ব্রেক্সিট: ইংরেজের অহমিকা রক্ষার মরিয়া চেষ্টা!
মুজতাহিদ ফারুকী: ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া ‘ব্রেক্সিট’। কয়েক বছর ধরেই বিষয়টি নিয়ে ব্রিটেনে তোলপাড় চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ ইস্যুতে অনুষ্ঠিত গণভোটে খুব অল্প ব্যবধানে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ৪৮ শতাংশ মানুষ ছিলেন ব্রেক্সিটের বিরোধী। এখন নতুন করে গণভোটের দাবি উঠেছে। অনেকেই বলছেন, আবার গণভোট হলে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে অর্থাৎ ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষেই গণরায় আসবে। এই ইস্যু নিয়ে দেশটির দুইজন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন এবং শাসক দলের নতুন নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে। বোঝা যাচ্ছে, ব্রেক্সিট ইস্যুতে বেশ শক্ত গ্যাঁড়াকলে পড়েছে এক সময় ছলে-বলে-কৌশলে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এলাকা শাসনকারী ইংরেজ জাতি। সামান্য ইতিবৃত্ত এ প্রসঙ্গে আলোচনা করে নিলে যাদের বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই তাদের বুঝতে সুবিধা হবে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) হচ্ছে ইউরোপের ২৮টি দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জোট। এই জোটের সদস্য দেশগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করে থাকে; সব ক’টি দেশের নাগরিকেরা জোটভুক্ত যেকোনো দেশে গিয়ে থাকতে ও কাজ করতে পারেন। এক সময় এই জোটের নাম ছিল ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি (ইইসি)।
১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য ইইসিতে যোগ দেয়। ৪০ বছরের বেশি সময় জোটের সাথে থাকার পর ইংরেজ জাতি জোট থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়। ২০১৬ সালের ২৩ জুন এ বিষয়ে গণভোটের আয়োজন করে সে দেশের সরকার। তখন দেশবাসীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বা ইইউর সাথে থাকতে চান, নাকি বেরিয়ে আসতে চান। ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইইউ ছাড়ার পক্ষে, আর থাকার পক্ষে ছিল বাকি ৪৮ শতাংশ ভোট।
তবে গণভোটের ফলাফল পাওয়ার সাথে সাথেই ব্রিটেন জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এ জন্য জোট নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করে একাধিক সময় নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার একাধিকবারই সেই সময়টা পিছিয়ে দেয়ার জন্য ইইউকে অনুরোধ করেছে। এরই মধ্যে জোট ছাড়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। কী কী শর্তে এবং কোন সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রিটেন জোট ছেড়ে আসতে পারবে, তা নিয়ে চলে দীর্ঘ আলোচনা। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে- ঠিক কী উপায়ে যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বের হবে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ব্রিটেন এবং ইইউ একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। ‘প্রত্যাহার চুক্তি’ নামে পরিচিত এই চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেনকে জোট ছেড়ে বেরোতে হলে ইইউকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে বিরাট অঙ্কের অর্থ। সে অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডলার। ব্রিটেনের যেসব নাগরিক ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশে বসবাস কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য বা কাজকর্ম করছেন তাদের এবং ব্রিটেনে ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশের যেসব নাগরিক রয়েছেন, তাদের কী হবে সেটি চুক্তিতে বলা আছে। এ ছাড়া উত্তর আয়ারল্যান্ড (ব্রিটেনের অংশ) এবং আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের (স্বাধীন দেশ) মাঝামাঝি ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের সীমানা কিভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা-ও রয়েছে চুক্তিতে। আলোচনার ভিত্তিতে ব্রিটেন এবং ইইউকে একটি নির্দিষ্ট ‘অন্তর্বর্তীকালীন সময়’ দেয়া হয়েছে, যেন তারা একটি বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছতে পারেন এবং নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য বুঝে নিতে পারেন। এ ছাড়া দুই পক্ষের মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হতে পারে- সে বিষয়ে একটি রাজনৈতিক ঘোষণার উল্লেখ রয়েছে এই চুক্তিতে। তবে দুই পক্ষকে সেসব যে পুরোপুরি মানতে হবে, তা নয়। এটি হলো ভবিষ্যতে আলোচনার সুযোগের একটি চেষ্টা।
