হাসিনা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে ভয় পাচ্ছেন : খালেদা জিয়া
আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের দুর্নীতি-লুটপাট, অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে তারা এতো অপকর্ম করেছে যে, এখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে ভয় পাচ্ছে। তারা জানে ক্ষমতা ছাড়লে এসব বিষয় সামনে চলে আসবে। তিনি বলেন, সরকারের দুর্নীতি-লুটপাটের সব তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। কিন্তু আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। সরকার পরিবর্তনের পর যা কিছু হবে, সবই আইনগতভাবে।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট জয়লাভ করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সামনের দিনে বিএনপির রাজনীতি হবে নতুন আঙ্গিকে, নতুন ধারার। আমরা ঐক্যের রাজনীতি করবো। ভালো ভালো লোককে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করবো। সে লক্ষ্যে কর্মসূচিও প্রস্তুত করা হচ্ছে। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তবে মনে রাখতে হবে, কোনো অবস্থায়ই হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না। আগামী নির্বাচন অবশ্যই নির্দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে। হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে না, করতে দেয়া হবে না। এ সময় উপস্থিত নেতাকর্মীরা স্লোগান ও বিপুল করতালির মাধ্যমে বেগম জিয়ার বক্তব্য সমর্থন করেন।
বেগম জিয়া রোববার দুপুরে যশোর সার্কিট হাউজ সম্মেলন কক্ষে বিএনপি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন। খুলনার জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে বেগম জিয়া শনিবার বিকেলে ঢাকা থেকে যশোরের উদ্দেশে রওনা দেন। যশোর সার্কিট হাউজে রাতযাপন শেষে রোববার দুপুরে তার গাড়িবহর খুলনার উদ্দেশে যাত্রা করে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার দল ও জোটের বর্তমান রাজনীতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের এখনকার প্রধান দায়িত্ব হলো নির্বাচন নয়, দেশ, জনগণ ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করা। দেশ রক্ষায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজের অধীনে নির্বাচন করতে চান। নির্দলীয় সরকারের জনদাবির প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বার বার মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের উদাহরণ দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছেন। খালেদা জিয়া দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না। ওটি ছিল অবৈধ সরকার। ওই সরকারের অধীনে নির্বাচনের ফলাফল কী হবে তা আমরা জানতাম। কিন্তু অ্যালায়েন্সের কারণে আমরা নির্বাচনে গিয়েছিলাম। সাজানো নির্বাচনে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের সঙ্গে আঁঁতাত করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি বলেন, এর আগে ’৯১ সাল থেকে সবগুলো নির্বাচন হয়েছিল প্রকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচনগুলো নিরপেক্ষ হয়েছে।
প্রায় আধাঘণ্টার বক্তব্যে বেগম জিয়া বর্তমান সরকারের দুর্নীতি-লুটপাট-অপরাজনীতির ফিরিসিত্ম তুলে ধরে বলেন, তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো লুটপাট করে নিয়েছে। দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুও হলো না। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প ও অস্ত্র ক্রয়ে ভয়াবহ দুর্নীতি-অনিয়ম হচ্ছে। সরকারি দলের লোকেরা টাকা পাচার করছে বিদেশে। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারের এসব দুর্নীতি দেখতে পায় না। তারা আসলে সরকারের আজ্ঞাবহ। প্রশাসন, জুডিশিয়ারি, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাবে ভয়াবহ দলীয়করণের কথা উল্লেখ করে বেগম জিয়া বলেন, দলীয় লোক যদি যোগ্য হতো তাহলেও হতো। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগার হলেই তার নিয়োগ-পদোন্নতি হচ্ছে। সবকিছুই করা হচ্ছে দুর্নীতি-লুটপাটের জন্য। সোনালী ব্যাংকে যেভাবে লুটপাট হয়েছে, তাতে ব্যাংকটিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ৩০৯ বছর লাগবে।
বেগম খালেদা জিয়া বলেন, বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটের নেতারা সারাদেশ সফর করেছেন। এখন আমি নিজে বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসভা করছি। এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়। আমরা সরকারের অপকর্ম, অন্যায়-অত্যাচার, জুলুমের চিত্র তুলে ধরছি। হাসিনার অধীনে কেন নির্বাচন করতে চাই না তা তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে আওয়ামী লীগ যে হিংসাত্মক আন্দোলন করেছিল, তার বর্ণনা দিয়ে বেগম জিয়া বলেন, তারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। গানপাউডার বাসযাত্রীদের পুড়িয়ে মেরেছিল। এখন তারাই আবার নির্দলীয় সরকারের বিরোধিতা করে বাকশালি কায়দায় আজীবন ক্ষমতা আঁঁকড়ে থাকতে চাইছে। তারা বিএনপিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে, অত্যাচার করে নির্বাচনে নিতে চায়। কিন্তু সরকারি জোটের মেনন-ইনু ছাড়া অন্যরাও চাইছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। ১৮ দলের শরিক ছাড়াও অন্যান্য ছোট-খাট দল এই দাবিতে একাট্টা। তার প্রমাণ মিলছে বিএনপির কর্মসূচিতে। তিনি রংপুর, রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত সামপ্রতিক জনসভাগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রতিটি সমাবেশই পূর্ববর্তী জনসভার রেকর্ড ভাঙ্গছে। সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এখন নির্বাচন নয়, আন্দোলনের দিকে ধাবিত হতে হবে।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন যশোর জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হুদা। এতে অন্যদের মধ্যে বক্তৃতা করেন বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ও জেলা কমিটির সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু। এসময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী টিএস আইয়ুব, আবুল হোসেন আজাদ, যশোরসহ ছয়টি পৌরসভার মেয়র, উপজেলা কমিটিগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম গত পাঁচ বছরে যশোর অঞ্চলে সরকারি দলের ক্যাডারদের খুন-খারাবি, অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো অবস্থায়ই নির্বাচন করবো না। নির্বাচনমুখী নয়, এখন সবাইকে আন্দোলনমুখী হতে হবে।