বিদ্বেষের স্রোতে ডুবছে ভারতের সংখ্যালঘুরা

সম্প্রতি ভারত সরকার যখন গোরক্ষা কমিটির পিটিয়ে হত্যা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের ক্রুদ্ধ জবাব দিয়েছে, তখনই আরেক তরুণ মুসলমানকে পিটিয়ে মারা হয়। তাবরেজ আনসারি নামের ২৪ বছর বয়সি ওই তরুণকে পেটানোর ভিডিও প্রচারের পর ভারতব্যাপী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

নোবেল পুরস্কারজয়ী ভিএস নয়পাল যে দেশকে লাখ লাখ বিদ্রোহের দেশ বলে অভিহিত করেছিলেন, সেই ভারত এখন একের পর পিটিয়ে মারা ও আহত করার ঘটনা দেখছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ২৬৫টি ঘটনার কথা জানা গেছে। এগুলোর প্রায় ৫৯ ভাগ ক্ষেত্রে শিকার হয়েছে মুসলমানরা। আর ৫৮ ভাগ হামলাকারী হচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। গত পাঁচ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর বিদ্বেষপ্রসূত হামলা ১০ গুণ বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায় এতে। সমালোচকদের মতে, মোদির হিন্দুত্ববাদী বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এই বৃদ্ধি।

প্রাচীন বর্ণবাদী ব্যবস্থা অনুসরণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে যারা নিম্নবর্ণে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নির্যাতিত হয়েছে। ‘দলিত’ নামে পরিচিত এসব শ্রেণির লোক মুসলমান সংখ্যালঘুদের মতো ক্রমবর্ধমান বিদ্বেসপ্রসূত হামলার টার্গেট হচ্ছে। ভারতে মুসলমানরা হচ্ছে সংখ্যায় ২০ কোটি, মোট জনসংখ্যার ১৪ ভাগ। তাদের ওপর হামলার ধরনটি যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী হামলার সমতুল্য।

পিটিয়ে হত্যার ঘটনা প্রবলভাবে সামনে আসে ২০১৫ সালে মোহাম্মদ আখলাকের ঘটনায়। ৫০ বছর বয়সী এই ব্যক্তিকে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে তার গ্রামে দাঙ্গাবাজরা হত্যা করে। তার বাড়িতে জবাই করা বাছুরের মাংস আছে, এই সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে সরকারি তদন্তে দেখা যায়, তার বাড়িতে গরুর মাংস ছিল না। ওই হামলার এক আসামি মারা যায় ২০১৬ সালে। তখন গ্রামের অধিবাসীরা তার লাশ জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেয়।

এরপর থেকে গোরক্ষাকারীদের তান্ডব আরও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। ২০১৭ সালে ঝাড়খন্ডে ব্যস্ত বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে ৩০ জনের একটি গোরক্ষা দল আলিমুদ্দিন আনসারিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। তিনিও গরুর মাংস বহন করছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়। আর গত বছর বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে মোহাম্মদ কাসিম নামের ৩৮ বছর বয়সি এক লোককে হত্যা করা হয় গরু চুরির অপবাদে। ঝাড়খন্ডে ২০১৬ সাল থেকে বিদ্বেষপ্রসূত হামলার ১৪তম শিকার হলেন আনসারি। এ তথ্য পর্যবেক্ষণ ওয়েবসাইট ফ্যাক্টচেকার ডট ইনের। সাবেক সাংবাদিক সকেট গোখলে বলেন, প্রহারের ঘটনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজের দলের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় প্রহারের ঘটনায় সরকারি সমর্থনের প্রমাণই স্পষ্ট হয়।

আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে গত ২১ মে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। এতে বলা হয়, মুসলমান ও নিম্নবর্ণের দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চলছে, তাদেকে ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত সরকারের পরিসংখ্যানে গত দুই বছরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ব্যাপকভাবে বাড়ার ইঙ্গিত দিলেও মোদি প্রশাসন সমস্যাটির সমাধান করেনি। প্রতিবেদনে ২০১৮ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। এতে প্রধানত মুসলমানদের ওপর হামলার জন্য মোদির ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার উসকানিমূলক বক্তব্যের কথা বলা হয়। তবে মোদি সরকার এর জবাবে জানিয়েছে, ভারত তার সেকু্যলার পরিচিতি, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ও বহুত্ববাদী সমাজ নিয়ে গর্বিত।

পিটিয়ে মারার ঘটনা নিয়ে মোদি নীরব রয়েছেন। তবে লোকসভা নির্বাচনের পর পার্লামেন্টে উদ্বোধনী ভাষণে তিনি এর নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, ঝাড়খন্ডে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি দুঃখজনক। তবে এজন্য কেন পুরো রাজ্যকে দোষী করা হবে? ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালার সহিংসতাকে একইভাবে বিবেচনা করা হবে।

ভারতীয় বামপন্থি কর্মী উমর খালিদ বলেন, বিজেপি সমাজে মেরুকরণ করছে। তিনি বলেন, এল কে আদভানির নেতৃত্বে দাঙ্গা সৃষ্টিকারী সমাবেশের মাধ্যমে এই মেরুকরণ করা হয়েছে। এখন মোদির আমলে হামলার নিত্যদিনের ঘটনাগুলো ঘটছে। খালিদের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারকে জবাবদিহিতায় আনার মতো শক্তিশালী বিরোধী দলের অভাব এজন্য দায়ী। আর এসব কারণে ভারতে বিদ্বেষের স্রোতে ডুবছে সংখ্যালঘুরা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button