ে যাঁদের হাত ধরে ইসলামী রাজনীতি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঘর থেকে বেরিয়ে রাজপথে নামে। শফিকুল হক আমকুনি তাঁদেরই একজন। উপমহাদেশে একাধারে জ্ঞান, সাধনা, সংগ্রাম ও রাজনীতির সকল পাঠ একই সাথে যে পরিবার থেকে যুগ যুগ ধরে অব্যাহত, তিনি ছিলেন সেই মাদানী পরিবারের ঘনিষ্টজন। সেই শুরু থেকেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জমিয়তের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
খলিফায়ে মাদানী মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়ার একান্ত সহচর ও সচিব ছিলেন মাওলানা শফিকুল আমকুনী । ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (র.) বটগাছ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে এলে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
মাওলানা শফিকুল হক আমকুনীর জন্ম ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৫ মে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। প্রায় ৫০ বছরের কর্ম জীবনে কাজের সাথী ও সমসাময়িক ওলামায়ে কেরাম যাদেরকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন, মাওলানা হোসাইন আহমদ বারকুটি, বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা, মাওলানা রিয়াছত আলী শায়খে চৌঘরী, মাওলানা আব্দুল গাফ্ফার শায়খে মামরোখানি, খতিব মাওলানা উবায়দুল হক জালালাবাদী, মাওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, মাওলানা আমিন উদ্দিন শায়খে কাতিয়া, মাওলানা আব্দুল হক শায়খে গাজিনগরী, মাওলানা উবায়দুল হক উজিরপুরী, শায়খুল হাদিস মাওলানা নুর উদ্দিন গহরপুরী প্রমূখ, শায়খুল হাদিস মাওলানা এমদাদুল হক হবিগঞ্জি, প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী প্রমুখ।
তিনি সোচ্চার ছিলেন সিলেটের ন্যায্য দাবী-দাওয়ার পক্ষে রাজপথেও। আলেম ও মাদরাসা বৃত্তের বাইরেও ছিলো তার যোগা্যোগ ও সম্পর্ক। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, সুধীজন সকল দিকেই ছিলো তার নজর। মেয়র বদর উদ্দিন কামরান তাকে বড় ভাইয়ের মতো দেখতেন। ভাইছাব বলে সম্বোধন করতেন। রহস্যজনক কারণে ধোপাদীঘির পাড়স্থ সিলেট সিটি কর্পোরেশন জামে মসজিদেরর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে মসজিদের নির্মাণ যাথারীতি সম্পন্ন হয়।
তিনি ছিলেন স্পষ্ট উচ্চারণের উপমা। যা বুঝতেন, যা বিশ্বাস করতেন তা সোজা সাপ্টা বলে দিতেন। কখনো কখনো তাঁর মজলিসে বসে এমন দ্বিধাহীন স্পষ্ট উচ্চারণে আমরা অবাক হয়ে যেতাম। তাঁর সাথে অনেকেরই মতানৈক্য হতো, কিন্তু তাঁকে ছাড়া আবার চলতোও না। তিনি ছিলেন কাজে লেগে থাকার মতো মানুষ। আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসায় পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানে যখন জটিলতা পেকে যায় তখন তীক্ষ্ণতা ও বুদ্ধিমত্তার কারণে শফিকুল হক আমকুনীর কাধেই মুহতামিমের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। উনিশশো আশি সাল পর্যন্ত তিনি আঙ্গুরা মাদরাসাকে পরিচালিত করেন, সুগঠিত করেন।
সম্মিলিত আন্দোলন-সংগ্রামে প্রশাসন কিংবা বিরোধী পক্ষের সাথে জটিলতা সৃষ্টি হলে সবাই হাজির হতেন সুবহানিঘাট মাদরাসায় আমকুনী হুজুরের দরবারে। তখন তাঁর বিচক্ষণতাই নির্ধারণ করতো পরবর্তী পথ ও কর্মসুচী। তিনি ছিলেন ইবাদতের এক নমুনা। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, ইশরাক, তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত এসব ছিলো তাঁর অলংঘনীয় আমল। মাদরাসার মসজিদেই সকল ওয়াক্তের নামাজ আদায় করতেন। ফজরের জামাতে আগপাড়ার বাসা থেকে গাড়ীতে আসতেন। ড্রাইভার না থাকলে হেটে। বৃষ্টি হলে ছাতা মাথায়।
তিনি ছিলেন যাহিদ, নির্লোভ। দুনিয়ার স্বাদ-জৌলুসে নিস্পৃহ। তাঁর মেধাবী সন্তানদের কাউকে ব্যবসায় লাগাননি, ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাননি, সরকারী সার্টিফিকেট অর্জন করাননি। যা ইচ্ছে করলেই হতো। পুত্র মাওলানা আহমদ কবির ও মাওলানা আহমদ সগীর দু জনকেই তাঁর দ্বীনি বাগানের মালি হিসেবে নিয়োগ করে দেন।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ হন। এর পর পাকিস্তানের জামিয়া বিন্নুরী টাউন করাচী থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরের বছরই আল্লামা নুরউদ্দিন গহরপুরীর অনুরোধে সিলেটের গহরপুর মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র মক্কা শরীফে চলে যান। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে আবারো গহরপুর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিলেটের জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদরাসার মুহতামিম হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। এরপর তিনি সিলেট সোবহানীঘাট মসজিদে ইমামতিতে যোগ দেন। এখানে দাওয়াত ও ইরশাদ অব্যাহত রাখেন। মসজিদের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন জামেয়া মাহমুদিয়া সোবহানীঘাট মাদরাসা। এই জামিয়া সিলেট শহরের ঈমান-আক্বীদার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিয়ামত অবধি তার জন্য ইহা সাদাকায়ে জারিয়াহ হয়ে থাকবে ইনশাল্লাহ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন। মাওলানা শফিকুল হক আমকুনী ছিলেন আল্লামা সৈয়দ আসআদ মাদানী (র.)-এর বায়াত। তিনি খিলাফতি লাভ করেন কাপাসিয়ার পীর মাওলানা মিজানুর রহমান-এর। তিনি তাঁর সুবহানিঘাট মাদরাসা ছাড়াও জামিয়া দারুসসালাম খাসদবীর মাদ্রাসাসহ অসংখ্য দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
ক্ষনিকের পৃথিবীর সফর শেষে গত একু্শ এপ্রিল, চৌদ্দ শাবান তাকে সিলেটের মানিকপীরের টিলার শেষ ঠিকানায় শায়িত করে আসলাম।
ও আল্লাহ!
আমাদের মুরব্বী ও উস্তাদকে তুমি জান্নাতের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দাও!
ক্ষণিকের এই পৃথিবীতে তিনি অবস্থান করেন ৮০ বছর। বিদায় বেলা তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে, ৫ মেয়েস হ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আর রেখে গেছেন আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা, অজস্র দীক্ষা।