‘প্রত্যাহার চুক্তি’ ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অনুমোদন করলেই দেশটি ইইউ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেখানেই লেগেছে বড় রকমের ‘গিটটু’। গণভোটের সময় ব্রেক্সিটের বিরোধী ছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এর পক্ষে ভোট পড়ার কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। আর ব্রেক্সিটের জন্য প্রয়োজনীয় ‘প্রত্যাহার চুক্তি’ তিন-তিনবারের চেষ্টায়ও পার্লামেন্টে পাস করাতে ব্যর্থ হয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। প্রত্যাহার চুক্তিতে উত্তর আয়ারল্যান্ডের অবস্থান নিয়ে যা বলা হয়েছে, তাতে অনেক ব্রিটিশ এমপি ক্ষুব্ধ। তাদের যুক্তি, ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পরও তার অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড ইইউর আইনের কাঠামোর মধ্যেই থেকে যাবে, এটা হতে পারে না।
ব্রেক্সিট-বিপাক থেকে ব্রিটেনকে উত্তরণের পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েই প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। অবশ্য তিনি নিজ দলের মধ্যেও অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। গত কয়েক বছরের দায়িত্ব পালনকালে এমন একটি ঘটনাও ঘটেনি, যেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্যক্তিগত কারিশমা দেখাতে পেরেছেন থেরেসা। এক কথায়, সার্বিকভাবে ব্যর্থ প্রধানমন্ত্রী তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন চুক্তিটির ব্যাপক কোনো রদবদল মানবে না বলে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টি চাইলেই চুক্তিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। একটি বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর ধরে অচলাবস্থার কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত ব্রিটেনের সাধারণ মানুষও এখন ব্রেক্সিটের পক্ষে-বিপক্ষে সোচ্চার। প্রতিদিন লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার হাউজের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। অনেকে নতুন করে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি করছেন। এমনকি গণভোটের পক্ষে ১০ লাখ লোকের মিছিলও হয়েছে। ব্রেক্সিটের পক্ষের লোকেরাও সোচ্চার। তাদের কথা হচ্ছে, ত্যাগ ত্যাগই। ত্যাগ সম্পর্কে ২০১৬ সালে গণভোটে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ‘তা কার্যকর করতে হবে।’ ‘যারা নতুন করে গণভোট চাচ্ছেন তারা বলছেন, ২০১৬ সালে নেতারা সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়েছিলেন।’ আবার গণভোট হলে সম্ভবত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে থাকার পক্ষেই জনসাধারণ রায় দেবে।
যা হোক, ব্রেক্সিট ইস্যু ব্রিটিশ রাজনীতিতে একটি বড় তোলপাড় ঘটিয়ে দিয়েছে। এখন থেরেসা মের উত্তরসূরি নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন বরিস জনসন। দলীয় এমপিদের প্রথম দফা ভোটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনসন পেয়েছেন ১১৪ ভোট। মাত্র ৪৩ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। তৃতীয় স্থানে রয়েছেন পরিবেশ বিষয়কমন্ত্রী মাইকেল গোভ, পেয়েছেন ৩৭ ভোট।
