রাষ্ট্রীয় খরচে নিউ ইয়র্ক পিকনিক

মাকসুদুল আলম, টোকিও থেকে:
অবশেষে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৮তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। টেলিফোনে জাতিসংঘ মহাসচিব দুই নেত্রীকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে তাগাদা দেয়ার পর অধিবেশনে যোগদানের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। পত্রিকা মারফত জেনেছি, সারা পৃথিবী থেকে মোট রাষ্ট্রীয় অতিথির যে ক’জন অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে এসেছেন, তাদের প্রায় চার বা পাঁচ ভাগের এক ভাগই আমাদের বাংলাদেশ থেকে। গরিব রাষ্ট্রের জনগণের টাকায় ঐতিহাসিক ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সফরসঙ্গী নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রমোদ ভ্রমণ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে লেখা আমাদের সংবাদকর্মীদের প্রতিবেদন থেকে নতুন নতুন তথ্য জানতে পারছি। শুনেছি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের বেশির ভাগই নাকি জাতিসংঘমুখী নন। মানে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেয়া তাদের মূল কাজ নয়। অধিবেশন তো দূরের কথা, জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ভেতরে ঘুরেফিরে দেখার সুযোগও মিলছে না তাদের। রাষ্ট্রীয় খরচে বিলাসিতাপূর্ণ পিকনিকে গিয়ে রীতিমতো হোটেল রুমে নাকি শুয়ে-বসেই সময় কাটাচ্ছেন তারা। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে, গল্প-গুজব করে, আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ আবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ও বাপ-দাদার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন বাঙালি হোটেল-রেস্তরাঁয় ফ্রি খাওয়া-দাওয়া করছেন। তন্দুরি চিকেন, কাচ্চি বিরিয়ানি, পোলাও, খিচুরি আরও কত কি। নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ই-মেইলে জানিয়েছেন, বাঙালি অধ্যুষিত কুইনস্‌-এর জ্যাকসন হাইটস, এস্টোরিয়া, জ্যামাইকা ও ব্রুকলিনের মতো শহরগুলোতে অবস্থিত বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান যেমন স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে ঘুরেফিরে, নিজের স্ত্রী, ছেলের বউ ও মেয়ের জন্য মনোহারী ডিজাইনের জুয়েলারি শপে সোনাদানা ও গয়না-গাটি কিনে, ম্যানহাটনের শপিং মলগুলোতে কেনাকাটা করে আখেরি প্রমোদ ভ্রমণে মেতেছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। ক্ষমতার শেষ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বারোটা বাজিয়ে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় কোষাগার ফতুর করেই ক্ষান্ত হননি তারা, পুরো নিউ ইয়র্কের সেকেন্ড অ্যাভিনিউ ও এর আশপাশের এলাকাগুলোকে তারা আতঙ্কিত করে তুলেছেন বলে খবরে জানলাম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াড, দমকল বাহিনী, হ্যাজম্যাট, এফবিআই এন্টি টেরোরিজম টাস্ক ফোর্স, নিউ ইয়র্ক পুলিশের বিশেষ স্কোয়াড, অ্যাম্বুলেন্সসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাগুলোকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তারা। স্বর্ণালঙ্কারে সুটকেস ভর্তি আখেরি কেনাকাটা, গল্প-গুজব আর আড্ডায় মেতে উঠলেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ-সংবলিত পুস্তিকার প্যাকেটগুলোর প্রতি মোটেই খেয়াল ছিল না তাদের। প্যাকেটগুলোকে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যত্রতত্র ফেলে রেখে সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন তারা। ভাষণের প্যাকেটগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন কাণ্ড অবাক করেছে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনগুলোকে ও অধিবেশনে যোগ দিতে আসা রাষ্ট্রীয় অতিথিদের। সেপ্টেম্বর মাস। এমনিতেই আতঙ্কগ্রস্ত মার্কিনিরা। শুনেছি নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীও অতিরিক্ত নার্ভাস থাকে এ মাসে। তার উপর হয়তো ফরমালিন মেশানো বাংলাদেশী কালিতে ছাপানো পুস্তিকার বিশেষ গন্ধ ডগ স্কোয়াডকেও আতঙ্কিত করে তুলেছিল। প্রশিক্ষিত কুকুরের বিকট ঘেউ ঘেউ শব্দ এন্টি টেরোরিজম টাস্ক ফোর্সের সন্দেহকে বাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েক গুণ। এরপর হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের ডগ স্কোয়াডকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় কর্তৃপক্ষ কঠিন নমুনা হিসেবে বাংলাদেশের ফরমালিন মেশানো কালিও ব্যবহার করবেন বলে ধারণা করছি। বাতিল হয়ে যাওয়া জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার আগ পর্যন্ত আপাতত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুই নম্বর কালি রপ্তানি করেও যদি কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়, তাতেও মন্দ নয়।
পত্রিকায় পড়লাম, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর এই নিউ ইয়র্ক সফরকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাদের। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তারা। শোনা গেছে, কোটি টাকা ব্যয়ে সংবর্ধনা দেয়া হবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে। বিশাল আয়তনের ব্যানারে মঞ্চজুড়ে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। থাকবে বিশালাকৃতির নৌকা। ২ ঘণ্টার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ব্যয় করা হবে দেড় লাখ ডলার। এর পরিমাণ বাংলাদেশী টাকায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকারও কিছু বেশি। সংবর্ধনা হবে। জন্মদিন হবে। পিকনিক হবে। সবই হবে তবে, তা জনগণের টাকায়। সবই রাষ্ট্রীয় খরচে, নামে মাত্র প্রবাসী বাংলাদেশীদের টাকায়। ১৪০ জন সফরসঙ্গী নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী যোগ দিয়েছেন, তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। অধিবেশনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সবাইকে অস্ত্র না কেনার উপদেশ দিয়েছেন। তার বক্তব্যের সমালোচনা করে সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন বিগত পাঁচ বছরে তিনি নিজেই কত হাজার কোটি টাকার অস্ত্র কিনেছেন তার হিসাব কি দিতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের অনুপস্থিতিতে বর্তমানে রাষ্ট্র পাহারা দিচ্ছেন সরকারে নেই এমন একজন দাপুটে গলাবাজ। তিনি হয়তো নিজেকে এখনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাবছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে সমাজে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল, একথা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপমান করে তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘কথা না শুনলে তাদের কপালে দুঃখ আছে। তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’ একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিরোধী দলের বা ভিন্নমতের কেউ এমন হুমকি দিলে অবশ্যই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হতো। দিনের পর দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। ক্ষমতাসীন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হওয়ার সুবাদে তার কোন জবাবদিহি নেই। তিনি প্রকাশ্যে এ ধরনের রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত মন্তব্য করতে পারছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করার ভয় দেখাতে পারছেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলানোর চেষ্টা করতে পারছেন। তার এ মন্তব্যের সঠিক জবাব হয়তো জনগণ ভোটের মাধ্যমে দেবেন। আগামী নির্বাচনে তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button