মোট ১০ জন প্রার্থী থেরেসা মের উত্তরসূরি হওয়ার লড়াইয়ে নামেন। তার মধ্যে প্রথম দফা ভোটাভুটিতেই বাদ পড়েন এস্টার ম্যাকভি (৯ ভোট), মার্ক হারপার (১০ ভোট) ও অ্যান্ড্রিয়া লিডসম (১১ ভোট)। তারা প্রথম ধাপ উত্তীর্ণ হতে প্রয়োজনীয়, কমপক্ষে ১৭ ভোট পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে সাবেক ব্রেক্সিটবিষয়ক মন্ত্রী ডোমিনিক রাব ২৭, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ২৩, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক ২০ ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী রোরি স্টুয়ার্ট ১৯ ভোট পেয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে আছেন। ১৯ জুন হচ্ছে দ্বিতীয় দফা ভোটাভুটি। তার আগে টিকে থাকা প্রার্থীদের ১৮ জুন বিবিসি ওয়ানে সরাসরি বিতর্কে অংশ নেয়ার কথা।
কনজারভেটিভ দলের নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে দলটির ৩১৩ জন আইনপ্রণেতা ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রার্থী সংখ্যা দুইয়ে নামিয়ে আনবেন। তারপর দলের এক লাখ ৬০ হাজার তৃণমূল সদস্যের ভোটে ওই দুইজন থেকে একজন নেতা নির্বাচিত হবেন। নিয়ম অনুযায়ী, নতুন নেতাই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। জুলাই মাসের শেষের দিকে নতুন নেতাকে চূড়ান্ত করা হবে। তখন থেরেসা মে সেই নেতার কাছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তুলে দিয়ে বিদায় নেবেন।
এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রার্থীরা জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ইইউর সাথে কোনো রকম চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার কথা বলছেন। চুক্তি ছাড়া ব্রেক্সিট বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, সেটিও একটি প্রশ্ন। তবে মনে হচ্ছে, ব্রিটিশ তথা ইংরেজ জাতি যেন সেই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের সেই একগুঁয়ে, আধিপত্যবাদী মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটাতে যাচ্ছে। সবাই জানে, ব্রিটেন ইউরোপীয় রাষ্ট্র হলেও দেশটি মূল ইউরোপ ভূখণ্ডের সাথে ব্যাপক কোনো কর্মকাণ্ডে শরিক ছিল না; বরং অনেকের সাথে ব্যাপক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত ছিল, বিশেষ করে প্রতিবেশী ফরাসিদের সাথে। প্রথম শিল্প বিপ্লব হয়েছিল ব্রিটেনে। মন-মানসিকতার দিক থেকে মূল ভূখণ্ডের মানুষের সাথে ব্রিটেনের মানুষের ঐক্য কম; বরং ব্রিটেনের মানুষের সাথে তার উপনিবেশের মানুষের ঐক্য কিছু বেশি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউরো চালু করে, তখন ব্রিটেন ইইউর সাথে আলাপ-আলোচনা করে তাদের নিজস্ব মুদ্রা চালু রেখেছিল। একটা সার্বভৌম দেশের নিজস্ব মুদ্রা না থাকাকে ব্রিটেনের মানুষ ‘অপমান’ বলে মনে করত। দেশটি দীর্ঘ চার শ’ বছর বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এলাকা শাসন করেছে, ইউরোপের আর কোনো জাতির যে ‘সৌভাগ্য’ হয়নি। ইউরোপের প্রতিটি জাতি আধুনিক শিল্প-কারখানার তালিম পেয়েছে ব্রিটিশের হাতে। এটি হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, যারা উচ্চতর আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্র, আধুনিক ব্যাংকিং, শিল্প বিপ্লব এবং বিশ্বায়নের সমগ্র ধারণা তৈরি করেছে। এসব কারণে মূল ভূখণ্ডের মানুষের চেয়ে ব্রিটিশরা নিজেদের কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র মনে করে। এটিকে এক ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের বোধ বললে অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না।
ব্যক্তিগতভাবে এই লেখকের ধারণা, ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার পেছনে খুব সঙ্গোপনে সক্রিয় রয়েছে ইংরেজ জাতির শ্রেষ্ঠত্বের সেই মধ্যযুগীয় বড়াই। ইইউতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ ইংরেজরা এখন খুব অবচেতনে নিজেদেরকে পরোক্ষে উপনিবেশের অধীন বলে মনে করতে শুরু করেছে। আর সেকারণেই তারা ব্রেক্সিটের মাধ্যমে নিজেদের আহত আত্ম-অহমিকা রক্ষার প্রয়াসে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিছুটা চরম ভাবাপন্ন বরিস জনসন যদি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তাহলে বলতেই হবে বিশ্বে জনতুষ্টিবাদ বা লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের জোয়ার থেকে ব্রিটেনও কিছুমাত্র মুক্ত নয়।